নজরবন্দি বুথ। সোনামুখীর বিদায়ী বিধায়ক। ছবি: দেবব্রত দাস
দীপালি সাহার হলটা কী!
এমন জাঁদরেল তৃণমূল নেত্রী কিনা ভোটের দিন নিজের ওয়ার্ডেই রইলেন! বুথে ঢুকে ছাপ্পা মারা থেকে পুলিশের উর্দি খুলে নেওয়ার হুমকি দিয়ে যিনি বারেবারে বিতর্কে জড়িয়েছেন, সেই দীপালিদেবী বুথে বুথে ঘুরলেন না।
সোনামুখী শহরের তিন নম্বর ওয়ার্ডের থানারপাড়ায় সোমবার দুপুরে টিভিতে খবর দেখতে দেখতে দীপালিদেবী বললেন, “কোথাও তো কোনও সমস্যা নেই। তাহলে ওয়ার্ডের বাইরে গিয়ে কী করব?”
তার মানে কি ‘ভোটটা হয়ে গিয়েছে’? নিজের জেতার ব্যাপারে নিঃসংশয়?
এ বার আরও তাৎপর্যপূর্ণ জবাব সোনামুখীর তৃণমূল প্রার্থী তথা বিদায়ী বিধায়কের—‘‘দলের ছেলেদের যা টিপস্ দেওয়ার, রবিবার রাতেই দিয়ে দিয়েছি।’’ প্রার্থীর ঘনিষ্ঠ কিছু কর্মীও জানালেন, ভোট তো হয়েই যাচ্ছে। খামোকা বুথে বুথে ঘুরে আরও বিতর্ক কেন বাড়াবেন ‘দিদি’।
চুম্বকে এই হলেন ভোটের দিনের দীপালি সাহা।
তাঁর টিপস পেয়ে তা হলে কেমন ভোট হল সোনামুখীতে?
সাদা চোখে দেখলে শান্তিপূর্ণ ও নিরুপদ্রব। কিন্তু, ‘আসল ভোটের’ কিছুটা আভাস মিলল তৃণমূল প্রার্থীর স্বামী সমীর সাহার কথায়। দোতলা বাড়ির ভিতর এক চিলতে ঘরে বিএসএনএলের এই কর্মী খুলে ফেলেছেন ‘ওয়্যার রুম’। একের পর এক ফোনে নির্দেশ যাচ্চে দলের কর্মীদের কাছে। ফোন করে জানতে চাইছেন, ‘সিপিএমের এজেন্ট বসেছে নাকি রে?’ সকাল পৌনে ন’টা নাগাদ মুড়ি খেতে খেতে তিনি নিজেই হিসেব দিলেন, সোনামুখী বিধানসভা কেন্দ্রের ২৫৫টি বুথের ৮৬টিতে সিপিএমের এজেন্ট বসেনি। তার মধ্যে ৫৬টাই পাত্রসায়র ব্লকের।
সোনামুখীর সিপিএম প্রার্থী অজিত রায়ের অভিযোগ, “তৃণমূলের হুমকিতেই আমরা পাত্রসায়র ব্লকের বহু বুথে পোলিং এজেন্ট বসাতে পারিনি।’’ সিপিএমের ইন্দাস জোনাল কমিটির সম্পাদক অসীম দাস ও পাত্রসায়র জোনাল কমিটির আহ্বায়ক লালমোহন গোস্বামীর অভিযোগ, বুথে এজেন্টরা ঢোকার পরেও তৃণমূলের লোকেরা জোর করে তাঁদের বের করে দিয়েছে।
অভিযোগ শুনে হেসে ফেললেন দীপালিদেবী। বললেন, “আগে সিপিএমের বলে জনগণের মাথা ফেটেছে, অনেককেই মাঠ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। জনগণ এখন ভাল করে প্র্যাকটিস করেছে। সে জন্য এখন ওই সব বাউন্সারকেও তারা ছয় মারছে। আমরা কে? সবই তো জনগণ করছে।” তাঁর সংযোজন, “পাত্রসায়রে সিপিএম যা অত্যাচার করেছে, যা নির্যাতন করেছে, তার সাক্ষী আমরা। সেই তুলনায় এখন তো কিছুই হয় না।”
সোনামুখী কেন্দ্রে এর আগে তিনি ২০০৬ ও ২০১১ সালে দাঁড়িয়েছিলেন। ২০০৬ সালে হারলেও ২০১১ সালে তিনি জেতেন। এ দিন সকাল ৬টা নাগাদ তিনি তৃণমূল নেত্রীর মতোই নীল-সাদা শাড়ি আর নীল-সাদা হাওয়াই পরে বাড়ির কাছের বুথের সামনে চলে আসেন। বুথের সামনে দাঁড়িয়ে দীপালিদেবী বলেন, “আমার ছেলেরা সবাই মাঠে নেমে পড়েছে। আমি আজ ওয়ার্ড নিয়েই পড়ে থাকব। তা না হলে অসুবিধা রয়েছে।” তাঁরও তা হলে চিন্তা হয়? হেসে বুথ ছেড়ে বাড়ির দিকে চলে গেলেন তৃণমূল প্রার্থী। তখনই ফোনে একটা খবর এল। কী খবর, জানতে চাইলে বললেন, ‘‘আমাকে সংবাদপত্রের এক কর্মী জানালেন, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে নাকি কোনও বুথেই এজেন্ট বসেনি। কর্মীদের মধ্যেও গা ছাড়া ভাব। আমাকে এক্ষুনি বেরোতে হবে।” সাদা রঙের স্কুটিতে চেপে এলাকা ঘুরে বেড়ালেন দীপালিদেবী।
ফের নিজের তিন ওয়ার্ডে (এখানকারই কাউন্সিলর দীপালিদেবী) পা দিতেই এক তৃণমূল কর্মী বললেন, সিপিএম লাইনে দাঁড়িয়ে প্রচার করছে। এ বার সেই চেনা মেজাজে দেখা গেল তাঁকে। বুথের সামনে রাস্তা থেকে আঙুল উঁচিয়ে দীপালিদেবীকে বলতে শোনা গেল, “বিশুদা ভাল হচ্ছে না কিন্তু। এ রকম বদমায়েশি বরদাস্ত করব না। অসভ্যতামি হচ্ছে!” সেই ‘বিশুদা’ আমতা আমতা করে বললেন, “ভোট দিতে এসেছি। এই দেখ আমার ভোটার কার্ড।” যা শুনে তিনি গলার স্বর নামিয়ে বললেন, “ভোট দিয়ে বাড়ি চলে যাও।”
তখনই বোঝা গেল, দীপালিদেবী কেন বলেছিলেন, নিজের ওয়ার্ডে না থাকলে অসুবিধা হতে পারে। তাঁর এমন অনেক মেজাজ ও দুর্ব্যবহারের সাক্ষী সোনামুখীর মানুষ। রথতলায় এক যুবক বলছিলেন, “উনি যে ছাপ্পা দিতে ওস্তাদ, সে কথা তো ইতিমধ্যেই প্রমাণিত।” লোকসভা ভোটের সেই ‘কলঙ্কের দাগ’ এখনও লেগে রয়েছে, তা বিলক্ষণ জানেন দীপালিদেবী। তাঁর কর্মীদের একাংশও জানালেন, ফের বেফাঁস কিছু না করে বসেন, সেই আশঙ্কাতেই দিদি বোধহয় আজ আর বেশি ঘুরলেন না।
তা হলে কি নির্বাচন কমিশন ও জোটের চাপেই দিনভর ‘ওয়ার্ডবন্দি’ হয়েই থাকতে হল? সোজা ব্যাটে ডেলিভারি সামলে দীপালি সাহার জবাব, “আমরা বছরভর মাঠে থাকি। যে যেমন বলই দিক না কেন, রান ঠিক করবই।” যা শুনে সিপিএমের বাঁকুড়া জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য শেখর ভট্টাচার্যের পাল্টা, “জনগণ রান আউট করে দেবে না তো!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy