নির্বাচনের কাজে ব্যস্ত ভোটকর্মীরা। —নিজস্ব চিত্র।
আইপিএলের দৌলতে ‘স্লগ ওভার’ কথাটি অধুনা খুবই জনপ্রিয়। ইনিংসের শেষ বেলায় ব্যাটসম্যানের ধূমধাড়াক্কা ব্যাটিং, চার-ছয়ের বন্যা নিমেষে বদলে দিতে পারে ম্যাচের ভাগ্য। আবার দ্রুত উইকেট পতনে মুখ থুবড়ে পড়তেও সময় লাগে না। এই দীর্ঘ নির্বাচন পর্বের স্লগ ওভারে নির্বাচন কমিশনের কার্যকলাপ নিয়ে মহামান্য মাদ্রাজ হাইকোর্টের বারুদগন্ধী রায় দেখে ক্রিকেটের উপমাটা মনে পড়ে গেল। স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতের ইতিহাসে একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান আরেকটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে খুনের মামলা রুজু করার নিদান দিচ্ছেন— এমনটা আগে কখনও হয়েছে কি না তা নিয়ে আগ্রহীরা ইতিহাস ঘাঁটতে পারেন। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, এই রায় অন্তত কয়েক দিনের জন্য জনজীবনে আলোড়ন তুলতে পেরেছে। কিন্তু এই আলোড়নপর্ব শেষ হওয়ার পর যদি আমরা ঠান্ডা মাথায় হিসাব মেলাতে যাই তবে দেখব, হাতে রইল নিছকই পেনসিল। কারণ এই পর্যবেক্ষণ নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত করতে পারবে না, আরেকটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের আচরণ সংহিতার কোনও পরিবর্তনের কথাও এখানে নেই, আর জনজীবনের যে ক্ষতির কথা এখানে বলা হয়েছে তা পূরণ করার দায়ও কারোর নেই। বরং এ কথা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, এই পর্যবেক্ষণ আদতে নির্বাচন কমিশনের তুঘলকি কাজকর্মের বিরুদ্ধে জনমানসে যে বিরুদ্ধতা তৈরি হয়েছে তাকে শীতল করার এক কৌশলী প্রয়াস মাত্র।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলির নিরপেক্ষতা নিয়ে তৈরি হওয়া একাধিক প্রশ্নচিহ্ন। সরকারি এজেন্সিগুলি, যেমন সিবিআই, ইডি দিয়ে বিরোধী পক্ষকে চমকে দেওয়া, ইচ্ছেমতো তদন্তের গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করা, মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ইতিহাস বহু পুরানো। কিন্তু যা নতুন, তা হল— এত দিন যে সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর একটা ভরসা ছিল (বিশেষ করে আদালত) তাদেরও সরকারমুখী হয়ে ওঠা। আর তার চেয়েও কুৎসিত হল বিভিন্ন বিতর্কিত রায় তথা সিদ্ধান্ত যাঁরা দিচ্ছেন, তাঁদেরকে সরকারের পক্ষ থেকে প্রাইজ পোস্টিং দেওয়া। তাই এই তথ্য আমাদের অবাক করে না যখন দেখি, বিধানসভা নির্বাচন কর্মসূচি যে নির্বাচন কমিশনারের নেতৃত্বে তৈরি হয়েছে তিনি অবসর গ্রহণ করা মাত্র একটি রাজ্যের রাজ্যপাল নিযুক্ত হন। এই প্রেক্ষিতটিকে বাদ দিয়ে শুধুই নির্বাচন কমিশনের কাজকে অগ্নিবর্ষী ভাষায় সমালোচনা করা আসলে ভাবের ঘরে চুরি।
এই করোনাকালে এ কথা কারও অজানা ছিল না যে, কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ ভারতবর্ষে আছড়ে পড়তে চলেছে এবং তার মোকাবিলা করার মতো পরিকাঠামো তৈরির জন্য যা যা করা দরকার তা করতে ভারত সরকার নিদারুণ ব্যর্থ। পরীক্ষা, হাসপাতালের শয্যা, অক্সিজেন, টিকা— সব কিছুর নিদারুণ আকাল। নির্বাচন কমিশন এই পরিস্থিতিতে ভোট পিছোতে পারত, যা সে কখনই বিবেচনার মধ্যে আনেনি। বদলে পশ্চিমবঙ্গে ৮ দফার নির্বাচনপর্ব ঘোষিত হল। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবতা রহিত, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই, এটি ছিল পরিকল্পিত। সূচি ঘোষণার পর এক পক্ষের উল্লাস আমরা এখনো ভুলে যাইনি। এর পর কোভিড স্বাস্থ্যবিধি মেনে নির্বাচনে প্রচার করার হুকুম দেওয়া এক নিদারুণ পরিহাস। বাস্তবে, পিছনে যাঁদের ভোট তাঁরা প্রচারের জন্য দীর্ঘ সময় পেলেন। যত বেশি দিন, তত বেশি প্রচার, তত বেশি সভা, তত বেশি জমায়েত, তত বেশি রোড শো, তত বেশি কোভিড সংক্রমণ। পরিসংখ্যান থেকে এটা পরিষ্কার, চতুর্থ পর্ব থেকে রাজ্যে সংক্রমণ চূড়ান্ত আকার ধারণ করেছে যার প্রধান কারণ ৮ পর্বের ভোট। আরও মজার কথা হল, আগে নেতা-নেত্রীরা ঘোষণা করলেন বড় সভা বন্ধের কথা তার পর কমিশনের ঘুম ভাঙল। আবার দেখা গেল, একটা জেলার ভোটপর্ব দু’দিন ধরে মেটানো হচ্ছে ফলে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক জমায়েত একটা জেলায় আরো বেশি দিন স্থায়ী হল।
এক মাস ধরে নির্বাচন পর্ব চলল,নির্বাচন কমিশন প্রস্তুতির যথেষ্ট পাওয়া সত্ত্বেও ভোটগ্রহণের দিনগুলোতে পর্বতের মূষিক প্রসব হল। আর এই অব্যবস্থার সবচেয়ে বড় শিকার হলেন ভোটকর্মীরা। এমনিতেই যাঁদের ভোটের ডিউটি সম্বন্ধে সামান্য অভিজ্ঞতা আছে, তাঁরা জানেন এত জটিল, বিশৃঙ্খল ও কঠিন ডিউটি আর নেই। তবুও চাকরি বাঁচাতে তাঁরা যান ও গণতন্ত্রের উৎসবে বিরস বদনে প্যান্ডেল বাঁধেন। এবার তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল কোভিড সংক্রমণের ভয়। সেখানেও দেখা গেল কমিশনের চূড়ান্ত ব্যর্থতা। ডিসিআরসি-তে (ভোটের উপকরণ নেওয়া ও জমা দেওয়ার কেন্দ্র) হাজার হাজার ভোটকর্মীর জমায়েত, গন্ডগোল, একটা বাসে একাধিক পোলিং পার্টি, প্রাথমিক স্কুলের একটা ঘরে চারজনে গাদাগাদি করে রাত্রিবাস, আবার ভোট নিয়ে জমা দেওয়ার সময় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। কোভিডের সর্বব্যাপ্ত সংক্রমণের জন্য আদর্শ পরিবেশ। ইতিমধ্যেই ভোটকর্মীদের সংক্রমণের খবর আসতে শুরু করেছে, কয়েক জনের মৃত্যুর খবরও জানা গেছে। তাই মহামান্য আদালত যদি অবস্থার পরিবর্তন চান তবে ভাবতে হবে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়ার খোলনলচে বদলানোর কথা, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার উপায়ের কথা, কী ভাবে গোটা পদ্ধতিকে সহজ করা যায় তার কথা, কী ভাবে ভোটকর্মীরা কাজের আদর্শ পরিবেশ পান তার কথা। আর তা না করে খুনের মামলার হুমকি দিলে তাতে মিডিয়ায় ফুটেজ পাওয়া যাবে, কাজের কাজ কিছু হবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy