প্রচারে নেত্রী। শনিবার কলকাতা বড়বাজারের সত্যনারায়ণ পার্কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: প্রদীপ আদক।
নির্বাচন কমিশন বিধিভঙ্গের নোটিস দিল মুখ্যমন্ত্রীকে। অথচ তাঁর হয়ে জবাব পাঠালেন মুখ্যসচিব!
রাজ্য প্রশাসনের একটি অংশের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী ভোট প্রচারের মঞ্চ থেকে যা বলেছেন, তা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বক্তৃতা। যার উদ্দেশ্য ভোট চাওয়া। ওই বক্তৃতার জন্য নির্বাচন কমিশন তাঁকে কোনও নোটিস পাঠালে প্রশাসন গায়ে পড়ে তার অংশীদার হতে পারে না। মুখ্যমন্ত্রী বাধ্য করলেও প্রশাসনের কর্তাদের তা না-শোনা উচিত। অথচ সেই অনুচিত কাজটাই করেছেন বর্তমান মুখ্যসচিব!
আর এই ঘটনায় ফের স্পষ্ট হয়ে গেল, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনে বাংলায় নিয়ম-নীতি মানার বালাই নেই! মমতার ইচ্ছাই শেষ কথা। আর একাধিক শীর্ষ আমলা নিজেদের মেরুদণ্ড বন্ধক রেখেছেন তাঁর কাছে!
অথচ এর উল্টো ছবিও দেখা গেছে এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানাতেই! মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেই নিজের অতি ঘনিষ্ঠ গৌতম সান্যালকে প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি করতে চেয়েছিলেন মমতা। কিন্তু প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারির মতো ক্যাডার পোস্টে গৌতম সান্যালকে বসাতে নারাজ তৎকালীন মুখ্যসচিব সমর ঘোষ সরাসরি খারিজ করে দিয়েছিলেন মমতার ইচ্ছেকে। তার ক’দিনের মধ্যেই ফের মমতা-সমর দ্বন্দ্ব! সিঙ্গুর আইন নিয়ে প্রবল আপত্তি সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়েছিলেন সমরবাবু। ওই আইন কেন করা যায় না, করলেও কেন আদালতে তা ধাক্কা খাবে, তা বিশদে বুঝিয়ে সিঙ্গুর আইন করতে রাজি হননি সমরবাবু। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী তা শুনলে তো! সমর ঘোষকে এড়িয়েই সিঙ্গুর আইন তৈরি করে পাশ করিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। সেই সিঙ্গুর আইন কিন্তু এখন আইনের জালে বন্দি হয়ে সুপ্রিম কোর্টে আটকে! সচিব পর্যায়ের কয়েক জন অফিসারের বদলিকে কেন্দ্র করেও মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছিলেন সমরবাবু।
সেই ছবিটাই বদলেছে পরবর্তী সময়ে। ভোট-প্রচারে বর্ধমানে গিয়ে আসানসোলকে পৃথক জেলা করার কথা বলেছিলেন মমতা। প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে ওই সভায় তাঁর আরও কয়েকটি মন্তব্য নিয়ে শোকজ করেছিল নির্বাচন কমিশন। যা শুনে ওই দিনই মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘বেশ করেছি, বলেছি! আবার বলব। হাজার, লক্ষ, কোটি বার বলব। যা ক্ষমতা থাকে, করো!’’
নবান্নে, মুখ্যমন্ত্রীর নামে সেই নোটিস আসার পরেই তাঁর হয়ে প্রবল উৎসাহে ব্যাট ধরেন মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়। নোটিসের যে লিখিত জবাব তিনি দেন, তাতে সরকারের হয়ে যুক্তির পাশাপাশি ছিল কমিশনের উদ্দেশে তীক্ষ্ণ কটাক্ষ! যা নিয়ে স্তম্ভিত, ক্ষুব্ধ কমিশন কড়া পদক্ষেপ করার কথাও ভাবছে বলে একটি সূত্রের দাবি।
নির্বাচন কমিশন যা করবে, তা পরের কথা। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীকে পাঠানো নোটিসের জবাব যে ভাবে এবং ভাষায় মুখ্যসচিব দিয়েছেন, তাকে মোটেই ভাল চোখে দেখছেন না রাজ্যের প্রাক্তন আমলারা। প্রাক্তন মুখ্যসচিব অমিতকিরণ দেব এ দিন বলেন, ‘‘মুখ্যসচিবের জবাব দেওয়ার কথা নয়। মুখ্যমন্ত্রী ভোটের প্রচারে গিয়ে রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে কিছু বলেছেন। এটা তাঁর ব্যক্তিগত দায়। তাঁকে নোটিস পাঠানো হয়েছে। তাই উত্তরও দিতে হবে তাঁকেই।’’ আর এক প্রাক্তন মুখ্যসচিব অর্ধেন্দু সেনের মতে, ‘‘মুখ্যসচিবের বক্তব্যে হয়তো যুক্তি থাকতে পারে। কিন্তু নোটিসের উত্তর মুখ্যমন্ত্রী নিজে অথবা তাঁর দল দিলেই ভাল হত। এটা ‘অড’ লাগল।’’ প্রাক্তন মুখ্যসচিব অশোকমোহন চক্রবর্তী অবশ্য বলেন, ‘‘যে বিষয় নিয়ে নোটিস দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে না কি আগেই মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে। মুখ্যসচিব মন্ত্রিসভারও সচিব। সেই হিসেবে তিনি কমিশনকে তথ্য জানাতে পারেন। তবে এর বাইরে নোটিসের জবাবে তিনি আরও যা যা লিখেছেন বলে সংবাদপত্রে দেখেছি, তা নিয়ে মন্তব্য করব না।’’ সমর ঘোষ অবশ্য এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্যই করতে চাননি।
রাজ্যের শীর্ষ আমলার ভূমিকায় ক্ষুব্ধ বিরোধীরাও। বিজেপির তিন প্রতিনিধি শিশির বাজোরিয়া, জয়প্রকাশ মজুমদার এবং অসীম সরকার শনিবার রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক সুনীল গুপ্তর সঙ্গে দেখা করেন। বিজেপি নেতাদের বক্তব্য, মমতা মুখ্যমন্ত্রী হলেও কমিশন বিধি ভঙ্গের জন্য শোকজ করেছে তৃণমূল নেত্রী মমতাকে। জবাব তাঁরই দেওয়া উচিত ছিল। তা না করে মুখ্যসচিবকে দিয়ে জবাব পাঠিয়ে আর এক দফা নির্বাচনী বিধি ভঙ্গ করেছেন মমতা। তাঁরা মুখ্যসচিবকে শোকজ করারও দাবি জানান। বিজেপি নেতাদের ব্যাখ্যা, কোনও মন্ত্রীই যে ভোটের সময় সরকারি প্রশাসনকে ব্যবহারের অধিকারী নন, তা ২০১৪ সালে কমিশনই জানিয়েছে। মুখ্যসচিবকে দিয়ে জবাব পাঠিয়ে মমতা ওই বিধি ভেঙেছেন। একই সঙ্গে তাদের বক্তব্য, ১৯৭৫ সালের ১২ জুন ইন্দিরা গাঁধীকে নির্বাচনে বেআইনি কাজকর্মের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে ইলাহাবাদ হাইকোর্ট। আদালত রায়বরেলীর নির্বাচন বাতিল করে দিয়েছিল। তখন আদালতের বক্তব্য ছিল, ইন্দিরা ভোটে জিততে সরকারি যন্ত্রকে ব্যবহার করেছেন। শিশির-জয়প্রকাশদের প্রশ্ন, ওই ঘটনায় ইন্দিরা দোষী হলে এ ক্ষেত্রে মমতা দোষী হবেন না কেন? জয়প্রকাশবাবু বলেন, ‘‘ভোটের পর প্রয়োজন হলে এ ব্যাপারে আমরা আদালতে যাব।’’
সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিমের প্রশ্ন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীকে কমিশন চিঠি দিলে কি কেন্দ্রীয় সরকারের ক্যাবিনেট সচিব জবাব দেন?’’ তাঁর আরও বক্তব্য, মুখ্যসচিব চাইলে এটা এড়িয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু এই জমানায় সরকারের আধিকারিকেরা স্বাধীন চিন্তাশক্তি হারিয়েছেন।
পাল্টা হিসেবে তৃণমূল নেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের যুক্তি, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ। তাঁর হয়ে মুখ্যসচিব উত্তর দিতেই পারেন। রাজনৈতিক নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখানে কোনও বিষয় নয়।’’
কিন্তু নির্বাচন কমিশনই বা তৃণমূল নেত্রী মমতার বদলে মুখ্যমন্ত্রীকে শোকজ নোটিস পাঠাল কেন? নির্বাচন সদন শনিবার জানিয়েছে, মমতা রাজ্য সরকারের মাথা হিসেবে আসানসোলের সভায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাই তাঁকে শোকজ-এর চিঠি পাঠানো হয়েছে সরকারের সদর দফতরে।
নবান্নের পাল্টা যুক্তি, যে হেতু মুখ্যমন্ত্রীর নামে নোটিস এসেছে নবান্নে, তাই এটা রাজ্য সরকারের বিষয়। সেই কারণেই সরকারের তরফে উত্তর দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া, যে সব বিষয়ে বিধিভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়েছে, তা ছিল প্রশাসনিক পদক্ষেপ। সরকারের উত্তরও সেই কারণেই। নবান্নের যুক্তি, নোটিসের জবাব দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে সমর্থন জানানো হয়েছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নয়।
পাল্টা হিসেবে বিহার ভোটের প্রসঙ্গ টেনে বিরোধীরা বলছেন, বিহার ভোটের সময় বিধিভঙ্গের অভিযোগে ‘নরেন্দ্র মোদী, প্রধানমন্ত্রী’র নামে নোটিস দিয়েছিল কমিশন। তার উত্তর দিয়েছিল বিজেপি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy