Advertisement
২৭ নভেম্বর ২০২৪

আর কেউ ডাকেন না, তুলি আঁকড়ে বসেই থাকেন বাবু

—এর থেকে তো কেউ বুড়ো আঙুলটা কেটে দিলে ভাল হতো! চৈত্রের দুপুরে সামনের মাচাটায় বসে হা-হুতাশ করছিলেন বাবুলাল মণ্ডল। এক সময়ে বাবু কেবল ‘আর্টিস্ট’ নামেই পরিচিত ছিলেন না, তাঁর আর্ট-এর বেশ নামডাকও ছিল গোটা ডোমকল এলাকায়।

সুজাউদ্দিন ও কল্লোল প্রামাণিক
শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০১৬ ০২:০৬
Share: Save:

—এর থেকে তো কেউ বুড়ো আঙুলটা কেটে দিলে ভাল হতো!

চৈত্রের দুপুরে সামনের মাচাটায় বসে হা-হুতাশ করছিলেন বাবুলাল মণ্ডল। এক সময়ে বাবু কেবল ‘আর্টিস্ট’ নামেই পরিচিত ছিলেন না, তাঁর আর্ট-এর বেশ নামডাকও ছিল গোটা ডোমকল এলাকায়। লোকে বলত তাঁর তুলির টানে নাকি জাদু আছে। তাঁকে দিয়ে ফেস্টুন বা বোর্ড লিখিয়ে নেওয়ার জন্য হত্যে দিয়ে পড়ে থাকত পার্টির ছেলেপিলেরা। অথচ সময়ের ফেরে সেই বাবুর হাতে এখন কাজ নেই।

বাবুলাল একা নন। তাঁর মতো হাজারও রংতুলি শিল্পীর এক অবস্থা। সারা বছর আয় বলতে দোকানের সাইনবোর্ড, মোটরবাইকের নম্বর প্লেট লিখে যা দু’পয়সা মেলে। সেটাও পড়তির মুখে। ভোটের সময়টার দিকে হাপিত্যেশ করে তাকিয়ে থাকতেন শিল্পীরা। এ বার টান পড়েছে তাতেও। অনেকে রাতারাতি পেশাই বদলে ফেলেছেন। কেউ কেউ আবার যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলে ফেলেছেন পেশার ধরন। আর বাবুলালের মতো আর্টিস্টরা আধপেটা খেয়ে হলেও এখনও রংতুলির বাক্সটাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে রয়েছেন।

কিন্তু বছর কয়েক আগেও ছবিটা এ রকম ছিল না। মফস্‌সলের শহরগুলোতে তখনও ফ্লেক্সের চলন আসেনি। বাবুলালদের বাজার রমরমা। দু’হাতে তুলি চলেছে। ভোটের সময়ে পার্টির ছেলেগুলো হাতেপায়ে ধরেছে। নেতারাও বাবা-বাছা করে কাজ করিয়েছেন। টাকাপয়সা নিয়ে দর কষাকষি তো দূরে থাক। আর এ বারের ভোটে তাঁরাই কি না প্রায় হাত গুটিয়ে বসে রয়েছেন।

বাবুর মতো একটা সময় এক ডাকে গোটা এলাকা চিনত দিপক চৌধুরী ওরফে বাচ্চুকে। তাঁর হাতের লেখার কদরও ছিল ভাল। দেওয়াল লেখা হলেই ডাক পড়ত বাচ্চুর। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেননি তিনি। এখনও রংতুলিই প্রাণ। আর তাই সংসারে অনটনও নিত্যসঙ্গী।

বললেন, ‘‘কী আর করব বলুন? সবই কপালের ফের। আমরা যাঁরা এখনও রংতুলি আগলে বসে, তাঁরা আধপেটা খেয়ে দিন কাটাচ্ছি। আর কেউ কদর করে না আমাদের। আধুনিকতার ছোঁয়ায় তুলির টান হারিয়েছে। অথচ একটা সময় ভোটের মরশুমে নাওয়া-খাওয়ার সময় হতো না। খালি হাতে ফিরিয়ে দিত অনেককে। বড় বড় কাপড়ের ফেস্টুন, বোর্ড লিখে ভাল রোজগারও হতো। দু’বেলা মাছভাত জুটত তাতে।’’

তবে কেন এমন হাল?

উত্তরটা দিলেন ডোমকলের আর এক শিল্পী, জালালউদ্দিন। তাঁর কথায়, ‘‘যুগের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চাহিদা বেড়েছে, পছন্দ বদলেছে। লেখার পাশে নিজের মুখের ছবিটাও এখন দেখতে চাইছেই প্রার্থীরা। তা ছাড়া কাপড়ে-রংতুলিতে লিখতে যা খরচ, তার থেকে কম খরচে ফ্লেক্সে প্রিন্ট হয়ে যাচ্ছে। সেখানে নানা রংয়ের পাশাপাশি কম্পিটরের সাহায্যে বাহারি নক্সাও হচ্ছে। এমনকী থ্রি-ডি, ফোর-ডি প্রিন্ট হচ্ছে, যেটা রংতুলিতে সম্ভব নয়।’’

একই বক্তব্য করিমপুরের আর একজন ফ্লেক্স প্রস্তুতকারক বাপ্পাদিত্য চৌধুরী। জানালেন, ২০১৩ পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকে ফ্লেক্সের চাহিদা খুব বেড়েছে। তার আগে কলকাতা থেকে হাতে গোনা কয়েকটি ফ্লেক্স আসত। এখন অর্ডার দেওয়ার দশ ঘণ্টার মধ্যে তৈরি ফ্লেক্স পেয়ে যাচ্ছেন। শুধু তা-ই নয়। বললেন, ‘‘একটা দেওয়াল লিখতে গেলে রঙ ও শিল্পীর মজুরি দিতেই অনেক টাকা লাগতো। ৬ ইঞ্চি x ৪ ইঞ্চি একটা ফ্লেক্স বানাতে মাত্র দেড়শ টাকা খরচ হচ্ছে। তাই সব রাজনৈতিক দল এ দিকেই ঝুঁকছে।’’

এক নেতাই যেমন বললেন, “ও সব দেওয়াল লেখার অনেক হ্যাপা। আগে সেই দেওয়াল দখল করে চুন করতে হবে। তার পর শিল্পীদের রঙ কিনে দিলে তাঁরা লিখবেন। তাঁদের মজুরিও রয়েছে। বৃষ্টির জলে ধুয়ে গেলে তো হয়ে গেল...। ফ্লেক্সে এ সবের বালাই নেই। সকালে গিয়ে অর্ডার দিলেই বিকেলে হাতে পেয়ে যাচ্ছি।’’ তা ছাড়া কারও বাড়ির দেওয়ালে লিখতে গেলে মালিকের অনুমতি নেওয়ার ব্যাপারটাও থাকে। গ্যাঁটের কড়ি খসিয়ে বাড়ি রং করে
সেই দেওয়ালে কেন কেউ লিখতে দেবে! কোথাও ফ্লেক্স বাঁধা নিয়ে আপত্তি থাকলে, খুলে অন্যত্র লাগিয়ে দিলেই হল।

দেওয়াল লিখিয়েদের তাই ডাকই পড়ছে না। আর যদি বা কাজ মেলে পকেট ভরছে না। করিমপুরের এক শিল্পী সুজিত সরকারের কথায়, “বছর দশেক আগে দিনরাত দেওয়াল লিখেও কাজ শেষ করতে পারতাম না।
দুপুরে বাড়িতে খাওয়া তো দুরের কথা, রাতে বাড়িতে ফেরা হত না কত দিন। শিল্পীর চাহিদা মত ভাল রোজগার ছিল। কিন্তু এখন সেই দিন শেষ। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনেও প্রতি দিন দশ ঘণ্টার কাজে হাজার টাকা পেতাম। এ বারের রেট প্রার্থীর
নাম ও চিহ্ন দেওয়ালে এঁকে মাত্র একশো টাকা।”

যুগের চাহিদা মেনে তাই নিজেকে বদলে ফেলেছেন ডোমকলের প্রদীপকুমার শীল। বললেন, ‘‘সন্দেহ নেই রংতুলিতে কাজ করার একটা অন্য মজা। ভাল কাজ করার পর একটা অন্য রকম তৃপ্তি হতো। কিন্তু একটা সময় বুঝতে পারলাম, খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে এই জগতটা। আধুনিক প্রযুক্তির দৌলতে লেটার প্রেস বন্ধ হয়ে গেল। শহরে হাতে লেখার থেকে ফ্লেক্সের কদর বাড়ছে। বদলে ফেললাম নিজেকে। তুলি ছেড়ে এখন কম্পিটরের মাউস ধরেছি।’’ টগর আর্ট বললে সাগরপাড়া এলাকায় এক ডাকে চেনে সকলে। এলাকায় পা রাখলে তার রংতুলির ছোয়া এখনও দেওয়ালে দেওয়ালে দেখা যায়। আক্ষেপের সুরে বললেন, ‘‘খুব কম সময়ে বদলে গেল আমাদের পেশাটা। গত বিধানসভা নিবার্চনেও অনেক কাজ করেছি।’’

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy