বাঘমুণ্ডির চড়িদার পথে তখন টলিউডের সায়ন্তিকা, নুসরতদের সঙ্গে পরিচালক রাজ চক্রবর্তী, গায়ক অনীক।—শুভ্র মিত্র ও নিজস্ব চিত্র
দলের যুবরাজ এসে হুঙ্কার ছেড়েছিলেন, তাঁকে নেপালে পাঠাবেন।
দলের নেত্রীর এসে বললেন, উনি তো জগদ্দল পাথর।
সেই উনি অর্থাৎ নেপাল মাহাতো সব শুনে মুচকি হাসছেন। বলছেন, ‘‘এ আর নতুন কী! কত জন কত বার কত কিছু বলে গেল। বাঘমুণ্ডি আর ঝালদা কিন্তু নেপাল মাহাতোকে কখনও খালি হাতে ফেরায়নি।’’
ভোটে জেতা নিয়ে এত নিসংশয়? ফের হাসলেন নেপালবাবু। প্রথম দিকে তৃণমূলের যুবরাজ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই কেন্দ্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া মনোভাবে কিছু সংশয় দেখা দিয়েছিল কংগ্রেস কর্মীদের মনে। কিন্তু ভোটের মুখে বামেদের সঙ্গে জোট হওয়ায় সব দুশ্চিন্তা উড়ে গিয়ে জয়ের ব্যাপারে তাঁরা অনেকটাই নিশ্চিত বলে দাবি করছেন নেপাল ঘনিষ্ঠেরা। গত লোকসভা নির্বাচনের অঙ্কই নেপাল-শিবিরকে স্বস্তি দিচ্ছে। হবে নাই বা কেন? ওই নির্বাচনে বাম ভোটের সঙ্গে কংগ্রেসের মোট প্রাপ্তি যে তৃণমূলের দ্বিগুণ!
টানা তিনবার ভোটে জিতে নেপালবাবু যখন এই কেন্দ্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘জগদ্দল পাথর’ হয়ে উঠেছেন, সেখানে তাঁর বিপক্ষে রয়েছেন তৃণমূলে নবাগত সমীর মাহাতো। যিনি গত ডিসেম্বরেও (বাঘমুণ্ডিতে অভিষেকের সভার আগে পর্যন্ত) ছিলেন কংগ্রেসেই। ঝালদায় নেপালবাবুর নানা কর্মকাণ্ড আড়ালে থেকে সামলাতেন তাঁর এই রাজনৈতিক শিষ্য ভীম। চেহারায় মোটাসোটা বলে ঝালদা সত্যভামা বিদ্যাপীঠের গণিতের শিক্ষক নেপালবাবু সমীরবাবুকে ‘ভীম’ নামেই ডাকতেন। তাই তাঁদের এ বারের লড়াইকে অনেকে গুরু-শিষ্যের লড়াই হিসেবেই দেখছেন।
তৃণমূল সূত্রের খবর, কংগ্রেসের দখলে রাখা ঝালদা ১ পঞ্চায়েত সমিতি বাঘমুণ্ডির সভায় অভিষেকের হাতে তুলে দেওয়ার নেপথ্যে ছিলেন এই সমীরবাবুই। পুরো ব্যাপারটা এতই গোপনীয়তার সঙ্গে হয় যে নেপালবাবুও নাকি আঁচ করতে পারেননি বলে তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি। বিনিময়ে সমীরবাবুকে নতুন দল তাঁদের প্রার্থী করেছে। যদিও নেপালবাবুর বিপরীতে সমীরবাবুকে প্রার্থী করে তৃণমূল ‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা’ নীতি নিয়েছে বলে মনে করছেন রাজনীতি সচেতন মানুষজন।
এলাকার কংগ্রেস কর্মীরা অবশ্য মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ২০০১-এর বিধানসভা ভোটের কথা। সেবার কংগ্রেস ও তৃণমূলের মধ্যে জোট হয়েছিল। ঝালদা কেন্দ্রে জোটের হয়ে প্রার্থী দেয় তৃণমূল। অথচ সে বার ওই কেন্দ্রে প্রথম প্রার্থী হওয়ার কথা ছিল কংগ্রেস জেলা সভাপতি নেপালবাবুর। শেষে কর্মীদের আবদারে জেলা কংগ্রেসের সভাপতির পদে ইস্তফা দিয়ে নির্দল (পুরুলিয়া কংগ্রেস) প্রার্থী হয়ে ‘বাস’ প্রতীকে লড়াইয়ে নামেন নেপালবাবু। বিপক্ষে ছিলেন ফরওয়ার্ড ব্লকের তৎকালীন ত্রাণমন্ত্রী সত্যরঞ্জন মাহাতো, তৃণমূলের বিষ্ণুচরণ মাহাতা। তাঁদের হারিয়েই নেপালবাবুর বিধানসভায় প্রথম পা রাখা। সেই থেকে চলছে। ঝালদা কেন্দ্রের নাম বদলে এখন বাঘমুণ্ডি হয়েছে। ফরওয়ার্ড ব্লকের শক্ত ঘাঁটি নতুন কেন্দ্রে যুক্ত হলেও ২০১১-তেও নেপালবাবুই বিধায়ক হন।
তৃণমূলের সঙ্গে জোট ভেঙে যাওয়ায় ২০১৩-র পঞ্চায়েত ভোটে সবাই যখন ভাবছে কংগ্রেসের অস্তিত্ব বুঝি এ বার গেল। সবাইকে অবাক করে সে বার বাঘমুণ্ডি, ঝালদা ১ ও আড়শায় (বাঘমুণ্ডি বিধানসভা কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত অংশে) কংগ্রেসের দুর্গ অক্ষতই রয়ে যায়। তা অটুট পরের বছর লোকসভা ভোটেও। বাঘমুণ্ডি কেন্দ্রে কংগ্রেসের থেকে পিছিয়ে ছিল তৃণমূল। বাঘমুণ্ডি কেন্দ্রে ১,৭৩,৭৪৫ ভোটের মধ্যে কংগ্রেসের ভোট ছিল ৬৯,৬৫৯। সেখানে তৃণমূল ৫৩,১৪৩ আর বামফ্রন্ট পায় ৩৪,৩৯৬ ভোট। এ বার নেপালবাবু পাশে পেয়েছেন ফরওয়ার্ড ব্লক-সহ বামফ্রন্টের সমস্ত শরিকদের। নেপালবাবুর মনোনয়নে হাজির ছিলেন ফব-র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বীরসিংহ মাহাতো। তিনি বলেছেন, ‘‘লোকসভার নিরিখে কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের মিলিত ভোট তৃণমূলের থেকে দ্বিগুণ। এতেই সব পরিষ্কার। গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়ে আমরা সবাই নেপালের সঙ্গে রয়েছি।’’ আর নেপালবাবু দাবি করেছেন, শুধু ভোটের সময় নয়, তিনি বছরভর গ্রামে গ্রামে ঘুরে কাজ করেন। দিল্লি হোক বা নবান্ন, নিজে তহবিল চেয়ে এনে উন্নয়নের কাজ করেন। মানুষ তাঁকে চেনেন।
সমর্থকদের ভিড়ে নেপালবাবু।
নেপালবাবু যে কাজ করেছেন তা স্বীকারও করছেন তৃণমূল প্রার্থী সমীরবাবুও। তাঁর কথায়, ‘‘নেপালবাবু আমার মাষ্টারমশাই, আমার গুরু, সে অন্য দিক। তিনি এলাকায় অত্যন্ত পরিচিত মুখ, কাজও করেছেন। কিন্তু মানুষ চাইছেন এই এলাকায় আরও উন্নয়ন। আমি নির্বাচিত হলেই সেই কাজ হবে।’’ অন্য দিকে, ঝালদা পুরসভায় খাতা খুলতে পারেনি তৃণমূল, সেখানেই তৃণমূলের শহর সভাপতি ও শহর কার্যকরী সভাপতির দ্বন্দ্ব প্রার্থী ঘোষণার পরেও ছিল। সমীরবাবু কোনওরকমে দু’পক্ষকে নিয়ে পথে নামলেও অগোছাল সংগঠন কতটা ভোট ইভিএমে টানতে পারবেন সে সংশয় দূর হচ্ছে না।
ফলে লোকসভার ভোটের অঙ্ক, নেপালবাবুর কাজের নিদর্শন ছাড়াও দলের দ্বন্দ্ব তাঁকে তৃণমূলের সামনে নিছক পাথর নয়, পাহাড় করে তুলেছে। সেই পাহাড় টপকে যাওয়াই শিষ্যের কাছে মস্ত চ্যালেঞ্জ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy