Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪

কাঁটার খোঁচায় ওষুধ কী, জেরবার হাকিমও

আলিপুরের কাঁটা শেষে কিনা বন্দরেও এসে ভিড়ল! বছর আড়াই আগের এক রাতের কথা। চিড়িয়াখানার মেন গেটের সামনে এক জনকে মাটিতে ফেলে চপার দিয়ে কুপিয়েছিল এক দল লোক। এক-আধটা নয়। প্রায় ছাপ্পান্নটা কোপ!

বন্দর বিধানসভা কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী রাকেশ সিংহের হয়ে প্রচারে প্রাক্তন সাংসদ মহম্মদ আজহারউদ্দিন। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।

বন্দর বিধানসভা কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী রাকেশ সিংহের হয়ে প্রচারে প্রাক্তন সাংসদ মহম্মদ আজহারউদ্দিন। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।

শুভাশিস ঘটক
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:২৪
Share: Save:

আলিপুরের কাঁটা শেষে কিনা বন্দরেও এসে ভিড়ল!

বছর আড়াই আগের এক রাতের কথা। চিড়িয়াখানার মেন গেটের সামনে এক জনকে মাটিতে ফেলে চপার দিয়ে কুপিয়েছিল এক দল লোক। এক-আধটা নয়। প্রায় ছাপ্পান্নটা কোপ!

ঘাত-প্রতিঘাত আর অন্তর্দ্বন্দ্বে ভরা বন্দরের ভোটপর্ব নিয়ে যদি কোনও থ্রিলার সিনেমা হয়, ‘ব্যাকগ্রাউন্ডে’ ওই রক্তে ভেজা দৃশ্যটা আসতেই পারে। আক্রান্ত ব্যক্তিটি অবশ্য বেঁচে গিয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, আলিপুর চিড়িয়াখানার সেই কংগ্রেসি ইউনিয়ন নেতা রাকেশ সিংহই বন্দর বিধানসভায় জোটের প্রার্থী হয়ে বিদায়ী বিধায়ক তথা মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিমের অস্বস্তি কয়েক গুণ বাড়িয়েছেন। এমনিতেই বন্দরের অলিগলিতে শাসকদলের বিরুদ্ধে চোরাস্রোত। নারদ এসে জুড়ে বসেছে। ‘‘তার উপরে বেপাড়ার মাটিতে দাঁড়িয়ে নিজের খাসতালুকের পুরনো দুশমনের পাল্লা টানতে হলে কার ভাল লাগে?’’— হাসতে হাসতে বলছিলেন আলিপুরের এক তৃণমূল নেতা।

বস্তুত আলিপুর-চেতলার লোক— এই তকমাটা ববির গা থেকে খসেনি। বন্দরের জমিতে পা শক্ত করতে বহিরাগত ববি এখানে সন্ত্রাসের রাজ কায়েম করেছেন— এমন অভিযোগ মজুত দলের অন্দরেও। মন্ত্রীকে ঘিরে টানাপড়েনের চিত্রনাট্যে চরিত্রও অনেক— রামপিয়ারি রাম থেকে সামসুজ্জামান আনসারি, মুন্না ইকবাল থেকে রাকেশ সিংহ। মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠেরাই বলছেন, কোন সুতোয় টান মারতে গিয়ে কোন সুতো আলগা হয়ে যাবে, তার আন্দাজ পেতেই কালঘাম ছুটছে।

ববি অবশ্য এ সব ফুৎকারে ওড়াচ্ছেন। বলছেন, ‘‘আমার কোনও কাঁটা নেই। দলেও সকলে একজোট।’’ কিন্তু তাঁর দলের সূত্রই বলছে, ফিরহাদের ‘কাঁটা-তালিকা’য় প্রথম নামটি রাকেশের। আলিপুর হল গিয়ে ববির ডেরা। বাম জমানায় সেখান থেকে তিনি বিধানসভায় আসেন। তখন খাসতালুকেই প্রতি পদে তাঁকে বেগ দিয়ে গিয়েছেন রাকেশ। দু’পক্ষের দখলদারির টক্করে আলিপুরের হাওয়া হামেশা গরম হয়ে উঠত। পালাবদলের পরে রাকেশের নামে ভুয়ো মামলার স্রোত বইয়ে দেওয়া হয়েছে বলে ঘনিষ্ঠদের অভিযোগ।

সেই রাকেশ ভোটের প্রতিপক্ষ হতেই ওঁর গায়ে ‘গুন্ডা’র তকমা সেঁটে দিয়েছে ববি-বাহিনী। যা শুনে তৃণমূলের একাংশও মুচকি হাসছে। খিদিরপুরের এক নেতার কটাক্ষ, ‘‘রাকেশের নামে মামলা রয়েছে। তাই সে গুন্ডা। যার নামে মামলা নেই, সে সাধু।’’ কেউ কেউ বলছেন, গত পাঁচ বছরে বন্দরে ববির বহু চ্যালাচামুণ্ডার নামে কেস হয়েছে। মাথায় মন্ত্রীর ছাতা থাকায় কাউকে ধরা হয়নি। ‘‘প্রতাপ সাহা তো পুলিশ পিটিয়েও জামিন পেয়ে গিয়েছে। ববির আশপাশে অজস্র প্রতাপ। উনি গুন্ডাদের দাদা।’’— আক্ষেপ এক বাসিন্দার।

বন্দরবাসীর একাংশের মনে মন্ত্রীর এ হেন ভাবমূর্তির সঙ্গে সঙ্গত করছে নারদ-কাণ্ড। মন্ত্রীর প্রচারে যার ব্যাখ্যা না-পেয়ে জনমানসে বিভ্রান্তি বাড়ছে। বোঝার উপরে আঁটি হয়ে ঘাড়ে চেপে বসেছেন তৃণমূল নেতা রামপিয়ারি রাম, যাঁর ঝুলিতে কিনা ভাল পরিমাণ ভোট! সেগুলো ববির পক্ষে যাবে, তেমন গ্যারান্টি কেউ দিতে পারছেন না। দলীয় মহলের খবর: সাবেক কবিতীর্থ বিধানসভা কেন্দ্রের চার বারের কংগ্রেস বিধায়ক রামপিয়ারি গত পুরভোটের আগে তৃণমূলে যোগ দিলেও ফিরহাদের সঙ্গে সম্পর্ক সাপে-নেউলে। এমনকী, অন্তর্ঘাতের আশঙ্কায় তাঁকে বন্দর থেকে সরিয়ে ভবানীপুরের এক ওয়ার্ডের দায়িত্বে রাখা হয়েছে। গত পুরভোটে রাম ও তাঁর স্ত্রীকে তৃণমূলের টিকিট দেওয়া হয়েছিল। দু’টি আসনেই মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ গোঁজ দাঁড়িয়েছিল। রাম হারেননি বটে, তবে স্ত্রী হেমা হেরেছেন।

এমতাবস্থায় রামপিয়ারির মতিগতির হদিস পেতে ববি শিবির মরিয়া। তৃণমূলেরই এক নেতার পর্যবেক্ষণ, ‘‘বন্দরের সঙ্গে রামের নাড়ির যোগ। সব সম্প্রদায়ের কাছের মানুষ। ওঁকে লোকে ভোট দেয় ভয়ে নয়, ভক্তিতে।’’ কানাঘুষো, জোটের তরফে ইতিমধ্যে রামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। ববি-ক্যাম্পের যদিও সে মুখ নেই। তারা শুধু রামপিয়ারির গতিবিধি মেপে যাচ্ছে। ‘‘জোটের ভোটের সঙ্গে রামের ভোট এক হলে তৃণমূল হাওয়া হয়ে যাবে।’’— মন্তব্য এক সিপিএম নেতার। হিসেবও বলছে, গত লোকসভায় কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের পাওয়া ভোট জোট বাঁধলে এখানে শাসকদলের বিলক্ষণ বিপদ। সে বার তৃণমূল পেয়েছিল ৪৫ হাজার ভোট (৩৩%)। বিজেপি প্রায় ৪০ হাজার। অন্য দিকে কংগ্রেস ২৯ হাজার ও বামফ্রন্ট ১৭ হাজার। মানে, মোট ৪৬ হাজার (৩৪%)। এক কংগ্রেস নেতার দাবি, ‘‘রামের ভোট সব বিজেপি’র ঝুলিতেই গিয়েছিল।’’

ববির আর এক কাঁটা পুরসভার মেয়র পারিষদ সামসুজ্জমান আনসারি। দলের একাংশের অভিযোগ: পুরভোটে ববি-ঘনিষ্ঠ মুন্না ইকবালের কারসাজিতে পুত্রবধূ রুবিনা হেরে যাওয়া সামসুজ্জামান ববির থেকে মুখ ফিরিয়েছেন। ভোটের আগে দলের কোনও কর্মী সম্মেলনে আনসারিবাড়ির কাউকে চোখে পড়েনি। অথচ বেশ কিছু ওয়ার্ডে ওঁদের প্রভাব প্রশ্নাতীত।

পাশাপাশি মুন্না ইকবাল শিবিরও যে খুব তুষ্ট, তা হলফ করে বলা যাচ্ছে না। দলের আনাচে-আনাচে আক্ষেপ, আগের বার ১৩৪, ১৩৫ নম্বর ওয়ার্ডে মুন্নার হাত ধরেই জিতেছিলেন ববি। কিন্তু হরিমোহন কলেজে পুলিশ খুনের ঘটনায় মু্ন্না গ্রেফতার হওয়ার পরে তাঁর মেয়ে সাবা বহু বার ববির দরজায় কড়া নাড়লেও মন্ত্রী সাড়া দেননি। ‘‘বন্দরের লোক তখনই বুঝে গিয়েছে, বিপদে পড়লে ববিকে অন্তত পাশে পাওয়া যাবে না।’’— খেদ এক তৃণমূলকর্মীর।

এত ক্ষোভের কাঁটা উপড়ানোর হাকিমি দাওয়াই ঝুলিতে মজুত আছে কি না, সেটাই দেখার।

অন্য বিষয়গুলি:

Assembly Election 2016
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy