Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪

গালে পান, মুখে কথার তোড়, পদ্মমালায় লকেট

ছোট্ট ছেলেটা মুড়ির ঠোঙা হাতে বহু দূর থেকে দৌড়ে আসছিল। তাদের এঁদো গ্রামে কয়েক বছর অন্তর এই সব দিনগুলোতে গাড়ির ভিড় বাড়ে। ঝকঝকে জামাকাপড় পরা লোকেরা তার উদোম গায়ের বাবা আর শতচ্ছিন্ন শাড়ি পরা মায়ের সঙ্গেও হাত জো়ড় করে কথা বলে! ছেলেটা তাই হাঁফাতে হাঁফাতে দৌড়ে আসছিল। এ সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়?

এগিয়ে আসা মুড়ির ঠোঙায় ভাগ বসালেন হাসিমুখে। বাজিতপুরে লকেট চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম।

এগিয়ে আসা মুড়ির ঠোঙায় ভাগ বসালেন হাসিমুখে। বাজিতপুরে লকেট চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম।

সোমা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৪৪
Share: Save:

ছোট্ট ছেলেটা মুড়ির ঠোঙা হাতে বহু দূর থেকে দৌড়ে আসছিল। তাদের এঁদো গ্রামে কয়েক বছর অন্তর এই সব দিনগুলোতে গাড়ির ভিড় বাড়ে। ঝকঝকে জামাকাপড় পরা লোকেরা তার উদোম গায়ের বাবা আর শতচ্ছিন্ন শাড়ি পরা মায়ের সঙ্গেও হাত জো়ড় করে কথা বলে! ছেলেটা তাই হাঁফাতে হাঁফাতে দৌড়ে আসছিল। এ সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়?

তার দৌড় দেখে পেঁয়াজ রঙা সুতির শাড়ি আর লাল বড় টিপের মহিলা থমকালেন। হাত রাখলেন কাঁধে। আর ছেলেটাকে চমকে দিয়ে তার ঠোঙা থেকে এক মুঠো মুড়িও তুলে খেলেন। চার দিকে তখন তাঁকে ঘিরে তৈরি হচ্ছে ভিড়ের বৃত্ত। এরই মধ্যে কেউ এক জন দৌড়ে এসে একটা পদ্মফুলের মালা পরিয়ে দিল তাঁর গলায়। হেসে লকেট চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘‘শুধু মালা পরালে চলবে না। পদ্মফুলে ভোটটাও দিতে হবে। মনে থাকবে তো?’’ ভিড়ের মধ্যে তখন গুনগুন শুরু হয়েছে। মাঝবয়সী এক মহিলা এগিয়ে এসে বললেন, ‘‘তোমায় ভোট দিলে কী দিবে

তুমি? মোবাইল দিবে? ভাল শাড়ি দিবে?’’ এক মুহূর্তও সময় না নিয়ে লকেট বললেন, ‘‘সম্মান দেব। নিরাপত্তা দেব। জেনে রাখুন, মোবাইলের চেয়ে ওগুলো অনেক বেশি দামি।’’

সাত মাস রাজ্য মহিলা কমিশনের সদস্য ছিলেন। কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায়ের অন্যতম আস্থাভাজন লকেট রাজ্যের জেলায় জেলায় বিভিন্ন ঘটনায় নির্যাতিতা মহিলাদের কাছে পৌঁছে যেতেন সেই সময়ে। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এ বার বীরভূমের মতো জেলায়, যেখানে সাম্প্রতিক অতীতে পরপর বেশ কয়েকটি নারী নির্যাতনের ঘটনা খবরের শিরোনামে এসেছে, সেখানে মেয়েদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতিকেই বড় করে তুলে ধরতে চাইছেন ময়ূরেশ্বর বিধানসভা কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী। বহু এলাকাতেই মহিলারা তাঁকে ঘিরে ধরে বলছেন, ‘‘মেয়েদের সমস্যা তো মেয়েরাই বোঝে। আমরা জানি, তুমিই বুঝবে।’’

কলকাতা থেকে একেবারে উপড়ে বীরভূমের গ্রামে গিয়ে পড়া লকেট নিজে জানেন, তাঁর লড়াইটা সহজ নয়। সেটা এই কারণে নয় যে তাঁর বিরুদ্ধের প্রার্থীরা খুব শক্তিশালী। কারণটা খানিকটা লুকিয়ে রয়েছে, প্রথমত তাঁর সেলিব্রিটি পরিচয়ে। আর দ্বিতীয়ত, তাঁর নিজের দলের অন্দরের লড়াইয়ে।

সেলিব্রিটি তকমাটা ঝেড়ে ফেলতে মরিয়া অভিনেত্রী তাই উদয়াস্ত খাটছেন। সেলিব্রিটি সুলভ সাজগোজ, ঘড়ি ধরে খাওয়াদাওয়া, ত্বকের যত্ন— সব কিছুই বরবাদ। কোনও হোটেল বা গেস্টহাউসেও ওঠেননি। ময়ূরেশ্বরের পাথাই গ্রামে অভিনেতা খরাজ মুখোপাধ্যায়ের আদি বাড়ি। আপাতত সেটাই লকেটের আস্তানা। গ্রামে ভোল্টেজ কম। সন্ধ্যা হতে না হতেই আলো নিভে যায়। পাখাও চলে না। একটা এসি কেনা হয়েছে ঠিকই। কিন্তু জেনারেটর গড়বড় হয়ে প্রায় দিনই সেটাও ভোগাচ্ছে।

সকাল আটটা বাজার কিছু আগে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে দেখা গেল, তার মধ্যেই স্নান করে শাড়ি-টাড়ি পরে এক্কেবারে তৈরি তিনি। ব্রেকফাস্টে মুড়ি ভিজিয়ে খাচ্ছেন। এর পর সুযোগ পেলেই ডাবের জল। সম্ভব হলে একাধিক বার। দুপুরে ভাত, পোস্ত, মাছের টক। রাতে পোস্তবাটা দিয়ে ভাত। দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় আর একটা জিনিসও রয়েছে। ২০০৯ সালে হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। তার পর থেকে প্রতিদিন হার্টের ওষুধ ‘মাস্ট’!

সুতির শাড়ির স্টক বাড়িয়েছেন?

‘‘আমি সব সময়েই সুতির শাড়ি পরি। তাই আলাদা করে শাড়ি কেনার দরকার পড়েনি’’, হাসতে হাসতে বললেন লকেট। তাঁর গাড়ির পিছনের সিটটা বাঁধা থাকে এক জনের জন্য। তাঁর নাম ঊষা। লকেটের কলকাতার বাড়িতে তিনিই সংসার দেখভাল করেন। আবার শ্যুটিংয়ে, ভোটের প্রচারেও ঊষাদিকে না হলে চলে না তাঁর। গাড়ি ছুটছে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামের দিকে। ঊষাদি পানের ডিবে খুলে পান নিয়ে সামান্য সুপুরি, চবন বাহার আর মিষ্টি মশলা ভরে এগিয়ে দিচ্ছেন তাঁর দিকে।

পানের নেশা কবে থেকে? হেসে ফেলেন লকেট। ‘‘আরে আমি পান খেতামই না। এখানে আসার পর থেকে ঊষাদি দিচ্ছে।’’ পিছন থেকে ঊষাদি বলে উঠলেন, ‘‘মুখে রুচিটা ফেরাতে হবে তো! কিছুই তো খেতে চায় না। একটু পান খেলে জিভের আড় ভাঙবে।’’ শুধু কি স্বাদের আড়? জনসভায় একের পর এক বক্তৃতা দিয়ে দিয়ে কথার আড়ও ভেঙে গিয়েছে তাঁর। দ্রুততার সঙ্গে এক প্রসঙ্গ থেকে চলে যাচ্ছেন অন্য প্রসঙ্গে। মেয়েদের সম্মান থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজের অভাব, রাস্তার দুরবস্থা, সেতুর অভাবে নদী পারাপারের সমস্যা, শৌচাগার— সবই ঘুরে ফিরে আসছে বক্তৃতায়।

পুরনো প্রার্থীকে টিকিট না দিয়ে নতুন প্রার্থী আনায় ওই কেন্দ্রে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে। গত নভেম্বরে প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক, প্রবীণ নেতা ধীরেন লেটকে ওই ময়ূরেশ্বরেই তৃণমূল কর্মীরা প্রকাশ্যে কান ধরতে বাধ্য করেছিলেন। সেই ঘটনার তিক্ততার রেশও আম জনতার মন থেকে এখনও মোছেনি। তৃণমূল প্রার্থী অভিজিৎ রায় তাই খানিকটা ব্যাকফুটেই রয়েছেন। তুলনায় সিপিএমের গ্রহণযোগ্যতা এলাকায় কিছুটা বেশি। সেই কারণেই ওই কেন্দ্রে প্রার্থী হিসেবে নতুন হয়েও সিপিএমের অরূপ বাগ অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। তাঁর কথায়, ‘‘তৃণমূলকে এখানে কেউ বিশ্বাস করে না।

আর লকেট তো সেলিব্রিটি। পরিযায়ী পাখি। ভোট হওয়ার পর উড়ে যাবে। থাকব আমরাই।’’

সেলিব্রিটিসুলভ দূরত্ব ঘুচিয়ে ফেলতে সক্ষম হলেও বিজেপির অন্দরের কোঁদল তাঁকে বিপদে ফেলবে না তো? যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বিজেপিকে এ রাজ্যে অনেকটাই কোণঠাসা করেছে নানা সময়ে, সেই কাঁটা ময়ূরেশ্বরেও মাঝেমধ্যেই বিঁধছে। ওই কেন্দ্রের প্রাক্তন বিজেপি প্রার্থী তথা জেলার প্রাক্তন সভাপতি দুধকুমার মণ্ডলের সঙ্গে বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বের

বিবাদ এখনও থামেনি। দুধকুমার আক্ষেপ করেছেন, ‘‘আমার দুর্দিনে রাজ্যে কেউ আমার হয়ে একটা কথাও বলেনি। লকেটও নয়। কারও আমার পাশে দাঁড়ানোর দম ছিল না। তবে আমি সে সব মনে রাখিনি।’’

দুধকুমার এ বার টিকিট পেয়েছেন রামপুরহাটে। এত দিনের জমি ময়ূরেশ্বর হাতছাড়া হল কেন? দুধকুমারের জবাব, ‘‘হাতছাড়া হয়েছে কে বলল? ওই এলাকাটা এখনও আমারই। লকেট জিতলেও ওখানকার মানুষ আমাকেই মানবেন।’’

রাজনীতিতে নতুন বলে তিনি কি কারও হাতের পুতুল হয়ে থাকবেন? প্রশ্নটা শুনে উত্তেজিত হয়ে ওঠাটাই স্বাভাবিক ছিল। লকেট কিন্তু হলেন না। হেসে বললেন, ‘‘উনি নিশ্চয় বিষয়টা এ ভাবে বলতে চাননি। আমাকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা জানেন নিজের কাজের প্রতি আমি কতটা সিরিয়াস।’’

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 BJP Locket
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy