সভার ফাঁকেই চলছে আলোচনা। শুক্রবার লালগড়ে। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।
হুঁশিয়ারির বার্তাটা একই। তবে ভোট যত এগিয়ে আসছে, সেই হুঁশিয়ারিকে নানা স্তরে ছড়িয়ে দিচ্ছে শাসক দল। বাদ যাচ্ছেন না ভোট-পর্বের দায়িত্বে থাকা আধিকারিকরাও। নির্বাচন কমিশনের হয়ে ‘বেশি কাজ দেখানোর’ নালিশ পেলেই সংশ্লিষ্ট অফিসারদের ‘চিনে রাখা’র বার্তা দেওয়া হচ্ছে! ঠিক প্রকাশ্যে নয়। অভিযোগ, খানিক গোপনে তলায় তলায় দলীয় নেতা-কর্মীদের এই ‘কর্তব্য’টি বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে দলের একেবারে শীর্ষ স্তর থেকে।
হুঁশিয়ারির তালিকাটা শুরু হয়েছিল ভোটারদের দিয়ে। ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার পরেই এক বৈদ্যুতিন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে খোদ মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় বাহিনী তো তিন দিনের জন্য। ভোটটা হয়ে গেলে চলে যাবে। তার পর তো আমাদেরই দেখতে হবে!’’ এ কথার মধ্যে রাজ্যবাসীর প্রতি এক ধরনের হুমকি প্রচ্ছন্ন রয়েছে বলেই অভিযোগ তোলেন বিরোধীরা।
নির্বাচন কমিশনের প্রতি আক্রমণটা অবশ্য প্রচ্ছন্ন থাকেনি। বস্তুত বাম আমলে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার সুষ্ঠু ভোটের দাবিতে নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হতেন, ক্ষমতায় আসার পর থেকে সেই তিনিই নির্বাচন কমিশনকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলেছেন! ২০১৩ সালে পঞ্চায়েত ভোটের সময় রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে, পরের বছর লোকসভা ভোটে জাতীয় নির্বাচন কমিশনকে লাগাতার বিঁধে প্রচার করেছেন মমতা। এ বারও তার অন্যথা হচ্ছে না। নির্বাচন কমিশন যখনই কোনও কড়া নজরদারির রাস্তা নিচ্ছে, দলদাসত্বের অভিযোগ ওঠা সরকারি অফিসারদের সরাচ্ছে, মমতা এবং তাঁর দল কমিশনের বিরুদ্ধে গলা চড়াচ্ছেন। শুক্রবারও লালগড় ও
গোয়ালতোড়ের সভায় কমিশনের বিরুদ্ধে সরব হন মমতা। বলেন, “কেউ কেউ নির্বাচনের সময় এসে ধমকায়-চমকায়। ওরা আজকে এসেছে, তিন দিন বাদে চলে যাবে। ভোটের পরে রাজ্যের হাতেই আইনশৃঙ্খলা থাকবে। চিন্তার কোনও কারণ নেই।’’
সেই সঙ্গে শুক্রবারই দলীয় নেতৃত্বের তরফে কমিশনের হয়ে ‘কাজ দেখানো’ অফিসারদের ‘চিহ্নিত’ করে রাখার নির্দেশও আসে। তৃণমূল সূত্রের খবর, এ দিন বিকেলে মেদিনীপুরে পদযাত্রার ফাঁকে খড়্গপুর গ্রামীণের প্রার্থী তথা দলের জেলা সভাপতি দীনেন রায়, নারায়ণগড়ের প্রার্থী তথা দলের জেলা কার্যকরী সভাপতি প্রদ্যোৎ ঘোষ, গোপীবল্লভপুরের প্রার্থী তথা দলের ঝাড়গ্রাম জেলা সভাপতি চূড়ামণি মাহাতো কমিশনের কড়াকড়ি নিয়ে নেত্রীর কাছে নালিশ করেন। অভিযোগ, এর পরই ‘সক্রিয়’ অফিসারদের ‘চিনে রাখা’র প্রসঙ্গটি ওঠে। ভোট মিটলে ওই সব অফিসারদের ‘দেখে নেওয়া’র কথাও জানানো হয় বলে তৃণমূলেরই একাংশ জানাচ্ছে।
নেত্রী কি নিজেই এমন কথা বলেছেন?
জেলা নেতারা প্রকাশ্যে তা মানছেন না। তবে প্রদ্যোৎবাবু বলেন, ‘‘নেত্রী খুঁটিনাটি সব কিছুর উপর নজর রাখতে বলেছেন।’’ তৃণমূলের জেলা সভাপতি দীনেনবাবুর বক্তব্য, “কমিশনের কাজ করতে গিয়ে কেউ কেউ বাড়াবাড়ি করছেন। যা জানানোর নেত্রীকে জানিয়েছি।” আর চূড়ামণিবাবুর মন্তব্য, “নেত্রী বলেছেন, যা হবে দেখে নেবেন।”
সরাসরি ভোট-আধিকারিকদের এ ভাবে হুঁশিয়ারি দেওয়ার খবরে বিরোধী শিবির রীতিমতো উদ্বিগ্ন। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, ‘‘উনি (মমতা) এত দিন প্রকাশ্যে বিডিওদের কড়কাতেন। পুলিশ অফিসারদের ধমকাতেন। এ বার ভোটের কাজে যুক্ত সরকারি আধিকারিকদের হুমকি দেওয়া শুরু করলেন। নির্বাচন কমিশনকে বলব, অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। আধিকারিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক।’’
বিরোধীরা অবশ্য আর একটা সম্ভাবনার কথাও উল্লেখ করছেন। দু’দফায় মোট ৩৮ জন অফিসারকে এ পর্যন্ত সরিয়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। প্রতিক্রিয়ায় মুখ্যমন্ত্রী প্রথম দিনই পাল্টা বলেছিলেন, ‘‘যে অফিসাররা আসবেন, তাঁরাও তো আমাদেরই অফিসার!’’ সেই কথার মধ্যেও একাধারে সাবধানবাণী এবং প্রশাসনের রাজনীতিকরণের ইঙ্গিত নিহিত ছিল বলে অভিযোগ ওঠে। কিন্তু এখন যখন অফিসারদের ‘চিহ্নিত’ করার প্রয়োজন হচ্ছে, তার মানে শাসক দল ভিতরে ভিতরে চাপে রয়েছে— এমনটাই মনে করছেন বিরোধীরা। বাম-কংগ্রেস জোট তাদের দুশ্চিন্তা আরও বাড়াচ্ছে। কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘এই পরিস্থিতিতে দলকে জেতাতে মরিয়া হয়েই উনি (মমতা) প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন।’’
বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের দাবি, ‘‘প্রশাসনের কেউ ন্যূনতম নিরপেক্ষ আচরণ করলেও শাসক দল খড়্গহস্ত হচ্ছে।’’ এই অভিযোগ স্বাভাবিক ভাবেই মানছে না তৃণমূল। দীনেনবাবু যেমন দাবি করেন, ‘‘নেত্রী মোটেই এমন (চিনে রাখার) কথা বলেননি। এ সবই সংবাদমাধ্যমের অপপ্রচার!’’
কিন্তু বিরোধীরা মনে করাচ্ছেন, শীর্ষ নেতৃত্বের অনুমোদন পেয়েই তো গায়ের জোরে ভোট করানোর কথা প্রকাশ্যে বলে চলেছেন দলের নেতারা। বীরভূমে অনুব্রত মণ্ডল স্বমহিমায় প্রচারে নেমেছেন। আগের দিনই এক কর্মিসভায় তিনি বলেন, ‘‘...আপনারা পুরসভায় ভোট করেছেন, পঞ্চায়েত ভোট করেছেন। তার কৌশল জানেন। কোনও চিন্তা করবেন না!’’ বিরোধী নেতাদের অভিযোগ, এটা
কেষ্টর একার কথা নয়। এমন কৌশল নিচ্ছেন অন্য নেতারাও। নন্দীগ্রামে শুভেন্দু অধিকারী যেমন বলেছেন, তাঁদের হাতে লোকজন আছে। কী ভাবে ভোট করাতে হয়, জানেন! লালগড়ের সভায় এ দিন খোদ মমতাও বলেন, ‘‘মানুষকে সঙ্গে নিয়ে ভোটটা করে দেবেন।”
বিরোধীদের প্রশ্ন একটাই, নির্বাচন কমিশন কী করছে? তাঁদের অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রী প্রথমেই যখন রাজ্যবাসীকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, কমিশন জেনেও কিছু করেনি। অনুব্রতরা প্রকাশ্যে হুমকি দিয়ে বেড়াচ্ছেন, কমিশন নীরব। তবে কি বিধানসভাতেও দু’বছর আগের লোকসভা ভোটের অভিজ্ঞতারই পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে? বিরোধীদের কথায়, সে বারও কমিশন প্রথমে কড়া মনোভাব নিলেও আখেরে কাজের কাজ করেনি। এ বারে মমতা শুরু থেকেই যে ভাবে শাসানির সুরে কথা বলছেন, দলের তরফে অফিসারদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে— তার পরেও কি কমিশন হাত গুটিয়ে থাকবে? কমিশন সূত্রে অবশ্য দাবি, মমতা প্রচারে যা বলছেন, তা নজরে রাখা হচ্ছে। রাজ্যের উপ-মুখ্য নির্বাচনী অফিসার দিব্যেন্দু সরকার এ দিন বলেন, ‘‘বিষয়টিতে কমিশনের নজর রয়েছে। সময়ে সময়ে বক্তব্যের সিডি দিল্লিতে পাঠানো হচ্ছে।’’ জঙ্গলমহলের জনসভাতেও মমতা কমিশনের ন়জরে ছিলেন। কমিশনের এক কর্তা বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের বক্তব্যের সিডি সংগ্রহ করা হচ্ছে। কমিশন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।’’
কী সিদ্ধান্ত হতে পারে?
বিহার ভোটের সময় প্রচারের ভাষা নিয়ে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ এবং আরজেডি নেতা লালুপ্রসাদ যাদবকে সতর্ক করেছিল কমিশন। সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য খতিয়ে দেখে প্রয়োজনে প্রেস বিবৃতি জারি করে নিন্দা করার কথা ভাবতে পারে কমিশন।
কিন্তু তাতে আর লাভ কতটা? সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy