Advertisement
E-Paper

বনধের মতো ব্রিগেডও কি এখন বন্ধ্যা হাতিয়ার, এত অর্থ, এত শক্তিক্ষয়ে লোক দেখানোই সার?

লোকসভা ভোটে সিপিএম-এর ভোট কোনও রকমে ৬ শতাংশ পেরিয়েছিল। নতুন এই সময়ে এই এলাহি ব্রিগেড আয়োজনকে কিন্তু ‘অহেতুক’ মনে করছেন অনেকেই।

রবিবার বাম-কংগ্রেসের ব্রিগেড।

রবিবার বাম-কংগ্রেসের ব্রিগেড। ছবি—পিটিআই।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২১:৩৪
Share
Save

ব্রিগেডে মিটিং হবে, লক্ষ লক্ষ মাথা। এই এক কলিতেই কি সিপিএম-এর ব্রিগেড মোহ আটকে? ভোট প্রাপ্তির হারে, শক্তির ভারে দল যতই ক্ষয়িষ্ণু হোক, ব্রিগেড সমাবেশ আয়োজনের পরম্পরাকে মাথায় করেই রাখতে চায় বামেদের বড় দাদা। এত খরচ, এত পরিশ্রম এবং এত লোকের ব্রিগেডের পরেও, গত লোকসভা ভোটে সিপিএম-এর ভোট কোনও রকমে ৬ শতাংশ পেরিয়েছিল। নতুন এই সময়ে এই এলাহি ব্রিগেড আয়োজনকে কিন্তু ‘অহেতুক’ মনে করছেন অনেকেই।

আবাল্য সিপিএম কর্মী হুগলির উত্তরপাড়ার বাসিন্দা জ্যোতিপ্রসাদ বসু রবিবারও এসেছিলেন ব্রিগেড সমাবেশে। বাড়ি ফেরার পথে কথা বললেন আনন্দবাজার ডিজিটালের সঙ্গে। বললেন, ‘‘ভাল লাগে। এত মানুষের মাঝখানে দাঁড়াতে ভাল লাগে। কোনও দিন মিস করিনি। নিজের পাড়ায় এখন আর পার্টিটা করতে পারি না। লোকবল কম। কিন্তু কেন্দ্রীয় কর্মসূচি হলে অনেকের মাঝে হেঁটে মনোবল বাড়ে।’’ এখানেই কি তবে ব্রিগেড সমাবেশের সাফল্য? সমর্থন করলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার। বললেন, ‘‘ব্রিগেড সমাবেশ মানে কিছুটা নস্টালজিয়া। আর বেশিটাই শক্তি প্রদর্শনের লক্ষ্য। আমার সঙ্গে এত মানুষ রয়েছে এটা বোঝানো। আমার মনে হয় না এখন এ সবের কোন প্রভাব ভোটে পড়ে। মানুষ ঠিক করে রাখেন কাকে ভোট দেবেন। কে কী বললেন সেটা শোনেন কিন্তু মানেন না। তবে এটা ঠিক যে, এখনও মানুষ খোঁজ নেন কার জনসভায় কত লোক হল!’’

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সৌরভ মজুমদার নিজেকে বাম কর্মী হিসেবে দাবি করেন। ফেসবুকে সক্রিয় সৌরভ আসেননি ব্রিগেড সমাবেশে। বললেন, ‘‘বাড়িতে বসেই শুনলাম সব। আর এটাও দেখলাম যে বয়স্করা যেটা বললেন তাতে ভোট টানা যাবে না। মানুষের মন বুঝতে পারছেন না তাঁরা। যুবরা কী শুনতে চায় সেটা কারও বক্তব্যেই শুনতে পারলাম মা। সবাই কতটা ভিড় হয়েছে সেটা বোঝাতে চাইলেন।’’

চারদিনের প্লেনারি সেশন শেষে ১৯৮৩ সালে ব্রিগেডে বক্তৃতা দিচ্ছেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী।

চারদিনের প্লেনারি সেশন শেষে ১৯৮৩ সালে ব্রিগেডে বক্তৃতা দিচ্ছেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী। আনন্দবাজার আর্কাইভ।

সৌরভের কথাটা যে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয় সেটা বোঝা গিয়েছে শুরু থেকে শেষ সব বক্তার কথায়। বিমান বসু থেকে অধীর চৌধুরী সবার কথায় রবিবার শোনা গেল ‘ঐতিহাসিক ভিড়’, ‘অভূতপূর্ব ভিড়’, ‘জনসমুদ্র’ ইত্যাদি ইত্যাদি। ভিড় দেখানোই যে বড় কথা সেটা স্পষ্ট করলেন বিমান। বললেন, ‘‘যাঁরা বলেন বামেদের দূরবীন ছাড়া দেখাই যায় না, তাঁরা এসে দেখে যান আজকের সমাবেশ।’’ আর অধীরের কথায় তিনি অতীতে কখনও এত বড় সমাবেশে বক্তব্যই রাখেননি। ভিড় নিয়ে উল্টো কথা শোনালেন কবি মৃদুল দাশগুপ্ত। বললেন, ‘‘আমি জনস্রোতের বিষয়টা ঠিক বুঝি না। ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’ দেখতে অনেকে যান কিন্তু ‘পথের পাঁচালি’ তত দর্শক পায় না। সুতরাং, ভিড় দিয়ে কোনও কিছু যাচাই করা যায় না।’’

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সৌরভের কথারই যেন ছায়া গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অচিন্ত্য বিশ্বাসের গলায়। তিনি বললেন, ‘‘এখনকার সময়ে ব্রিগেডে মাঠ ভরানোর এত ঝক্কির কোনও অর্থ হয় না। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে অনেক কম আয়াসে অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়া যায়। সেটাই করা উচিত। আমার মনে হয়, রাজনৈতিক বার্তা পৌঁছে দিতে বেশি কার্যকর ছোট ছোট সভা।’’ তবে বড় জনসভার গুরুত্ব কমে যাওয়া কিংবা সোশ্যাল মিডিয়াকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কথা একেবারেই মানতে নারাজ সিপিএম নেতা রবীন দেব। তিনি বলেন, ‘‘ওগুলো শুষ্ক। ক্ষণস্থায়ী। জনসংযোগের উন্নত প্রযুক্তি হতে পারে, কিন্তু জনসভার একটা অনুরণন থেকে যায়। এতগুলো মানুষ এক জায়গায় জড়ো হওয়া, তার যে উষ্ণতা, উত্তাপ তা সোশ্যাল মিডিয়ায় যত ভাল পোস্টই হোক সেটা দিয়ে সম্ভব নয়। মানুষের মুখোমুখি হওয়ার গুরুত্বই আলাদা।’’ সিপিএম-এর শক্তি দিন দিন কমছে। কেন্দ্রীয় কর্মসূচিতে ভিড় হলেও বুথ স্তরে তার প্রভাব নেই। এই প্রসঙ্গে রবীনের বক্তব্য, ‘‘ওই কথাটাই তো মহম্মদ সেলিম বললেন। ব্রিগেডে বুথ থেকে মানুষ এসেছেন। সেখান থেকে উত্তাপ, উন্মাদনা, বার্তা নিয়ে নিয়ে তাঁরা ফিরে যাবেন বুথে। এর পরে সেটার প্রতিফলন নিয়ে যেতে হবে ইভিএম-এ।’’

১৯৯২ সালে যুব কংগ্রেসের সভায় ব্রিগেডে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সোমেন মিত্র।

১৯৯২ সালে যুব কংগ্রেসের সভায় ব্রিগেডে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সোমেন মিত্র। আনন্দবাজার আর্কাইভ।

শুধু সিপিএম বা বামেরাই নয়, ব্রিগেডে বড় সমাবেশ করে শক্তি প্রদর্শনের নজির রেখেছে অন্য রাজনৈতিক দলও। চলতি মাসেই রাজ্য এসে অমিত শাহ বাংলার বিজেপি নেতাদের বেশি করে ছোট ছোট সভা আয়োজনের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু আগামী ৭ মার্চই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে এনে ব্রিগেড সমাবেশ করছে বিজেপি। গত লোকসভা নির্বাচনের প্রচারেও মোদীর ব্রিগেড সমাবেশ হয়েছে। এর আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ব্রিগেডে বড় সমাবেশ করেছেন। ২০১১ সালে মহাকরণ দখলের পরে ২১ জুলাইয়ের সমাবেশই হয়েছিল ব্রিগেডে। তার অনেক আগে ১৯৯২ সালের ২৫ নভেম্বর প্রথম ব্রিগেড সমাবেশ হয়েছিল মমতার। সেই দিনের কথা মনে করে প্রবীণ তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়ের বক্তব্য, ‘‘একক চেষ্টায় মমতা যে সমাবেশ করে দেখিয়েছেন তার ধারেকাছেও কেউ নেই। বিরোধী থাকার সময়েই তিনি সেটা করে দেখিয়েছেন।’’ শক্তি প্রদর্শনের জন্য ‘ব্রিগেড সমাবেশ’-এর মতো আয়োজন জরুরি বলেও মনে করেন তিনি। বলেন, ‘‘একটা সময় সিপিএম-এর সমাবেশে লোক আনার জন্য বিখ্যাত ছিলেন প্রয়াত সুভাষ চক্রবর্তী। এখন সিপিএমের সুভাষ হয়েছেন আব্বাস সিদ্দিকি। তিনিই মূলত দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে অনেক লোক এনেছেন।’’ রবিবার ব্রিগেডের মঞ্চে আব্বাসও তোলেন ভিড় প্রসঙ্গ। বলেন, ‘‘দু’দিনের চেষ্টায় এত লোক। আরও এক সপ্তাহ আগে জোট চূড়ান্ত হলে এর দ্বিগুণ ভিড় করে দিতাম।’’

ব্রিগেড এখন ‘অসফল’ অস্ত্র কিনা প্রশ্নে আলোচনা করতে গেলে অবশ্য অনেক ইতিহাসের কথাও মনে রাখতেই হয়। ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি সদ্য বাংলাদেশ গঠনের পরে বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানকে নিয়ে সমাবেশ করেন ইন্দিরা গাঁধী। এরও আগে ১৯৫৫ সালে তৎকালীন সোভিয়েত উইনিয়নের দুই শীর্ষ নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ এবং নিকোলাই বুলগানিনকে নিয়ে ব্রিগেডে জনসভার আয়োজন করেছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার।

২০১৪ সালে ব্রিগেডে নরেন্দ্র মোদীর জনসভা।

২০১৪ সালে ব্রিগেডে নরেন্দ্র মোদীর জনসভা। আনন্দবাজার আর্কাইভ।

ভার্চুয়াল মাধ্যমের জনপ্রিয়তা যে ভাবে বাড়ছে তাতে আগামী দিনেও কি ব্রিগেড সমাবেশের এই টান থেকে যাবে বাংলার রাজনীতিতে? আর কেউ না মনে না করলেও নিশ্চিত রবীন দেব। তিনি বলেন, ‘‘সরাসরি যোগাযোগটাই এমন সমাবেশের আসল কথা। সামনাসামনি কথায় হৃদ্যতা তৈরি হয়, চোখে চো‌খ রেখে কথা হয় সেগুলো স্থায়ী হয়। বাকিটা তাড়াতাড়ি মুছে যায়। আমাদের পছন্দের একটা গান আছে— ‘আমরা নই একা, আমরা নই একা, আমরা নই একা আজ আর...’। সেটাই তৈরি করে এমন সমাবেশ। আজ থেকে ২৫ বছর পরে এটা বজায় থাকবে কি না জানি না কিন্তু মানুষের মাঝে যাওয়ার চেষ্টা জারি রাখতে হবে।’’

কিন্তু কী বলছেন রবিবারও যাঁরা ব্রিগেডে এলেন এবং নেতাদের কথা শুনলেন তাঁরা? ফিরে শুনি উত্তরপাড়ার বাসিন্দা জ্যোতিপ্রসাদের কথা। বললেন, ‘‘মঞ্চে অনেক নতুন মুখ দেখলাম। এঁরা আমাদের নন। অনেককে চিনিও না। কথার পাহাড়। কিন্তু কী হবে এত শুনে! নিজের এলাকায় যদি বলতেই না পারি?’’ তবে এলেন কেন? আসেন কেন? ‘‘অভ্যাস। ব্রিগেডের একটা টান আছে।’’

Left Congress Alliance West Bengal Assembly Election 2021 Brigade Kolkata Brigade CPM Brigade Rally

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।