—ফাইল চিত্র।
ঘুটঘুটে অন্ধকার! রাস্তার ধারে একটা নির্মীয়মাণ বাড়ির খাঁচা শুধু ঠাওর করা যাচ্ছে। এই অন্ধকারের বুক চিরে পিছনে কংগ্রেসের কার্যালয় আবিষ্কার করতে কলম্বাসেরও নিশ্চয়ই সাহস লাগতো!
মোবাইলের আলোর ভরসায় ভিতরে পৌঁছলে অবশ্য ছিমছাম ব্যবস্থা। অ্যাসবেস্টসের ছাদের নীচে প্লাস্টিকের চেয়ার। ফ্লেক্স থেকে কাগজের পোস্টার, ভোটের অবধারিত কিছু অনুষঙ্গ লেগে আছে বাড়িটার সর্বত্র। প্রিন্টার ও ফোটোকপি মেশিন-সহ কম্পিউটার অনর্গল চিঠি ছাপানোর জন্য তৈরি। কোথায় পর্যবেক্ষক, কোন সভায় কে লোক আনবে— এ সব কেজো ফোন এসেই চলেছে অনবরত। রাত গড়াচ্ছে, বাইরে ঘন হচ্ছে অন্ধকার।
প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে হঠাৎই দরজায় এসে দাঁড়ালেন যিনি, তাঁর মুখ ওই অন্ধকারের মতোই কালো! নাকের উপরে চশমার দাগটা চেপে বসে, তার নীচে গভীর কালি জমেছে। মেদিনীপুরিয়া রোদ্দুরে পরিশ্রমের স্পষ্ট চিহ্ন সর্বাঙ্গে। গত কয়েক মাসে এই ডাক্তার ভদ্রলোকের সম্পর্কেই কয়েকটা মিথ উড়ে বেড়িয়েছে যথেচ্ছ। তাঁর তৃণমূলে যাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা! তিনি আসলে তৃণমূলকে ‘ম্যানেজ’ করে ভোটটা উতরোতে চাইছেন! বামেদের সঙ্গেও জোট হলেও তিনি বিদ্রোহ করবেন! ইত্যাদি, ইত্যাদি।
বিগত লোকসভা ভোটের অঙ্ক বলছে, বাম আর কংগ্রেসের জোট যদি গোটা রাজ্যে শুধু একটা আসনেই জেতে, তার নাম সবং! এত দিনের চেনা ঘাঁটি, প্রায় নিজের নামে ভোটব্যাঙ্ক। তা হলে আবার এত পরিশ্রম কেন করতে হচ্ছে মানস ভুঁইয়াকে? টেবিলের উপরে এ বার সজোর আছড়ে পড়ল আংটি-বোঝাই একটা হাত! ‘‘ঘরে বসে কি ভোট হয়? আমার লোকের দরজাতেই আমাকে যেতে হবে। বলতে হবে, আয় বাবু ভোটটা দে! তবে তো ভোট!’’ উত্তর দিলেন কন্দর্পনারায়ণ ভুঁইয়ার বংশধর। বারো ভুঁইয়ার এক ভুঁইয়া!
আসলে এটা অবশ্য কোনও উত্তরই নয়! উত্তর তিনি দিতে চাইছেন দলের ভিতরে-বাইরে বারো ভূতে বলে বেড়ানো হরেক তত্ত্বকে। পণ করেছেন, জোট কাকে বলে, তিনিই দেখিয়ে ছাড়বেন! প্রথম আলোচনা শুরু হওয়ার পরে প্রদেশ কংগ্রেসের মধ্যে তিনি ছিলেন ‘একলা চলো’র প্রবল প্রবক্তা। কিন্তু রাহুল গাঁধী এক বার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়ার পরে টানা সবংয়ে পড়ে থেকে দলের কর্মীদের নিয়ে সাধারণ সভা করে করে জোটের গুরুত্ব বুঝিয়েছেন। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা কংগ্রেসের সভাপতি, সহোদর বিকাশ ভুঁইয়াকে দিয়ে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রকে সংবর্ধনা দিয়ে এবং মিছিল করিয়ে জোটের যৌথ প্রচারের প্রথম বিউগল তিনিই বাজিয়েছেন। কাস্তে-হাতুড়ি আঁকা লাল টুকটুকে ছাতার নীচে দিব্যি হাঁটছেন! নিজের সবংয়ে সূর্যবাবুকে এনে সভা করাচ্ছেন। পাশের নারায়ণগড়ে গিয়ে সিপিএম প্রার্থী সূর্যবাবুকে জোটের কাণ্ডারীর অভিধা দিয়ে আসছেন। লোকে বলছে, সে দিন সূর্যবাবুকে পেয়ে এমন জড়িয়ে ধরিয়েছিলেন, দীর্ঘ অদেখার পরে প্রেমিকাকে পেয়ে উঠতি যুবকেরাও তেমন আলিঙ্গনে সঙ্কোচ পেতে পারে!
মানসবাবু হাসছেন! বলছেন, ‘‘ভালবাসলে জান-প্রাণ দিয়ে ভালবাসতে হবে। এক হাত পিঠে রাখব আর অন্য হাতে ছুরি মারব, এ শিক্ষা আমি জীবনে পাইনি!’’ আরও মানছেন, ‘‘কংগ্রেসের জন্য সিপিএম যে ভাবে মাঠে নেমেছে, এমন জিনিস ৪৬ বছরের রাজনৈতিক জীবনে দেখিনি!’’
মানসবাবুর এই ভালবাসাই এ বারের ভোটে মস্ত চর্চার বিষয়! স্থানীয় কর্মী বাদলের যে বাড়ি এখন তাঁর ঠিকানা, তার অদূরেই তৃণমূল দেওয়ালে লিখে দিয়েছে, ‘বাঁচাও কে আছো, মরেছি যে সিপিএমের সঙ্গে প্রেম করে’! সঙ্গে যে দৃশ্যের ছবি, তার কথা টেনে আনতে ছাড়ছেন না স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তৃণমূল নেত্রীর কথায়, ‘‘সবংবাবু আর সূর্যবাবু এখন খুব বন্ধু! মঙ্গলকোটে সে দিন (ধান্যরুখি গ্রামে, ২০০০৯ সালে) তো ধুতি তুলে দৌড়েছিলেন আর বুদ্ধবাবু বাঁচান, বুদ্ধবাবু বাঁচান বলে চিৎকার করেছিলেন! এখন প্রেম জেগে উঠল?’’ এই নব্য প্রেম নিয়েই প্রচার চালাচ্ছেন তৃণমূল প্রার্থী নির্মল ঘোষও। তিনি অবশ্য নামেই প্রার্থী। তৃণমূলের যুবরাজ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলে গিয়েছেন, ‘‘ভোটটা মমতাকেই দেবেন।’’
এই প্রেমের ধাক্কায় সবংয়ের বাকি সব এখন ধামাচাপা! সজনীকান্ত কলেজের নিহত ছাত্র পরিষদ কর্মী কৃষ্ণপ্রসাদ জানার পরিবার ভোটের মুখে তৃণমূলের মিছিলে হাঁটছে। বাজারে-দোকানে হঠাৎ নাকি টাকা বিলি শুরু হয়েছে, যেগুলোর বেশির ভাগই জাল নোট বলে অভিযোগ! নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরেও ভারতী ঘোষ জেলায় ঢুকে সবং, নারায়ণগড় নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন বলে অভিযোগ। কিন্তু এ সবে আমল দিচ্ছে না কেউ। গ্রামীণ হাসপাতালের কাছে দোকানদার স্বপন দাস বলেই দিলেন, ‘‘চেষ্টা অনেক রকম হবে। কিন্তু মানসদা’ই জিতবে গো!’’
এই সহজ কথাটা রাজনীতির ব্যাখ্যায় ভাঙছেন বিকাশবাবু। জেলা কংগ্রেস সভাপতির বক্তব্য, ‘‘জেতা নিয়ে সংশয় নেই। কিন্তু এত দিন সিপিএমের সঙ্গে আমাদের ছেলেদের লড়াই ছিল তো। এখন সিপিএমের ভোট পুরোটা কাছে টানতে দাদা যত পারছে, ছুটছে।’’
স্বাভাবিক! ঘৃণার অন্ধকার থেকে প্রেমের আলোয় ফিরতে এটুকু তো করতেই হবে। তাতে ক’দিনের জন্য মুখ পোড়ানো আর কী এমন মাসুল!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy