টিম তৈরি। স্ট্র্যাটেজিও তৈরি। দশ জন বাঘা বাঘা খেলোয়াড় জেনে গিয়েছেন, তাঁদের কার কী কাজ। নির্বাচন কমিশনের লালকার্ড দেখে কোচ মাঠে নেই। কিন্তু তাতে কী? ওই স্ট্রাইকার-ডিফেন্ডাররা এতই বাধ্য, যে কোচের ‘দশ মাথা’ বলে ডাকা হয় তাঁদের। আর কোচও তো পুরোপুরি ধরাছোঁয়ার বাইরে নন। তাঁর ফোন খোলা থাকছে। শুধু তিনি বাইরে বেরোলে কয়েক জন সরকারি চাকুরে আর একটি ভিডিও ক্যামেরা তাঁকে ঘিরে থাকবে এই যা!
‘কোচ কেষ্টদা’র তাই কোনও টেনশন নেই! সে কমিশন শুক্রবার তাঁকে বিধানসভা ভোট শেষ না হওয়া পর্যন্ত নজরবন্দি রাখার নির্দেশ দিলেও নেই। সে কথা খুল্লমখুল্লা জানিয়েও দিচ্ছেন কেষ্টদা মানে অনুব্রত মণ্ডল এবং তাঁর সহচরেরা।
বিরোধীদের ‘ভ্যানিশ’ করে দেবেন বলেছিলেন। বুথে বিরোধী এজেন্ট বসতে দেবেন না বলেছিলেন। আনন্দবাজারে সেই খবর প্রকাশিত হতে কমিশন সূত্রে বলা হয়েছিল, বোলপুরের কেষ্টর এই কথাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিচ্ছে তারা। বৃহস্পতিবার মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নসীম জৈদী কলকাতায় এসে জানিয়ে গিয়েছিলেন, বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রতর বিরুদ্ধে ‘অতি দ্রুত জোরদার আইনি পদক্ষেপ’ করা হবে। কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানতে চাওয়া হলে বলেছিলেন, ‘‘খুব তাড়াতাড়ি আপনারা জেনে যাবেন।’’ তার পর এ দিন কমিশন জানায়, ভোট শেষ না হওয়া পর্যন্ত নজরবন্দি থাকবেন অনুব্রত।
কী ভাবে নজরবন্দি করা হবে তাঁকে?
নির্বাচন সদনের নির্দেশে বলা হয়েছে, এক জন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে কেষ্টর উপর সর্বক্ষণ নজরদারি চলবে। তাঁকে ঘিরে রাখবে কেন্দ্রীয় বাহিনী। এক জন ভিডিওগ্রাফার সারাক্ষণ নজরদারির ছবি ক্যামেরাবন্দি করবেন। নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত (১৯ মে ভোট গণনা) এই নজরদারি চলবে। শুক্রবার সন্ধ্যাতেই নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ পৌঁছে যায় রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসারের দফতরে। সেখান থেকে বীরভূমের জেলাশাসকের কাছে। রাতেই অনুব্রতকে নজরবন্দি করার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের জনসংযোগ অধিকর্তা ধীরেন্দ্র ওঝা বলেন, ‘‘নির্বাচন চলাকালীন অনুব্রত মণ্ডলের গতিবিধি এবং নির্বাচন সংক্রান্ত কার্যকলাপ নজরে রাখতেই এই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’’
সেই সঙ্গে অনুব্রতকে এ দিন আরও একটি শো-কজের চিঠি ধরিয়েছে কমিশন। আনন্দবাজারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অনুব্রতর ‘ভ্যানিশের’ হুমকি ছাড়াও ২০১৪ সালে রামপুরহাটে তাঁর বক্তৃতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে চিঠিতে। কমিশন জানিয়েছে, ময়ূরেশ্বরের বিরোধী প্রার্থী (লকেট চট্টোপাধ্যায়) সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্যের জন্য তাঁকে ক’দিন আগেই ভর্ৎসনা করা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও অনুব্রত নিরস্ত হচ্ছেন না। শনিবার বিকেল পাঁচটার মধ্যে জবাব না পেলে কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পদক্ষেপ করবে বলে জানানো হয়েছে।
কিন্তু এ সবে এখন আদৌ কোনও কাজ হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সব মহলেই। বিরোধীদের অনেকেই মনে করছেন, অনুব্রতর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করে দ্রুত তদন্তের নির্দেশ দেওয়া যেতে পারত। সে ক্ষেত্রে তৃণমূল নেতাকে পুলিশি হেফাজতে নেওয়ার রাস্তা খোলা থাকত। এখন অনুব্রত শো-কজের জবাব দিলে তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে নিতেই ভোট কার্যত পেরিয়ে যাওয়ার জোগাড় হবে। আর নজরবন্দি যদি করতেই হতো, সেই কাজটা অন্তত সপ্তাহখানেক আগে শুরু করা দরকার ছিল। এখন ভোটের প্রচার শেষ। অনুব্রতরও আর কোনও দলীয় কর্মসূচি নেই। নেপথ্যেও তিনি ঘুঁটি সাজিয়ে ফেলেছেন। ফলে সারাদিন তাঁর সামনে ক্যামেরা ধরে রাখলেই যে বীরভূমে ভূতের নেত্য আটকানো যাবে, এমন মনে করার কারণ নেই।
এই আশঙ্কা যে অমূলক নয়, অনুব্রতর এক ঘনিষ্ঠ সহযোগীর কথাতেও তা স্পষ্ট। মুখে হাসি ঝুলিয়ে তিনি বলেছেন, ‘‘নির্বাচন কমিশন যে কেষ্টদার বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিতে পারে তা আগেই আঁচ করা গিয়েছিল। তাই কেষ্টদা যা করার, সব করেছেন। যাঁকে যাঁকে যা নির্দেশ দেওয়ার, দিয়ে রেখেছেন। আমাদের কোনও টেনশন নেই। কেষ্টদা নির্বাচনের দিন পুরো সময়টা হয় বাড়িতে, বা বাড়ির উল্টো দিকের পার্টি অফিসেই থাকেন। ফোনটা সক্রিয় থাকে। ওতেই সব কাজ হয়ে যায়।’’
সতীর্থরা জানাচ্ছেন, এ বারও ভোটের দিন পার্টি অফিসেই থাকবেন ‘কেষ্টদা’। আর দলের ব্লকের নেতারাই ভোটটা করাবেন। সেই ‘নেটওয়ার্ক’ তৈরি। এক নেতার টিপ্পনী, ‘‘জৈদী কলকাতায় আসার আগেই সব কাজ সারা হয়ে গিয়েছে ওঁর।’’ বস্তুত, শুক্রবার সকাল থেকে যে ভাবে অনুব্রত সকলকে ‘কাজ’ বুঝিয়ে গিয়েছেন, তাতে তিনি নজরবন্দি থাকলেও কোনও সমস্যা হবে না বলে আত্মবিশ্বাসী তাঁর অনুগামীরা।
এ দিন খুব সকাল সকালই ঘুম থেকে উঠে পড়েন অনুব্রত। বিভিন্ন এলাকার বিশ্বস্ত ‘সেনাপতি’দের কাছে পরিস্থিতির খোঁজখবর নেন তিনি। তার পর ময়ূরেশ্বরে যান। সেখানে অতিরিক্ত ভিড়ের চাপে সভা বাতিল হয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত মঞ্চে বসেই স্থানীয় নেতা জটিল মণ্ডলের সঙ্গে বেশ খানিক ক্ষণ কথা বলেন।
এই জটিল হলেন ‘কোচ কেষ্টদা’র টিমের এক গুরুত্বপূর্ণ ‘মাথা’। যিনি এ দিন বলেছেন, ‘‘আগে বুথ জ্যাম করেছি। এ বার আর প্রয়োজন নেই। উন্নয়ন সঙ্গে আছে।’’ আর এক ‘মাথা’ নুরুল ইসলামের কথায়, ‘‘বুথ দখলের প্রশ্ন নেই। সিপিএমের সঙ্গে সাংবাদিক ছাড়া কে আছে?’’ আর এক ‘মাথা’
দীপক ঘোষ আরও ফুরফুরে। বলেছেন, ‘‘ভোটের দিন ঘুরব, ব্যস! ভালবাসা দিয়ে ভোট করব!’’
কোচ কী বলছেন? জটিলের সঙ্গে কী কথা হল, ভাঙতে চাননি কেষ্ট। তবে ময়ূরেশ্বর যাওয়ার আগে বেশ কয়েক বার নানা রঙের ওষুধ খেতে দেখা গেল তাঁকে। বারবার ওষুধ খাচ্ছেন, টেনশনে? অনুব্রতর সপাট জবাব, ‘‘কীসের টেনশন! আমি তো হামেশাই ওষুধ খাই।’’ ছক্কা হাঁকালেন কমিশনের হুঁশিয়ারি নিয়েও। বললেন, ‘‘নির্বাচন কমিশন গ্রেফতার করলে করবে। আমি চোর না ডাকাত?’’ জেলার পুলিশ সুপারকে যে সরানো হল? নির্বিকার মুখে উত্তর, ‘‘কমিশন যা ভাল মনে করছে, তাই করেছে।”
মনে রাখতে হবে, সন্ধ্যায় নজরবন্দি হওয়ার খবরটা পেয়েও কেষ্ট একই রকম ফুরফুরে! বললেন, ‘‘কমিশনকে আমি শ্রদ্ধা করি। যে অতিথিরা আমাকে নজরদারি করতে আসবেন, তাঁদের আপ্যায়নের কোনও ত্রুটি হবে না। ভাত-ডাল-পোস্ত সবই পাবেন। আর ভোট হয়ে গেলে বিশ্রামও পাবেন। কারণ, আমি ক’টা দিন বিশ্রাম নেব।’’
ফলে ভাবনা যাচ্ছে না বিরোধীদের। ময়ূরেশ্বরের বিজেপি প্রার্থী লকেট যেমন বলেছেন, ‘‘যে ভাবে তাঁর (অনুব্রতর) শাগরেদরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তাতে শান্তিতে ভোট হওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা কাটছে না।’’ কমিশনের এ দিনের নির্দেশে কাজের কাজ কিছু হবে না বলেই মনে করেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘‘মমতার সন্ত্রাসের মুখোশ হল অনুব্রত। তাই মমতাকে আগে গারদে পোরা দরকার।’’ বীরভূমের এক জন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট অনুব্রতর কতটা নজরদারি করতে পারবেন, তা নিয়েও সন্দিহান সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র। শেক্সপিয়র উদ্ধৃত করে তাঁর উক্তি, ‘মাচ অ্যাডো অ্যাবাউট নাথিং।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy