ঘরে বিদ্যুৎ নেই। কুপি জ্বালানোর মতো কেরোসিন তেলও নেই। মংলি ভাত নিয়ে বসেছে। পাতের কোনায় একটি টমেটো সিদ্ধের কিছু অংশ পড়ে। ওই একটি টমেটো দিয়েই দুপুরের খাবার খেতে হবে তাঁদের তিন জনকে। মংলি, তাঁর মা ও বোনকে। বীরপাড়া চা বাগানের শ্রমিক মংলিরা। বললেন, “কাজ নেই তো। টাকাও নেই। কী ভাবে, সব্জি কিনব। চাল কেনারই টাকা জোগাতে পাচ্ছি না।”
বাড়ির দাওয়ায় বসে পদম লামা কিন্তু তাল ঠুকছেন। একবার সামনে থাকা টেবিলে ঠুকছেন, তো আর এক বার নিজের বুকে। আর সেই ভাবেই দাবি করছেন, মংলিরা তাঁর সঙ্গেই থাকবেন। বলছেন, “এই পদম লামা কোনও রং দেখেনি। তৃণমূল হোক, বিজেপি হোক বা বাম-কংগ্রেস। যে একবার দরজায় টোকা দিয়েছে, তাঁকেই সাহায্য করেছি। মেয়ের বিয়ে থেকে হাসপাতাল—সবেতেই এগিয়ে গিয়েছি। মানুষ আমার সঙ্গেই থাকবে।”
পদমবাবু এ বারে মাদারিহাট বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী। কয়েক বছর আগেও যিনি ডুয়ার্সে বিমল গুরুঙ্গের এক নম্বর লোক ছিলেন। যিনি মোর্চার একটি অংশ নিয়ে শাসক দলে যোগ দিয়েছেন। মোর্চার আর একটি অংশ (যাঁরা বিমলের অনুগামী) অবশ্য রয়েছে ওই কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী মনোজ টিজ্ঞার সঙ্গে। পদমের কথা পৌঁছেছে তাঁর কানেও। দলীয় অফিসে ভিড় করে থাকা কর্মীদের মাঝে প্রশ্ন তোলেন তিনি, ‘‘কেন মানুষ তৃণমূলকে ভোট দেবেন?’’ দাবি করেন, একের পর এক চা বাগান বন্ধ হয়েছে। রাস্তার অবস্থা ক্রমশ বেহাল হয়েছে। হাসপাতালের অবস্থা আরও খারাপ। তিনি বলেন, “এবারে তৃণমূল দ্বিতীয় স্থানেও থাকবে না। তা বুঝতে পারছি সর্বত্র। যেখানে যাচ্ছি ভিড় করছে মানুষ। এটা আমি প্রথমবারই দেখছি।”
এই দুই প্রার্থী যখন মোর্চার ভোট ভাগের অঙ্ক (দলীয় সূত্রের খবর, ওই এলাকায় মোর্চার ভোটব্যাঙ্কের জোরেই গত নির্বাচনে ২৪ হাজারে লিড নিয়েছিল বিজেপি) কষতে ব্যস্ত, সেই সময় খুব সূক্ষ্ম ভাবে নিজেকে ফের বাগানে বাগানে হাজির করাচ্ছেন বাম জোটের প্রার্থী আরএসপির কুমারী কুজুর। পরপর তিন বার ওই কেন্দ্রে থেকে জিতে বিধায়ক হয়েছেন তিনি। বয়স ষাট পার করেছেন। স্বল্পভাষী। প্রচারেও কোনও চমক-ধমক নেই। গত বিধানসভা নির্বাচনে পরিবর্তনের হাওয়ার মধ্যেও তৃণমূল জোটের প্রার্থীকে সাত হাজারের বেশি ভোটে হারিয়েছিলেন। তিনি বলেন, “মিলিয়ে নেবেন এ বারেও আমিই জিতব। চার বার হবে। বাইরে আমার সে রকম পতাকা দেখবেন না। কিন্তু মানুষ আমার সঙ্গেই আছেন। এই কয়েক বছরে একের পর এক চা বাগান বন্ধ হয়ে মানুষ নিঃস্ব হতে বসেছে। কেন আর তৃণমূলকে রাখবে।” সঙ্গে আরও জানান, কংগ্রেস তাঁর সঙ্গে প্রচারে নেমেছে। যা তাঁর আরও একটি প্লাসপয়েন্ট।
মাদারিহাট বিধানসভা কেন্দ্র মানেই সবুজের হাতছানি। জঙ্গল থেকে চা বাগান সব দিয়ে যেন ঘেরা রয়েছে গোটা এলাকা। ২০০২ সালে ওই কেন্দ্রের মধ্যে থাকা ঢেকলাপাড়া চা বাগান বন্ধ হয়ে যায়। এর পরে বন্ধ হয় বান্দাপানি। নতুন সরকার আসার পরে আরও ৯টি চা বাগানে (যার মধ্যে রয়েছে ডিমডিমা, বীরপাড়া, হান্টাপাড়া, গ্যারগান্ডা, লঙ্কাপাড়া, জয়বীরপাড়া) অচলাবস্থা দেখা যায়। তার মধ্যে ডানকানের ৭টি বাগান রয়েছে। সেই বাগানের বাসিন্দাদের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, পানীয় জল তো নেইই। নেই খাবারও।
শুধু মংলি নন, বুধমতী ওঁরাও, কিস্কু ওঁরাও বলেন, “শুনছি তো ভোট এসেছে। কিছু দিন আগে মমতাও এসেছিলেন। কিন্তু কাকে ভোট দিই? বলুন তো? দিন তো আমাদেরপাল্টায় না।”
মাদারিহাটের রাজনীতি শুরু এখান থেকেই। শাসক দল তৃণমূল থেকে বিজেপি, বাম কেউই এমন ইস্যু হাত ছাড়া করতে রাজি নন। একে অপরকে দোষারোপ করে চলেছেন সব দলের নেতারাই। তৃণমূল বলছে, কেন্দ্র দায়ি। বিজেপি বলছে, রাজ্য। চা শ্রমিকদের পাশে কে রয়েছে, তা নিয়েও দাবির শেষ নেই। পদমবাবু বলছেন, “চা বাগান বন্ধ হয়েছে তো কেন্দ্রের জন্য। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী ২ টাকা দরে চাল দিচ্ছেন। পানীয় জলের ব্যবস্থা করছেন। সর্বতোভাবে পাশে থাকার চেষ্টা করছেন।” মনোজবাবু দাবি করেন, কিছু দিন আগে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ এসেছিলেন। যিনি এই অবস্থার পরিবর্তনে উদ্যোগী হয়েছেন। তিনি বলেন, “রাজ্য সরকারের জন্যই চা বাগানের এই দশা। যার জন্য কেন্দ্র এ বারে উদ্যোগী হয়েছে।”
মাদারিহাট বিধানসভা এলাকায় পা রাখলেই মনে হবে লড়াই হচ্ছে বিজেপির সঙ্গে তৃণমূলের। পতাকা থেকে পোস্টার এমনকি ভাষণেও। কিন্তু, আরএসপির বিদায়ী বিধায়ক কুমারী কুজুর নিঃশব্দে ঘুরে চলেছেন বাগানের পর বাগানে। এলাকার চা শ্রমিকরা অবশ্য অনেকেই জানান, ভোট বলে নয়, সারা বছরই কুমারী কুজুরকে তাঁরা পাশে পান। ফলে, তৃণমূল-বিজেপির জোরদার লড়াইয়ের দিকে না তাকিয়ে নিজের লোকজনকে একজোট রাখতে মাথার গাম পায়ে ফেলছেন কুজুর। সিপিএম তো বটেই, কংগ্রেসিরাও তাঁর হয়ে বেদম ছোটাছুটি করছেন চা বাগানের অলিগলিতে। সব মিলিয়ে ত্রিমুখী লড়াইয়ে অনেকটাই বাড়তি সুবিধার আশায়
রয়েছেন কুমারী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy