টক্করটা এ বার একপেশে নয়। সমানে সমানে। প্রথম দফার ভোট মোটামুটি শান্তিতে কাটলেও জায়গায় জায়গায় হিংসা, ভোটারদের ভয় দেখানো, সাংবাদিকদের এমনকী বিরোধী প্রার্থীকে প্রকাশ্য পথে মারধরের মতো ঘটনা শুরু হয়ে গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। আগে থেকে কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠিয়েও ঠিক মতো তাদের কাজে লাগানো হচ্ছে না বলে নিরন্তর অভিযোগ উঠছে। এই অবস্থায় আগামী পর্বগুলির ভোটে পুরো মাত্রায় রাজনৈতিক হিংসার আশঙ্কা করছেন রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী।
গত কাল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের সঙ্গে দেখা করেছেন রাজ্যপাল। সূত্রের খবর, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দেওয়া রিপোর্টে বাকি ছ’দফার ভোটে রক্ত ঝরার আশঙ্কার কথা তিনি সবিস্তার জানিয়েছেন। বিরোধী দল বা জোট শুধু নয়, বিশিষ্ট জন থেকে শুরু করে সংবাদমাধ্যম ও সোশ্যাল নেটওয়ার্কের আম জনতা নিরন্তর যে অভিযোগগুলি তুলে আসছেন, মনে করা হচ্ছে, সেগুলির সত্যতাই কার্যত স্বীকৃতি ও গুরুত্ব পেল রাজ্যপালের ওই রিপোর্টে।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও মনে করছে, পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার ফলে তৃণমূল যেমন শক্তিসংগ্রহ করেছে, তেমনই সিপিএম ও কংগ্রেস আগে থেকে জোট বাঁধায় বিরোধী শক্তিও আর দুর্বল নয় তেমন। শাসক দলের সঙ্গে কিছু জায়গায় সমানে-সমানেই টক্কর নিচ্ছে তারা। ফলে রাজ্যপালের মতো কেন্দ্রেরও আশঙ্কা, এই রাজ্যের ভোটে আগামী দিনগুলিতে ফের রক্ত ঝরতে পারে।
পশ্চিমবঙ্গের ভোটে ও তার আগে-পরে হিংসার ট্র্যাডিশনটা বদলে দিতে এ বার ‘নজিরবিহীন’ উদ্যোগের আশ্বাস দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। প্রথম দফার ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে মূলত বুথেই আটকে রাখায় সেই আশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। এই অবস্থায় পরের দফার নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করতে আগামী সপ্তাহে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নসীম জৈদীর নেতৃত্বে পূর্ণাঙ্গ কমিশন রাজ্য সফরে যাচ্ছে। তার ঠিক আগে রাজ্যপালের দিল্লি সফরকে রাজ্য প্রশাসনের তরফে ‘রুটিন বিষয়’ বলা হলেও তাঁর দেওয়া রিপোর্টটিকে কিন্তু যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছে কেন্দ্র। এবং সে কারণেই কমিশনের দাবি মতো কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠানো ছাড়াও, কমিশনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। রাজ্যপালের দেওয়ায় তথ্যের ভিত্তিতে কমিশনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে খুব শীঘ্রই বৈঠকে বসবেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তারা। পরের পর্বগুলি কী ভাবে নির্বিঘ্ন করা যায় তা নিয়ে আলোচনা হবে দু’পক্ষে।
প্রশ্ন হল, রাজ্যপাল ঠিক কী জানিয়েছেন কেন্দ্রকে? একটি সূত্রের খবর, লড়াইটা যে এ বার সমানে সমানে, সেটাই আশঙ্কা বাড়িয়েছে রাজ্যপালের। রিপোর্টে তিনি ঠিক কী বলেছেন, তার বয়ান জানা না থাকলেও শাসক শিবির কিন্তু উদ্বেগের কোনও কারণ আছে বলে মনে করছে না। তৃণমূলের মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন যেমন বলেছেন, ‘‘প্রথম পর্বে মানুষ উৎসবের মেজাজে নির্বিঘ্নে ভোট দিয়েছেন। পরবর্তী পর্বগুলিতেও ভোটাররা নিশ্চিন্তে ভোট দেবেন।’’
রাজ্যপালের রিপোর্ট নিয়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর বক্তব্য, ‘‘ওই একই আশঙ্কা আমরা নির্বাচন কমিশনের কাছে জানিয়েছি। তৃণমূলের আর কোনও আশা নেই। সেই হতাশা থেকেই তারা আক্রমণ করতে পারে।’’
বামেরা প্রথম থেকেই ‘দিদিভাই-মোদীভাই’ সমঝোতার কথা তুলে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী— উভয়কেই বিঁধছেন। রাজ্যপালের রিপোর্ট প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম আজ ওই ‘সমঝোতা’র দিকেই আঙুল তুলেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘রাজ্যপাল কী জানিয়েছেন বা তাঁর সঙ্গে রাজনাথ সিংহের কী কথা হয়েছে সেটা আমার পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তবে রাজনাথ কলকাতায় প্রচারে গিয়ে নারদ-কাণ্ড নিয়ে মুখ খুলতে ভুলে গিয়েছেন। অথচ, ওই ঘটনায় তাঁর এক আইপিএস অফিসারকে ঘুষ খেতে দেখা গিয়েছে।’’
সেলিমের বক্তব্য, নির্বাচনে শান্তিরক্ষার প্রশ্নে কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভূমিকা কী হবে, তা যেমন নির্বাচন কমিশন ঠিক করে, তেমনই পরোক্ষে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকেরও ভূমিকা থেকে যায় এ ব্যাপারে। সেলিমের তাই দাবি, অসমে প্রথম দফার ভোটের পরে যে কেন্দ্রীয় বাহিনীর দায়িত্ব শেষ হয়ে গিয়েছে, তাদের অবিলম্বে পশ্চিমবঙ্গে মোতায়েন করা হোক।
একই সঙ্গে সেলিমের মন্তব্য, ‘‘সন্ত্রাস রোখার প্রশ্নে কেন্দ্রের পাশাপাশি রাজ্য সরকারও নিজেদের দায় এড়িয়ে যেতে পারে না।’’
ভোট-হিংসার প্রসঙ্গে রাজ্যপালের রিপোর্টেও অভিযোগের তির মূলত শাসক দলের দিকে। তবে প্রশ্ন তোলা হয়েছে বিরোধী দলগুলির ভূমিকা নিয়েও। এই রাজ্যে ভোটের আগে রাজনৈতিক দলগুলি কী ভাবে এলাকা দখল করতে সক্রিয় থাকে, রাজ্যপালের রিপোর্টে তা-ও ব্যাখ্যা করা হয়েছে বলে সূত্রের খবর। কৃষ্ণনগরের বাদকুল্লা, তেহট্ট, গয়েশপুর ও উত্তরবঙ্গের বেশ কিছু জেলায় রাজনৈতিক সংঘর্ষের
বিবরণও তাতে রয়েছে। রাজ্যপালের রিপোর্টে সব চেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে, মানুষের মধ্যে আস্থা ফেরানোর উপরে।
প্রশ্ন উঠছে, খোদ কলকাতা পুলিশের কমিশনার রাজীব কুমারের নিরপেক্ষতা নিয়ে বারবার অভিযোগ পাওয়ার সত্ত্বেও ভোটের সময় তাঁকে দায়িত্ব থেকে সরানো নিয়ে এখনও সিদ্ধান্ত নেয়নি কমিশন। প্রশাসনের যে কর্তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে খোদ রাজ্যপালই সন্দিহান, তাঁদের দিয়ে কি মানুষের মধ্যে আস্থা ফেরাতে পারবে নির্বাচন কমিশন?
চেষ্টায় অন্তত খামতি না রাখতে নসীম জৈদী ফের যাচ্ছেন কলকাতায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy