Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪

ভোটবাবুরা আসার সময় পান না, স্বদেশেই পরবাসী নাড়ুখাকির চর

পদ্মার বুকে একসময় জেগে ওঠা নাড়ুখাকির চরে সময় যেন থমকে রয়েছে। বাংলাদেশের চাপাই নবাবগঞ্জ জেলার বাথানপাড়ার উঠোন, আর রঘুনাথগঞ্জের চর নাড়ুখাকির উঠোনের মাঝে দু’ দেশের ‘জিরো পয়েন্টের পিলার’ রয়েছে।

চরে যাতায়াতের ভরসা বলতে এই নৌকো। নাড়ুখাকির চরে ছবি: রতন ঘোষ।

চরে যাতায়াতের ভরসা বলতে এই নৌকো। নাড়ুখাকির চরে ছবি: রতন ঘোষ।

অনল আবেদিন
শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:০৭
Share: Save:

পদ্মার বুকে একসময় জেগে ওঠা নাড়ুখাকির চরে সময় যেন থমকে রয়েছে। বাংলাদেশের চাপাই নবাবগঞ্জ জেলার বাথানপাড়ার উঠোন, আর রঘুনাথগঞ্জের চর নাড়ুখাকির উঠোনের মাঝে দু’ দেশের ‘জিরো পয়েন্টের পিলার’ রয়েছে। ওই পিলারটুকু ছাড়া আদিগন্ত বিস্তৃত ধু ধু বালির চর। পদ্মার জল-জঙ্গলের মাঝে গড়ে ওঠা নাড়ুখাকিতে পা ফেললেই মনে পড়ে যায় হোসেন মিঞার ময়নাদ্বীপের কথা।

বৃহস্পতিবার দুপুরে নাড়ুখাকির চরে আগুন লাগে। বৈশাখ মাসের চরের বাতাসের দাপটে নিমেষে পুড়ে ছাই উলুখাগড়ায় তৈরি ২৫টি কুড়েঘর। খাদ্য, বস্ত্র, আসবাব- কিছুই বাঁচানো যায়নি। এক লহমায় ২৫টি পরিবার সর্বহারা। লাগোয়া বাথানপাড়ার (বাংলাদেশ) প্রতিবেশীরা আগুন নেভাতে ছুটে এসেছিলেন। কিন্ত তাঁরাও নিরুপায়। পদ্মা নদীর চরে বাস হলেও আগুন নেভানোর জল নেই। নাড়ুখাকির যুবক সেলিম শেখ বলেন, ‘‘নাড়ুখাকির ৪টে মহল্লায় হাজার দুয়েক লোকের বাস। সব নলকূপ অকেজো। সচল মাত্র ৫টি। তাই খুব জলকষ্ট। পিপাসার মেটানোর জলটকুরও বড় অভাব।’’

সে কথা মানছেন রঘুনাথগঞ্জ ২ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির স্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ সিপিএমের বিজয়কুমার জৈন। তিনি বলেন, ‘‘জলকষ্ট মেটাতে বছর খানেক আগে ধারের টাকায় ওই চরের ৪টি মহল্লায় ৩২টি নলকূপ বসানো হয়েছে। সেই টাকা আজও মেটানো হয়নি। ফলে অচল নলকূপ সংস্কার করা সম্ভব হয়নি।’’ ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র জেলেপাড়ার মতো চর নাড়ুখাকিতে কেবল ঈশ্বরই নয়, রাজনীতিকদেরও দেখা মেলে না। ওই চরের প্রাক্তন পঞ্চায়েত সদস্য কংগ্রেসের নাজেম শেখ বলেন, ‘‘এ বার কোনও প্রার্থীই এই চরে প্রচারে আসেনি। আর আসবেনও না। সব দলের নিচুতলার কর্মীরাই ভোটটা সামাল দেয় বরাবর। এ বারেও তাই।’’

গ্রাম পঞ্চায়েতের বর্তমান সদস্য তৃণমূলের সায়রা বিবির স্বামী মকবুল হোসেন বলেন, ‘‘ওই চরে বিধবা ভাতা, বার্ধক্য ভাতা কেউ পায়নি। ইন্দিরা আবাস, বা গীতাঞ্জলি প্রকল্পের কোনও বাড়ি এখানে হয়নি। অথচ সবাই বিপিএল। বিদ্যুৎ নেই, সৌর আলো নেই। প্রাথমিক স্কুল বছর খানেক আগে পদ্মায় বিলীন হয়েছে। নতুন করে গৃহ নির্মাণ হয়নি। সপ্তাহে দু’ দিন প্রাথমিক শিক্ষক আসেন মূল ভূখণ্ড থেকে।’’ এই চর থেকে রেশন দোকান দেড় দশক আগে উঠে গিয়েছে পদ্মাপাড়ের মূল ভূখণ্ড জামতলা-কৃষ্ণশাইল-বড়জুমলায়। সেখান থেকে রেশন আনতে ৪০ টাকা পারানি দিয়ে খেয়া পারপার করতে হয়। ৩-৪ ঘণ্টা সময় খরচ করে রেশনের কেরোসিন জোটে। খেয়া নৌকার ইজারাদার দয়াপরবেশ হয়ে হাইস্কুলের পড়ুয়াদের পারানিতে কিছুটা ছাড় দেন।

মধ্যযুগে পড়ে থাকা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো চরনাড়ুখাকি, চর জোতবিশ্বনাথপুর, চরগোঠা ও হঠাৎপাড়ার সঙ্গে বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম বলতে কেবল মোবাইল ফোন। কিন্তু সেই মোবাইলের ব্যাটারি চার্জ দিতে ছুটতে হয় ৩ কিলোমিটার পদ্মা উজিয়ে মূল ভূখণ্ডে। ওই মরুভূমির মধ্যে চরবাসীদের মরুদ্যান বলতে বিএসএফের বর্ডার আউট পোস্ট (বিওপি)। চর জোতবিশ্বনাথপুর ও চরগোঠার মাঝে রয়েছে বিএসএফের বিওপি। সেখানে রয়েছে জেনারেটর। চরের সেলিম সেখ বলেন, ‘‘বিএসএফের জেনারেটর চললে সেখানে মোবাইল চার্জ দেওয়া যায়।’’ দু’ জন গ্রামীণ চিকিৎসক ছাড়া চরে কোনও স্বাস্থ্য পরিষেবা নেই। রাতবিরেতে মুমূর্ষু রোগীকে মূল ভূখণ্ডে নিয়ে যেতে ৫০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা নৌকা ভাড়া দিতে হয়। ওই চরের অনেকেই বলেন, ‘‘খুব জরুরি সময় বিএসএফ তাঁদের গাড়িতে করে রোগীকে ঘাটে নিয়ে আসে। তারপর তাঁদের স্পীড বোটে করে রোগীকে পদ্মা পার করে দেন বিএসএফের জওয়ানরা।’’

অভিযোগ, কেন্দ্রীয় বাহিনীর ওই ভূমিকার বিপরীতে রয়েছে স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা। রঘুনাথগঞ্জ ২ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির স্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ বিজয়কুমার জৈনের স্ত্রী মিনা জৈন ছিলেন পূর্বতন পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি। সে কথা জানিয়ে বিজয়বাবু বলেন, ‘‘বছর চারেক আগে চরপিরোজপুর, চরবাজিতপুর, চরনাডুখাকি চরগোঠা, চর জোতবিশ্বনাথপুর ও হঠাৎপাড়া মিলিয়ে মোট ৯৮০ জনকে জমির পাট্টা দেওয়া হয়েছে। সরকারি খাতা-কলমে তাদের জন্য নিজভূমি নিজগৃহ প্রকল্পে ঘর করে দেওয়া হয়েছে। বাস্তবে একজনও বাড়ি পায়নি। চরনাড়ুখাকিতে একই ভাবে সরকারি খাতা-কলমে অঙ্গনওয়াড়ি সেন্টার ও ফ্লাড শেল্টার করে দেওয়া হয়েছে। তারও কোনও বাস্তব অস্তিত্ব নেই। এ ভাবে কোটি কোটি টাকা নয়ছয় হলেও চরনাড়ুখাকি পড়ে রয়েছে মধ্যযুগেই।’’

ঈশ্বর, বা রাজনীতিকদের পা না পড়লেও আগুন লাগার খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার নাড়ুখাকি গিয়েছিলেন বিডিও সুভাষকুমার ঘোষ। তিনি বলেন, ‘‘আগুনে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া পরিবারগুলির জরুরি ভিত্তিতে পুনর্বাসনের কাজে ব্যস্ত রয়েছি। ওই চর এলাকার উন্নয়নের জন্য বড়সড় প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে, যা একা বিডিওর পক্ষে সম্ভব নয়।’’ তার জন্য সম্ভবত ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র হোসেন মিঞার মতো কারও আবির্ভাব পর্যন্ত চরনাড়ুখাকিকে অপেক্ষা করতে হবে!

অন্য বিষয়গুলি:

Assembly Election 2016 Nadukhaki's Char
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy