ব্যাপারটা আদতে তাঁদের সরকারের অক্ষমতার পরিণাম। কিন্তু ঘুরিয়ে সেটাকেই নিজের কৃতিত্ব হিসেবে জাহির করে ভোট-প্রচারের ময়দানে দৌড়চ্ছেন যাদবপুর কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী মণীশ গুপ্ত!
মমতা সরকারের পাঁচ বছরের বিদ্যুৎমন্ত্রী মণীশবাবু দাবি করে এসেছেন, তাঁর আমলে রাজ্যে বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত। তাঁর নেত্রী বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গ এখন বিদ্যুতের ‘ব্যাঙ্ক’ করেছে। এতটাই স্বচ্ছল অবস্থা যে, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রফতানিও করা হচ্ছে।
এবং যাদবপুরের সব পথসভায় ভোটারদের এই কথাগুলো ফের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন মণীশবাবু। ‘ম্যাজিকের’ মতো কী ভাবে লোডশেডিং উবে গিয়েছে, সে দিকে জনগণকে খেয়াল রাখতে বলছেন। পাড়া-পাড়ায় তৃণমূলের প্রচার-মিছিল থেকে অহরহ উড়ে আসছে বার্তা— ‘মাসিমা, দেখেছেন তো, লোডশেডিং নেই!’ বা ‘বৌদি, এত গরমেও লাইন কিন্তু থাকছে। ভোটটা যেন পাই।’ দলের কাউন্সিলরেরা মওকা পেলেই পাড়ার দাদা-কাকু-মেসোমশাইদের জানিয়ে রাখছেন, বিদ্যুতের এত ছড়াছড়ি এ রাজ্যে কস্মিনকালেও দেখা যায়নি। এটা বিদ্যুৎমন্ত্রীর সাফল্য ছাড়া কী?
তাই যাদবপুরে মণীশবাবুর হয়ে বুক ঠুকে ভোট চাইছে তৃণমূল। লোডশেডিং বিদায়ে ভোটারদের অনেকেও আপ্লুত। কেউ কেউ তো খুশি মাখানো বিস্ময় প্রকাশ করে প্রচারকারী ছোট-মাঝারি নেতাদের শুধোচ্ছেন, ‘‘তা-ই? আমরা বাংলাদেশকেও দিচ্ছি! তা হলে তো অবস্থা বেশ ভাল বলতে হবে!’’
শুনে ছোট-মাঝারিদের মুখে আত্মপ্রসাদের হাসি। মন্ত্রীর কেন্দ্রে প্রচারের রকম দেখে তাঁর দফতরের অনেক কর্তাও মিটিমিটি হাসছেন। তবে অন্য কারণে। জনান্তিকে তাঁরা জানাচ্ছেন, রাজ্যে বিদ্যুৎ বাড়তি, এ দাবি আলোর মতো সত্যি। কিন্তু তার নেপথ্যে রয়েছে এক বিরাট অন্ধকারের ছবি। কী রকম? ‘‘শিল্পের আঁধার।’’— বলছেন এক কর্তা। তাঁর মন্তব্য, ‘‘এরই দৌলতে রাজ্যে বিদ্যুতের ভাঁড়ার উপচে পড়ছে।’’ কর্তাদের বক্তব্য, রাজ্যে নতুন শিল্প আসবে ধরে নিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা হয়েছিল। পুরনো সব বিদ্যুৎকেন্দ্র সংস্কারের পাশাপাশি নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র হয়েছে। অথচ পাঁচ বছরে পশ্চিমবঙ্গে বড় শিল্প হয়নি। ফলে বাড়তি বিদ্যুৎ ব্যবহারের জায়গা তৈরি হয়নি। তাই রাজ্যে বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত। ‘‘মন্ত্রী তা ভালই জানেন। তবে ভোটের মরসুম তো! তাই আসল কারণটা আড়ালে রেখে লোডশেডিং না-হওয়াটাকেই পুঁজি করেছেন।’’— কটাক্ষ এক বিদ্যুৎকর্তার। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘যান্ত্রিক গড়বড় না-হলে আগামী পাঁচ বছরেও লোডশেডিং হবে না। রাজ্যের পক্ষে মোটেই ভাল লক্ষণ নয়।’’
মণীশবাবু যদিও মানেন না। ওঁর যুক্তি, ‘‘যে কোনও রাজ্যের পক্ষেই বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত থাকা মঙ্গল। এতে চাহিদা বাড়লে সমস্যা হয় না।’’ কিন্তু শিল্পের মন্দাতেই যে বিদ্যুতের ছড়াছড়ি, সে তত্ত্ব কি ঠিক নয়? বিদ্যুৎমন্ত্রীর দাবি, ‘‘একেবারেই ঠিক নয়। নিন্দুকেরা যা-ই বলুক, রাজ্যে ছোট-মাঝারি বহু শিল্প হচ্ছে। গ্রামীণ বিদ্যুদয়ন চলছে। ফলে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। এটা মানুষ জানে। তা-ই প্রচারেও তুলে ধরা হচ্ছে।’’ মন্ত্রীর দাবি তাঁর দফতরের তথ্যে নস্যাৎ হয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ-সূত্র মোতাবেক, ২০১১-র পরে রাজ্যে বিদ্যুতের চাহিদা বছরে অন্তত ৮%-১০% হারে বাড়বে ধরা হয়েছিল। কিন্তু শিল্পের বেহাল দশায় হিসেব ধূলিসাৎ। বিদ্যুৎশিল্পের একাংশের দাবি, গুজরাতে মাথাপিছু বিদ্যুতের ব্যবহার পশ্চিমবঙ্গের প্রায় চার গুণ। তবু মোদীর রাজ্যে ফি-বছর বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে, কারণ সেখানে শিল্প হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে চাহিদা নেই, তাই বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত। দফতরের সাম্প্রতিক হিসেব অনুযায়ী, ২০১৫-’২০ পর্যন্ত দিনের সর্বাধিক চাহিদার সময়েও রাজ্যে গড়ে দৈনিক ১১০০-১৩০০ মেগাওয়াট উদ্বৃত্ত থাকবে। সেটা কাজে লাগানোর দিশা খুঁজছে দফতর। বাজারে বেচে মোটা টাকা ঘরে তোলার আশা নেই। কেননা জাতীয় গ্রিডে এখন ইউনিটপিছু দাম কম।
অর্থাৎ যে ‘উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ’ দেখিয়ে মন্ত্রী বাহবা কুড়োচ্ছেন, তা কার্যত রাজ্যের বোঝা। ‘‘আর ঝেড়ে ফেলার তাগিদেই বিদ্যুৎ ব্যাঙ্ক।’’— বলছেন বিশেষজ্ঞেরা। ওঁদের দাবি, বিদ্যুৎ কাজে লাগছে না বলে অন্যকে দেওয়া হচ্ছে। চুক্তি থাকছে, দরকার মতো ফেরানো হবে। বছরভর পশ্চিমবঙ্গ এ ভাবেই ঘাড়ের বোঝা নামায়। এতে কৃতিত্বের কিছু নেই। বরং ব্যর্থতাই।
ভোটের টানে ‘ব্যর্থতা’ও এখন ‘সাফল্যের’ ঝুলিতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy