সেই ছবি। সিপিএম এজেন্টকে পিটিয়ে বুথ থেকে বার করে দেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন সোনালি গুহ। —নিজস্ব চিত্র।
জল নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। মোক্ষম সময়ে তাঁকে ডুবিয়ে দিল রাগ!
রেগে, ফুঁসে সবার সামনেই সিপিএমের এজেন্টকে মেরে বুথ থেকে বার করে দিতে দলীয় নেতাকে ফোনে হুকুম দিয়ে বসলেন সাতগাছিয়ার তৃণমূল প্রার্থী সোনালি গুহ। সেই খবর ছড়িয়ে পড়তেই বিতর্কের বিস্ফোরণ! তার অভিঘাত এতটাই যে, একদা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছায়াসঙ্গিনী, দাপুটে তৃণমূল নেত্রী চুপসে গিয়ে শেষবেলায় অদৃশ্যই হয়ে গেলেন।
যে তিনি সকালে অটোয় চড়ে হুঙ্কার দিচ্ছিলেন, দুপুরের পর সেই তিনি ওই অটোতেই এক রকম পালিয়ে দলীয় কর্মীর ফ্ল্যাটে দরজা এঁটে বসে রইলেন। রাত পর্যন্ত বেরোলেন না। আর তাঁর সঙ্গীরা ভীষণ রেগে, বিষম খেয়ে বলে বেড়ালেন, সিপিএম বা কংগ্রেস নয়, এ বার তৃণমূলের একমাত্র বিরোধী হল নির্বাচন কমিশন, যারা ‘চক্রান্ত করে’ বিধানসভার ডাকসাইটে ডেপুটি স্পিকারের বিরুদ্ধে শনিবার এফআইআর দায়ের করেছে।
শনিবার সোনালির হঠাৎ এত রাগ হল কেন?
দলের মধ্যেই তাঁর বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী মুচকি হেসে বলেছে, ‘‘হতাশা, পাহাড়প্রমাণ হতাশা! মাটি আর পায়ের তলায় থাকছে না বুঝতে পারছেন বলেই হতাশা লুকিয়ে রাখতে পারছেন না। কখন মুখ দিয়ে কী বেরিয়ে যাচ্ছে খেয়াল থাকছে না। একেই বলে বিনাশকালে বুদ্ধিনাশ।’’
কী করে আর মাথা ঠিক থাকে? সেই টিকিট দেওয়া থেকেই তো চলছে!
তাঁর এলাকায় তৃণমূল অন্তর্দ্বন্দ্বে ফুটিফাটা। বিক্ষুব্ধদের বিশ্বাসঘাতকতার ভয় যথেষ্টই রয়েছে। তার উপর প্রচারের সময় বহু জায়গায় ভোটারদের অসন্তোষ টের পেয়েছেন। এলাকায় ডুমুরের ফুল হয়ে থাকা, বিশেষ করে পানীয় জলের ব্যবস্থার শোচনীয় হাল নিয়ে সামনাসামনি মানুষের তীব্র ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছিল সোনালিকে। পরীক্ষার দিনে এত চাপ আর নিতে পারলেন না। মরিয়া তিনি কাশীবাটি সিন্ধুময়ী স্কুলের ১০৯ নম্বর বুথে সাংবাদিকদের সামনেই ফুঁসে উঠলেন, ‘‘মেরে বার করে দিন সিপিএমের প্রার্থী... ইয়ে, এজেন্টকে একদম। ওরা এখানে ইভিএম মেশিন খারাপ করে রেখেছে ডাক্তারবাবু!’’
এই ডাক্তারবাবুটি কে?
দক্ষিণ ২৪ পরগনায় তৃণমূলের জেলা পরিষদের স্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ চিকিৎসক তরুণ রায়।
তিনি কি প্রার্থীর নির্দেশ পালন করেছেন?
তরুণবাবুর সহাস্য উক্তি, ‘‘আরে না না, সোনালিদি রাগের মাথায় বলে ফেলেছেন। সব সময় মানুষের মন-মেজাজ তো এক রকম থাকে না। দিদি বলে ফেললেও আমরা শুনব কেন? আমরা মারামারিতে বিশ্বাস করি না। অবাধ নির্বাচন চাই।’’
তৃণমূল সূত্রের কিন্তু দাবি, দলের মধ্যে সোনালি-বিরোধী হিসেবে সুবিদিত তরুণবাবু এবং রমজান আলি শেখ (সাতগাছিয়ায় তৃণমূলের নির্বাচন কমিটির চেয়ারম্যান) এই ‘রাগের কথা’ নিয়ে ঘনিষ্ঠ-বৃত্তে তৃপ্তির হাসিই হেসেছেন। যদিও বিকেল থেকে তরুণবাবুই সাংবাদিকদের ফোন করে বলেছেন, ‘‘লিখে দেবেন তরুণ-রমজান সোনালি গুহর সঙ্গেই আছে।’’ কিন্তু তাতে গুঞ্জন আরও বেড়েছে— এটা নিজেদের উচ্ছ্বাস আড়াল করার চেষ্টা নয় তো? সোনালি যে
প্যাঁচে পড়েছেন!
আসলে শনিবার সকালেই চ়ড়চড়িয়ে রাগ বাড়ছিল সোনালির। সাঁজুয়ার বুথে ঢুকে সবেমাত্র প্রিসাইডিং অফিসারের সঙ্গে একটু কথা বলেছেন, অমনি ছুটে এসেছেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর অফিসার— ‘‘আপনি এখানে ঢুকবেন না ম্যাডাম।’’ আর যায় কোথায়! আঙুল তুলে ম্যাডাম শাসাতে শুরু করলেন, ‘‘হু আর ইউ? আমাকে বার করে দেখান।’’ অফিসারও প্রার্থীর মুখের উপর বলে বসলেন, ‘‘হু আর ইউ?’’ এর পর নান্দাভাঙা, কাঙ্গনবেড়িয়াতেও একই ঘটনা। সোনালি উত্তেজিত হয়ে বলেছেন, ‘‘আধাসেনা বাড়াবাড়ি করছে। বড়গগন গোহালিয়া হাইস্কুলের বুথে পুলিশ লাঠিচার্জ করেছে!’’
ছুট ছুট! কিন্তু বুথে পৌঁছে অন্য ছবি। সংবাদমাধ্যমের কাছে নেত্রীর অভিযোগ শুনে স্থানীয়দের একাংশই ফুঁসে উঠলেন, ‘‘কোনও লাঠিচার্জ হয়নি। রাস্তা করার নাম নেই, জল দেওয়ার নাম নেই, আবার মিথ্যে কথা! আসুন না এ দিকে, ঠ্যাং খোঁড়া করে দেব!’’ ও দিকে তখন খবর এসেছে, পানীয় জলের দুরবস্থা নিয়ে ক্ষোভে ঝিকুরবেড়িয়া বড়-কাছারির প্রায় ১০০ পরিবার ভোট বয়কট করেছে।
এক সময়ে থানায় ঢুকে ডিউটি অফিসারকে অবলীলায় চমকেছেন। সেই সোনালিই এ বার যেন একটু থতমত। দ্রুত ঢুকে পড়লেন কাঙ্গনবেড়িয়ার পঞ্চায়েত প্রধান পুতুল গায়েনের বাড়ি। ঘন-ঘন ফোন আসছে বা ফোন করছেন। আর মেঘ জমছে মুখে। কাকে একটা বললেন, ‘‘মার, মার, মার, মার! এই শেষ আমাকে উতরে দে।’’ তখন অবশ্য ‘সিপিএম এজেন্ট’-এর কথাটা বলেননি। সেটা বললেন আরও কিছুটা পরে।
ওই ১০৯ নম্বর বুথে ঘণ্টাখানেক ইভিএম খারাপ ছিল। সেখানে পৌঁছে আচমকা জানালেন, যতক্ষণ না যন্ত্র সারানো হচ্ছে, তিনি অনশনে বসবেন। পাশ থেকে এক জন কানে-কানে কিছু বলতে উক্তি সংশোধন করে নেত্রীর বক্তব্য, ‘‘অনশন নয়, আমি অবস্থান করব।’’ ওই অবস্থান চলাকালীনই বিরোধী এজেন্টদের মেরে বার করে দেওয়ার কথা বলে বসলেন মোবাইলে।
টিভি চ্যানেলে ওই ফুটেজ ছড়িয়ে পড়তেই সোনালিকে একান্তে ডেকে ফিসফাস শুরু করলেন দলীয় নেতারা। মুখের রেখা বদলাতে লাগল। বিদায়ী বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার বলতে লাগলেন, ‘‘আমি কখন বললাম? আমি তো বলিনি!’’ আরও কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনার পর গম্ভীর মুখে অটোতে উঠে সপার্ষদ চলে গেলেন চক এনায়েৎনগরে ব্লক সহ-সভাপতি নইম মিস্ত্রি-র বাড়ি। এক সময় খবরটা এল। ওই মন্তব্যের জেরে কমিশনের নির্দেশের তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের হয়েছে। শুনে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন— ‘‘নির্বাচন কমিশন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে শো-কজ করে, সেখানে আমি তো চুনোপুঁটি। তবে মানুষ এর জবাব দেবে।’’
তবে এর পর আর কোনও বুথে গেলেন না সোনালি। প্রায় দু’ঘণ্টা ওই বাড়িতে কাটিয়ে তিনটে নাগাদ গুটিকতক সঙ্গীর সঙ্গে ফের অটোয় চড়ে প্রায় লুকিয়ে চলে গেলেন দলের এক স্থানীয় নেতার ফ্ল্যাটে। চোখের সামনে তিনি ফ্ল্যাটে ঢুকলেন। অথচ এক মহিলা তার কিছু ক্ষণের মধ্যে ওই ফ্ল্যাটের দরজা অল্প ফাঁক করে জানালেন, সোনালি গুহ ফ্ল্যাটে আসেননি।
সোনালি অদৃশ্য হলেন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy