নারদ নিউজের ভিডিও-য় দেখা মেলা জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে মামলা হয়েছে হাইকোর্টে। যেমনই হোক, তদন্ত হচ্ছে শাসক দলের অন্দরে। কিন্তু আইপিএস অফিসার এসএমএইচ মির্জাকে ঘিরে সব চুপচাপ।
নারদ ভিডিও-য় দেখা গিয়েছে, হাত পেতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নিচ্ছেন বর্ধমানের প্রাক্তন পুলিশ সুপার! এমনকী, তৃণমূলের একাধিক এমপি-এমএলএ’র নাম করে লোকসভা ভোটে তাঁদের ‘স্পনসর’ পাইয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব জাহির করতেও ছাড়ছেন না!
আনন্দবাজারের তরফে ফুটেজটির সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তবে গত এক মাস যাবৎ সোশ্যাল মিডিয়ায় নেতাদের টাকা নেওয়ার নারদ-চিত্র ‘ভাইরাল’ হয়ে গিয়েছে। সভা-সমাবেশে গলা ফাটাচ্ছে বিরোধীরা। তার পরেও কিন্তু মির্জার বিরুদ্ধে উপযুক্ত পদক্ষেপ করার সাহস পাচ্ছেন না রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা।
কেন? নিয়ম তো বলে, দল থাকবে দলের মতো, প্রশাসন প্রশাসনের মতো। শাসকদল প্রশাসনে নাক গলাবে না। যদি গলায়, সরকারের আমলা-অমাত্যেরা পাত্তা দেবেন না। উল্টে কড়া চোখে সমঝে দেবেন।
বিরোধীরা বলছেন, তবে এ রাজ্যে এখন উল্টোটাই দস্তুর। শাসকদলের মাথারা তো আছেনই। মেজো-সেজো-ছোট ‘দাদা-দিদি’দের কথাতেও ওঠ-বোস করতে করতে প্রশাসনের হাঁটু খুলে যাওয়ার জোগাড়! তাই সরকারকে বেইজ্জত করেও গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারছেন মির্জা। বিরোধীদের দাবি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের অধিকাংশ আমলা যে নবান্নের সর্বোচ্চ স্তরের কাছে শিরদাঁড়া বাঁধা রেখে দিয়েছেন, মির্জা-কাণ্ড তারই প্রমাণ।
বিরোধীদের আক্ষেপে সারবত্তা দেখতে পাচ্ছেন প্রশাসনেরই একাংশ। তাদের বক্তব্য: নারদ-ভিডিওয় তৃণমূল সাংসদদের হাত পেতে টাকা নিতে দেখে লোকসভার স্পিকার ‘এথিক্স কমিটি’কে ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে বলেছেন। অথচ একই কালির দাগ লাগা তৃণমূল মন্ত্রী-বিধায়কদের সম্পর্কে রাজ্য বিধানসভা কোনও পদক্ষেপ করেনি। ঠিক একই ভাবে মির্জার বিষয়ে হাত গুটিয়ে বসে রয়েছে মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রীর অধীনস্থ স্বরাষ্ট্র দফতর ও পুলিশ ডিরেক্টরেট। তৃণমূল শীর্ষ নেতা মুকুল রায়ের ‘অতি ঘনিষ্ঠ’ আইপিএসটির বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত দূর, ন্যূনতম শো-কজ করার হিম্মতও নবান্নের কর্তারা দেখিয়ে উঠতে পারেননি। সবুজ সঙ্কেতের জন্য তাঁরা তীর্থের কাকের মতো চেয়ে আছেন উপরপানে।
চেয়ে থাকাই সার। এখনও সঙ্কেত আসেনি। নবান্নের খবর, মির্জার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে গেলেও ভোটপর্ব মেটার আগে তা কার্যকর করার পরিকল্পনা নেই। কেন?
রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডি মন্তব্য করতে চাননি। স্বরাষ্ট্র-সচিব মলয় দে ফোন ধরেননি, এসএমএসের জবাব দেননি। ব্যাখ্যা না-পেয়ে সন্দেহের ঝাঁঝ বাড়ছে। বিরোধীরা তো বটেই, নবান্নের একাংশেরও দাবি: এই আমলে বহু দলীয় কাজ প্রশাসনের হাত ধরে হয়েছে। বর্ধমানে যেমন শাসকদলের ঘরোয়া কোন্দল মেটাতে পুলিশের ডাক পড়েছে, তেমন উত্তরবঙ্গের এক ডিএমের ‘কনফিডেন্সিয়াল’ রিপোর্টের ভিত্তিতে পদ হারিয়েছেন জেলার তৃণমূল সভাপতি। মির্জার ক্ষেত্রেও দল-প্রশাসন কোলাকুলির অঙ্কটা কাজ করছে। ‘‘যাঁকে দিয়ে এত কাল দলের স্বার্থসিদ্ধি করানো হয়েছে, তাঁকে কোন মুখে কাঠগড়ায় তুলবে দলের সরকার? কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার ভয় আছে না?’’— কটাক্ষ এক অফিসারের।
বস্তুত নারদ-ভিডিওর ছত্রে ছত্রে মির্জার মুখে দল-ঘনিষ্ঠতার সগর্ব ঘোষণা মজুত। তিনি বলেছেন, বর্ধমানে তৃণমূলের মিটিং-মিছিলে লোক জোগাড় থেকে শুরু করে গাড়ি-টিফিনের বন্দোবস্ত— সব তিনি করতেন। এমনকী, জনসভায় লোক কম হলে মুখ্যমন্ত্রী যে তাঁরই দ্বারস্থ হতেন, তা-ও জানিয়েছেন ফলাও করে। মুকুল রায় তাঁর কাছে হয়েছেন ‘মুকুলদা।’ নবান্নের খবর, প্রশাসন ও পুলিশের উঁচুমহলেও মির্জা সাহেবের নেতা-যোগের সংবাদ বিলক্ষণ সুবিদিত। সেটা মাথায় রেখেই কর্তারা ওঁকে ঘাঁটানোর সাহস পাচ্ছেন না বলে রাজ্যের বিভিন্ন স্তরের পুলিশ আধিকারিকদের একাংশের পর্যবেক্ষণ।
সাহস থাকলে মির্জার বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেওয়া যেত?
নবান্ন-সূত্রের ব্যাখ্যা: ডিজি ওঁকে শো-কজ করতে পারতেন। জানতে চাইতে পারতেন, ফুটেজটি সত্যি কিনা। পাশাপাশি উত্তরের অপেক্ষা না-করে শো-কজের ফাইল পাঠিয়ে দিতে পারতেন স্বরাষ্ট্র দফতরে। কারণ, এসপি’র বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত করার এক্তিয়ার পুলিশ ডিরেক্টরেটের না-থাকলেও স্বরাষ্ট্র দফতরের আছে।
এ সবের কিছুই করার মতো বুকের পাটা পুলিশকর্তাদের হয়নি। যাতে আখেরে দলেরই মুখ পুড়েছে বলে মনে করছেন তৃণমূলের অনেক নেতা। জনান্তিকে তাঁরা বলছেন, মুখ্যমন্ত্রী মির্জার বিরুদ্ধে আগেভাগেই তদন্তের নির্দেশ দিলে ‘রাজধর্ম’ রক্ষা করতে পারতেন। ‘‘প্রথমে দল নারদ-ভিডিওকে বলেছিল ভেজাল। তাই মির্জা প্রশ্নে নবান্ন দ্বিধায় ছিল। পরে দলীয় তদন্তের ফরমান হল। মুখ্যমন্ত্রী নিজে বললেন, সময় পেলে অভিযুক্ত মন্ত্রী-এমএলএদের টিকিট দেওয়ার কথা ভেবে দেখতেন!। এর পরেও নবান্ন কেন হাত গুটিয়ে আছে, মাথায় ঢুকছে না।’’— মন্তব্য এক তৃণমূল শীর্ষ নেতার। তাঁর খেদ, ‘‘এতে সরকারের ভাবমূর্তি আরও খারাপ হচ্ছে।’’
এ দিকে ইতিহাস বলছে, প্রাক্তন পুলিশকর্তা নজরুল ইসলামের ক্ষেত্রে মমতার এই আমলারাই অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়েছিলেন। একটা বই লেখায় বছর তিনেক আগে নজরুলের হাতে ‘চার্জ মেমো’ ধরিয়েছিল প্রশাসন। পুলিশ ও স্বরাষ্ট্র-কর্তারা লাফ-ঝাঁপ করে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ওই ফাইল বানিয়ে ফেলেন। সেখানেই শেষ নয়। স্বরাষ্ট্র–সূত্রে জানা যাচ্ছে, অফিসারদের জন্মদিনে শুভেচ্ছা কার্ড পাঠানো চালু করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। ২০১৩-য় নজরুল কার্ড পেয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে ৭০ পাতার চিঠি লেখেন, যার কিছু কথা ‘সরকারের’ পছন্দ হয়নি। তাই ফের নজরুলের কৈফিয়ৎ চাওয়া হয়েছিল। তখনও প্রশাসনের ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো।
অথচ এত গুরুতর অভিযোগ সত্ত্বেও মির্জার ক্ষেত্রে ভিন্ন ফল! বিরোধীদের বক্তব্য, ‘নারদ’ বিধায়কদের জেতানোর দায় দলের থাকতেই পারে। কিন্তু এক আইপিএসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ভোট শেষের অপেক্ষায় থাকার যুক্তি নেই।
যেখানে যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না, সেখানে সংশয় দানা বাঁধে। ‘‘তা হলে কি সত্যিই শাসকদলের হয়ে টাকা তোলার দায়িত্ব ছিল মির্জার?’’— প্রশ্ন ক্রমশ জোরালো হচ্ছে প্রশাসনের অন্দরেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy