তাঁর কোথাও যাওয়ার নেই, কিচ্ছু করার নেই।
বেলা ১১টায় খাঁ খাঁ তাঁর বাড়ির চৌহদ্দি। দোতলা বাড়ির এক তলায় আগের মতো বসেনি তাঁর ‘দরবার’। গোটা বাড়িতে শুধুমাত্র হাতে গোনা অতি ঘনিষ্ঠ কয়েক জন। ভোটের বাজারে কেউ তাঁকে ডাকেননি। তাই তিনিও দলের হয়ে কোথাও তেমন যাচ্ছেন না ভোটের প্রচারে। তবুও শেষ বেলায় যদি ডাক আসে উপরতলা থেকে, সেই আশাতেই দিন কাটছে রাজারহাটের তাপস চট্টোপাধ্যায়ের।
প্রাক্তন এই সিপিএম নেতা বর্তমানে বিধাননগর পুরনিগমে তৃণমূলের ডেপুটি মেয়র। লোকমুখে প্রচার, সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে এসে দোর্দণ্ড প্রতাপ জিম্বু (এই নামেই তিনি এলাকায় বেশি পরিচিত) কার্যত নখদন্তহীন হয়ে একেবারে কোণঠাসা। তাই বিধানসভা নির্বাচন ঘোষণা হওয়ার পরেও তাঁকে খুশি থাকতে হচ্ছে নিজের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের পুর-পরিষেবা সংক্রান্ত কাজকর্মের তদারকি নিয়েই। ভোটের কাজ নয়।
২০১১-র বিধানসভা ভোটের সময়েও দেখা গিয়েছিল, তাপসবাবুর বাড়িতে সকাল থেকে তিল ধারণের জায়গা নেই। তখন তিনি রাজারহাট সিপিএমের মধ্যমণি। নিউ টাউনের সিপিএম প্রার্থী। নিউ টাউন তো বটেই, তৎকালীন দলীয় প্রার্থী রবীন মণ্ডলের জন্য রাজারহাট-গোপালপুর কেন্দ্রের ভোটের প্রচারেও জ্বলজ্বল করতেন তিনি।
২০১৬-র ভোটে রাজারহাট-নিউ টাউন বিধানসভা কেন্দ্রের লালকুঠি এলাকার এটাই সবচেয়ে বড় ‘পরিবর্তন’। লালকুঠিতেই তাপসবাবুর বাড়ি, পাড়া। কিন্তু তিনি ‘পাড়া ছাড়া’ গত সেপ্টেম্বরে পুরনিগমের ভোটের সময় থেকেই। যখন তাঁর ইচ্ছেকে গুরুত্ব না দিয়ে ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা তাপসবাবুকে বেপাড়ায় ৩ নম্বর ওয়ার্ডে ভোট লড়তে পাঠিয়েছিল তাঁর নতুন দল, তৃণমূল। ৪ নম্বর ওয়ার্ডটিতে টিকিট দেওয়া হয় নিউ টাউনের বিদায়ী বিধায়ক তথা বিধাননগরের মেয়র সব্যসাচী দত্তের ঘনিষ্ঠ শাহনওয়াজ আলি মণ্ডল (ডাম্পিকে)। সেই ডাম্পিকে এখন সব্যসাচীবাবু তো বটেই, এমনকী রাজারহাট-গোপালপুরের বিদায়ী বিধায়ক তথা মন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুর হয়েও নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রাখা হয়েছে। ঘরে বসে রয়েছেন শুধু তাপসবাবু ও তাঁর অনুগামীরা।
তাপসবাবু গত বছর জুলাইতে সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন। দল ছাড়ার পরে তিনি রাতারাতি বাড়ির দোতলায় বসার ঘরের দেওয়ালে জ্যোতি বসু আর তাঁর রাজনৈতিক আশ্রয়দাতা সুভাষ চক্রবর্তীর ছবির মাঝে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবিও টাঙিয়েছেন। নিজের এলাকার বিভিন্ন পার্টি অফিসের রং লাল থেকে সাদা করিয়েছিলেন।
রাজারহাটের রাজনীতির হাঁড়ির খবর রাখেন এমন লোকজনের ব্যখ্যা, রাজারহাটে সিপিএম আর তাপসবাবু অন্তত দু’দশক কার্যত প্রতিশব্দের মতো ছিলেন। শুধুমাত্র সিপিএমকে ওই এলাকায় দুর্বল করতেই তাঁকে তৃণমূলে নেওয়া হয়েছিল বলে মত অনেকের। কারণ, ২০১১-এ প্রবল তৃণমূল হাওয়াতেও তাপসবাবুর নিজস্ব এলাকা, দশদ্রোণ থেকে কাদিহাটিতে ৮ হাজার ভোটে জিতেছিল সিপিএম। তাপসবাবুর রাজনৈতিক অস্তিত্বকে গুরুত্বই দিতে চায়নি তাঁর নতুন দল, তৃণমূল। একাধিক ঘটনায় তার নমুনাও দেখা গিয়েছে। বিধাননগর পুরনিগমে তাপসবাবুকে ডেপুটি মেয়র করা হয়েছে। কিন্তু কোনও দফতর দেওয়া হয়নি। সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে দলে আসা তাপসবাবুকে বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজারহাটের কোনও কোনও কর্মিসভায় মঞ্চে উঠিয়েও কথা বলতে দেওয়া হয়নি। এমনকী, তাপসবাবুকে অস্বস্তিতে ফেলতেই তাঁকে মঞ্চে ডেকে সিপিএমের নিন্দা করেছেন তৃণমূল নেতানেত্রীরা।
শোনা যায়, তাপসবাবুকে বিধানসভা নির্বাচনের টিকিট দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা রাখা হয়নি। ফলে তাপসবাবুর দু’কূলই গিয়েছে। উল্টে তাঁকে আরও অস্বস্তিতে ফেলেছে রাজারহাট-নিউ টাউন কেন্দ্রের জন্য সিপিএমের প্রার্থী বাছাই। ওই কেন্দ্রে সিপিএমের প্রার্থী হয়েছেন নরেন্দ্রনাথ (বলাই) চট্টোপাধ্যায়। যিনি এলাকায় তাপসবাবুর রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু বলেই পরিচিত।
তাপসবাবুর ঘনিষ্ঠদের একাংশের অভিযোগ, এই গুরু-শিষ্যের তত্ত্বকে খাড়া করেও ভোটের বাজারে তাপসবাবুকে ঘরে ঢুকিয়ে দিতে চাইছেন তৃণমূলে তাঁর বিরোধী শিবির। সেই বিরোধী শিবিরের প্রধান বলে পরিচিত রাজারহাট-নিউ টাউন কেন্দ্রের বিদায়ী বিধায়ক তথা বিধাননগর পুরনিগমের মেয়র সব্যসাচী দত্ত জানিয়ে দিয়েছেন, তাপসবাবুকে তাঁর প্রয়োজন নেই। কারণ তিনি ২০১১ সালে তাপসবাবুকে হারিয়েই ভোটে জিতেছিলেন। তাপসবাবুর পাড়ায় প্রচারে গিয়েও তাঁকে সঙ্গে নেননি সব্যসাচীবাবু। উল্টে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, এলাকার উন্নয়নের জন্য ২ কোটি টাকা করে প্রতি ওয়ার্ডে দিয়েছে পুরনিগম। ফলে এ বার তাপসবাবুর জায়গা বলে পরিচিত এলাকায় তৃণমূলের ভোট বাড়া উচিত। যদিও তা না হলে উত্তর দিতে হবে তাপসবাবুকেই।
এ হেন জটিল রাজনৈতিক মারপ্যাঁচের মধ্যেই দিন কাটছে তাপসবাবুর। তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের খবর, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে সব কথাই জানিয়ে রেখেছেন তিনি। তাঁকে উত্তর ২৪ পরগনার অন্যান্য জায়গায় প্রচারের কাজে লাগানো হবে বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন অভিষেকবাবু। সেই ডাকের আশাতেই রয়েছেন তাপসবাবু।
যদিও তাপসবাবু মানতে চাননি, পরিস্থিতি প্রতিকূল। তাঁর কথায়, ‘‘দল ভাল খেললেই হল। যাঁরা খেলছেন, তাঁরা সকলেই ভাল খেলোয়াড়।
নতুন দলের হয়ে মাঠে নামার জন্য একটু সময় তো দিতেই হবে। আমার ধৈর্য খুব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy