Advertisement
২৭ নভেম্বর ২০২৪

নবাবের কেন্দ্রে গোঁজেরই গল্প চলে বামে-ডানে

জোটের হিসেব যা ছিল, তা ছিল। তার বাইরে গিয়ে সিপিএমের বাড়তি ‘গলার কাঁটা’ হয়েছে মুর্শিদাবাদ। যেখানে সিপিএমের অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফরওয়ার্ড ব্লকের বিভাস চক্রবর্তীর নাম ঘোষণা করতে হয়েছে, যদিও স্থানীয় নেতাকর্মীরা রয়েছেন কংগ্রেস প্রার্থীর সঙ্গেই।

অনল আবেদিন
লালবাগ শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০১৬ ০২:০৩
Share: Save:

জোটের হিসেব যা ছিল, তা ছিল। তার বাইরে গিয়ে সিপিএমের বাড়তি ‘গলার কাঁটা’ হয়েছে মুর্শিদাবাদ। যেখানে সিপিএমের অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফরওয়ার্ড ব্লকের বিভাস চক্রবর্তীর নাম ঘোষণা করতে হয়েছে, যদিও স্থানীয় নেতাকর্মীরা রয়েছেন কংগ্রেস প্রার্থীর সঙ্গেই। শেষ পর্যন্ত বিভাস যদি মনোনয়ন প্রত্যাহার না করেন, তবে তাঁকে কী বলা যাবে? ‘গোঁজ’?

সত্যি বলতে, মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে শরিকি গোঁজের ইতিহাস বেশ পুরনো এবং এ বারও ভবি ভুলবার নয়! প্রায় তিন দশক ধরে ওই কেন্দ্রের ভোটে ছায়া ফেলে এসেছে ‘গোঁজ’। ১৯৮৭ সালে তার শুরু। সে বার বামফ্রন্টের প্রার্থী ছিলেন ফরওয়ার্ড ব্লকের তৎকালীন জেলা সম্পাদক তথা বিধায়ক ছায়া ঘোষ। তাঁর বিরুদ্ধে ‘গোঁজ’ হিসেবে দাঁড়ান সিপিএমের জোনাল সদস্য মদন রায়।

এর পরে আরও পাঁচ বার বিধানসভা নির্বাচন হয়েছে। তার মধ্যে ১৯৯১ ও ২০১১ সাল বাদ দিলে বাকি সব বারই ওই কেন্দ্র গোঁজ প্রার্থীর দাপট অব্যাহত ছিল। পাঁচ বারের মধ্যে ফরওয়ার্ড ব্লকের বিরুদ্ধে সিপিএমের গোঁজ ছিল দু’বার— ১৯৮৭ ও ১৯৯৬ সালে। গোঁজের হুলে দু’বার ঘায়েলও হয়েছেন প্রাক্তন ত্রাণমন্ত্রী ছায়া ঘোষ। কেবল তিনি হারেনইনি, ছিটকে গিয়েছিলেন একেবারে তৃতীয় স্থানে।

ব্যতিক্রমী ও বিচ্ছিন্ন কয়েকটি বছর বাদ দিলে অধিকাংশ সময়েই এই জেলায় বামফ্রন্টের দুই শরিক— সিপিএম এবং ফরওয়ার্ড ব্লকের মধ্যে ‘অহি-নকুল’ সম্পর্কই গোঁজের উৎস। উল্টো দিকে, তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসেরও আদায়-কাঁচকলায়। তার পরিণতিতে ২০০১ ও ২০০৬ সালে কংগ্রেস-তৃণমূল জোটপ্রার্থীর বিরুদ্ধে গোঁজ দাঁড় করিয়েছিল কংগ্রেস। গোঁজ জিততে না পারলেও তৃণমূলের নাক কাটা গিয়েছে। দু’বারই তৃতীয় স্থান পেয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে তাদের।

এ বার কিন্তু ফের বাম গোঁজেরই সম্ভাবনা প্রকট হচ্ছে।

বামফ্রন্টের শরিক হিসাবে ১৯৭৭ সালে ও ১৯৮২ সালে পরপর দু’বার মুর্শিদাবাদ কেন্দ্র থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হন ফরওয়ার্ড ব্লক নেত্রী ছায়া ঘোষ। সেই সুবাদে বিধানসভা এলাকায় দলীয় সংগঠনে জোয়ার আসে। সেই সঙ্গে আসে বড় শরিক সিপিএমের বৈরিতাও। রানিনগর, ইসলামপুর ও মুর্শিদাবাদ— এই তিন থানা এলাকা জুড়ে দুই শরিকের মধ্যে সংঘর্ষ, বাড়িঘরে আগুন লাগানো, খুন-জখম ও লুঠতরাজ প্রাত্যহিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। তার পরিণতিতেই ১৯৮৭ সালের নির্বাচনে বামফ্রন্টের প্রার্থী ছায়া ঘোষের বিরুদ্ধে গোঁজ প্রার্থী হিসাবে ‘তির ধুনক’ প্রতীকে দাঁড়ান সিপিএমের মদন রায়।

বামফ্রন্টের সিদ্ধান্ত অমান্য করায় মদন রায়কে খাতায়-কলমে বহিস্কার করেছিল সিপিএম। কিন্তু তিনিই দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। গোঁজের হুলে বিধায়ক নির্বাচিত হন কংগ্রেসের মান্নান হোসেন। পরের ভোট ১৯৯১ সালে। এ বার গোঁজ না থাকায় ফের জিতে ছায়াদেবী হন ত্রাণমন্ত্রী। কিন্তু ১৯৯৬ সালে, পরের ভোটে সেই ত্রাণমন্ত্রীকেই হারাতে সিপিএমের লালবাগ জোনাল সদস্য মোজাম্মেল হক ‘তির ধনুক’ নিয়ে নির্দল প্রার্থী বনে যান। এ বারও সিপিএম নির্দল মোজাম্মেল হককে বহিষ্কার করে। কিন্তু তিনিই ভোটে জিতে বিধায়ক হন, ছায়া ঘোয ফের তৃতীয় স্থানে। পরের বার, ২০০১-এ কংগ্রেস-তৃণমূল জোটবদ্ধ হয়। সেই জোট মানতে চাননি তদানীন্তন জেলা কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। তৃণমূলের মহম্মদ আলিকে ঠেকাতে নলকূপ প্রতীকে নির্দল হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন অধীরের মদতে পুষ্ট মান্নান হোসেন। আজকের জেলা তৃণমূল সভাপতি মান্নান সে দিন তৃণমূল প্রার্থীকে তৃতীয় স্থানে ঠেলে দিয়ে ছায়া ঘোষের জয়ের পথ প্রসস্ত করেন। কংগ্রেসের গোঁজের কল্যাণে জিতে ছায়াদেবী এ বার কৃষি বিপণন মন্ত্রী হন। ২০০৬ সালের ভোটেও গোঁজের কাঁটা এড়াতে পারেনি এই কেন্দ্র। তার আগের বছরই দল থেকে বহিস্কৃত হন ফরওয়ার্ড ব্লকের তদানীন্তন জেলা সভাপতি জয়ন্ত রায় এবং সম্পাদক ছায়া ঘোয। ফলে, সে বার ওই কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন দলের নতুন জেলা সম্পাদক বিভাস চক্রবর্তী।

এ বারও তৃণমূল এবং কংগ্রেসের জোটের বিরুদ্ধে নামেন অধীর। ওই কেন্দ্রে জোটের প্রার্থী, তৃণমূলের আদ্যাচরণ দত্তকে হারাতে কুড়ুল প্রতীকে নির্দল প্রার্থী হয়ে দাঁড়ান সদ্য ফরওয়ার্ড ব্লক থেকে বিতাড়িত জয়ন্ত রায়। নেপথ্যে অধীর। কুড়ুলের কোপে ফের তৃণমূল তৃতীয় আর বিভাস বিধায়ক।

সেই বিভাসই এ বার সিপিএম-কংগ্রেস জোটের প্রার্থী শাওনী সিংহ রায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। জেলা সিপিএমের চাপ সত্ত্বেও ঢোঁক গিলে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু তাঁর নাম ঘোষণা করেছেন। বিভাসের দাবি, ‘‘দু’দিন আগেও জেলা বামফ্রন্ট বৈঠকে বলা হয়েছে আমিই ওই কেন্দ্রে বাম প্রার্থী।’’ যদিও বাস্তবে শাওনীর পিছনেই রয়েছে সিপিএম। ইতিমধ্যে শাওনীর জন্য তারা জিয়াগঞ্জের দেওয়াল ভরিয়ে ফেলেছে। আজ, মঙ্গলবার জিয়াগঞ্জে বাম-কংগ্রেসের যৌথ কর্মিসভাও রয়েছে।

মুর্শিদাবাদের কংগ্রেস পুরপ্রধান বিপ্লব চক্রবর্তীর অভিযোগ, ‘‘টাকা খেয়ে তৃণমূলের সুবিধা করিয়ে দিতে জোট প্রার্থীর বিরোধিতায় নেমেছেন বিভাস চক্রবর্তী।’’ বিভাসের পাল্টা দাবি, ‘‘ভয় পেয়ে ডাহা মিথ্যা বলছে কংগ্রেস। টাকা খাওয়ার প্রমাণ দিক। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াব। নইলে কংগ্রেসকে ক্ষমা চাইতে হবে।’’

নারদ! নারদ!

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy