বোলপুরের পার্টি অফিসে শনিবার। রণজিৎ নন্দীর তোলা ছবি।
ক্যামেরা চলল। তিনিও চললেন।
যে যার মতো!
তিনি ঢুকলেন একের পর এক পার্টি অফিসে। ক্যামেরা থমকে রইল চৌকাঠে। বন্ধ হয়ে গেল শাটার।
সেই শাটার খুলে আবার তিনি বেরোলেন। পিছু নিল ক্যামেরা। দেখল, তিনি মেজাজে চক্কর দিয়ে চলেছেন একের পর এক বিধানসভা এলাকা। যেখানে কোথাও তিনি দলের লোকেদের ধমকালেন, কোথাও চাঙ্গা করলেন। এবং সর্বত্র ঠান্ডা নির্দেশ পড়িয়ে দিলেন, ‘ভোটে লিড চাই। যে ভাবেই হোক।’
দরজায় বাইরে থাকা ক্যামেরা কি শুনল এত কথা?
না! তবে দেখল, ২৪ ঘণ্টা নজরবন্দি থেকেও কী ভাবে ভোটের আগের দিনটা ‘বিন্দাস’ কাটালেন অনুব্রত মণ্ডল। এমনকী এ দিনও টিভি ক্যামেরার সামনে বললেন, ‘‘সবার জন্য গুড়-বাতাসা রয়েছে। প্রচুর জল সাপ্লাই দিয়েছি। যেখানে মায়ের বিসর্জন হবে, সেখানে ঢাক তো বাজবেই। ঢাকিরা ষষ্ঠীর দিন থেকে এসে গিয়েছে!’’
রসিকতা করে কেউ কেউ বলছেন, ‘কোচ কেষ্টদা’ যা যা করে থাকেন, সবই করলেন। বরং এই ছুতোয় এক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, এক ভিডিওগ্রাফার আর আধাসেনার আট জওয়ানকে (যাঁরা নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে আপাতত তাঁর নজরদার) শনিবার বীরভূম
জেলাটা ঘুরিয়ে দেখালেন! চওড়া হাসিতে কেষ্ট নিজেও বললেন, ‘‘কেন্দ্রীয় বাহিনী থাক না। আমার কোনও অসুবিধে নেই। ভোট করাতে কোনও অসুবিধেই হবে না।’’
নির্বাচন সদনের নির্দেশ ছিল, এক জন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে কেষ্টর উপরে সর্বক্ষণ নজরদারি চলবে। তাঁকে ঘিরে রাখবে কেন্দ্রীয় বাহিনী। এক জন ভিডিওগ্রাফার নজরদারির ছবি তুলবেন। সেই মতো শনিবার ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই আধাসেনা পৌঁছে গিয়েছিল বোলপুর শহরের নিচুপট্টিতে কেষ্টর নীলরঙা দোতলা বাড়ির দোরগোড়ায়। আটটা বাজতেই চলে আসেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মৃন্ময় দাস। সঙ্গে কমিশনের ভিডিওগ্রাফার অমিত বন্দ্যোপাধ্যায়।
তখনও দোতলা থেকে নামেননি কেষ্ট। কাজেই বাড়িতে কে আসছে, কে যাচ্ছে, সেটাই এতক্ষণ ভিডিও-য় তুলে রাখা হচ্ছিল। সাড়ে ন’টা নাগাদ পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকলেন কসবা এলাকার দুই নেতা হৃদয় ঘোষ ও নারায়ণ ভাণ্ডারী। তাঁদেরও একটু পরে এলেন কেষ্টর দশ ‘মাথা’র এক মাথা— তৃণমূলের জেলা সহ-সভাপতি অভিজিৎ ওরফে রানা সিংহ।
বাইরে প্রায় তিন ঘণ্টা হাপিত্যেশ করে বসে সংবাদমাধ্যম। কখন নামবেন কেষ্ট? অপেক্ষা শেষ দশটা চল্লিশে। দুধসাদা পাজামা-পাঞ্জাবি-স্নিকার্সে সেজে বৈঠকখানায় দেখা দিলেন তিনি। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ভিতরে ঢুকলেন। জানতে চাইলেন সারাদিনের কর্মসূচি। অনুব্রত বললেন, জেলার ১১টি বিধানসভা এলাকায় যাবেন।
মাঝে বড়জোর মিনিট দশেক। কেষ্ট এ বার উঠে পড়লেন কালো কাচে ঢাকা এসএইউভি-তে। ১১টা নাগাদ পৌঁছেও গেলেন নানুরের দলীয় কার্যালয়ে। সেখানে তখন হাজির ১১টি অঞ্চল কমিটির সভাপতি, তৃণমূল প্রার্থী গদাধর হাজরা। ‘কোচ’কে পেয়ে সমর্থকদের অভিযোগ উপচে পড়ল— ‘‘কাজল শেখ আমাদের বাড়ি-বাড়ি হুমকি দিচ্ছে।’’ অভয় দিলেন কেষ্ট, ‘‘যে যার মতো ভোট কর। চিন্তা নেই।’’
তারাশঙ্করের লাভপুর ছুঁয়ে এ বার গাড়ি ছুটল সাঁইথিয়া। পৌঁছতেই চমক! তেতেপুড়ে আসা জেলা সভাপতিকে জলের সঙ্গে গুড়ের বাতাসা এগিয়ে দিলেন অনুগতরা। এই বাতাসা নিয়ে এত কথা। তার পরেও? শহর সভাপতি পিনাকীলাল দত্ত বললেন, ‘‘এক সময় আমাদের লৌকিকতার অঙ্গই ছিল গুড়-জল। আমাদের সভাপতি গুড়-জল-বাতাসার কথা বলেন।’’
গুড়-বাতাসায় তুষ্ট হয়ে কেষ্টর আবির্ভাব হল একান্নপীঠের এক পীঠ— তারাপীঠে। এখানকার বিধানসভা কেন্দ্র হাঁসন। সামান্য দইয়ের আয়োজন ছিল। খেতে খেতেই কথাবার্তা। তার পর আবার গাড়িতে ওঠা। আবার রওনা। এ বার মুরারই।
প্রত্যেক বার পার্টি অফিসের বাইরেই দাঁড়িয়ে পড়ছিল ক্যামেরা-টিম। মুরারইয়ে যেন তাদের ধমকে দিয়েই ঘড়ঘড় করে নেমে গেল লোহার শাটার। আর সেই শাটারের পেছন থেকে শোনা গেল কেষ্টর চিৎকার। কারণটা জানা গেল পরে। কংগ্রেস প্রার্থী আলি মর্তুজা খান এই এলাকায় প্রচারে এগিয়ে আছেন শুনেই খেপে গিয়েছেন কেষ্ট। তাই ধাতানি দিচ্ছিলেন মুরারইয়ের নেতা তথা জেলা পরিষদের কৃষি কর্মাধ্যক্ষ প্রদীপ ভকতকে!
মেজাজটা এই এক বারই একটু খিঁচড়ে গিয়েছিল। বাকি সময়টা তিনি দিব্যি ফুরফুরে। সাংবাদিকরা জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি নজরবন্দি, অসুবিধে হচ্ছে না? উত্তর দিলেন, ‘‘কোনও অসুবিধে নেই। আমি এখনই জেলার সব কটা বিধানসভায় যাব।’’ কিন্তু নজরদারিতে ভোট কমবে না? জবাব এল, ‘‘কমবে তো না-ই। বরং বাড়বে!’’
নলহাটি হয়ে রামপুরহাট পৌঁছে (এই প্রথম বার) একটা খিটিমিটি বাধল নজরদার দলের সঙ্গে! রামপুরহাটের প্রার্থী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট অনুব্রতকে বলেন, ‘‘কমিশনের নির্দেশ এসেছে, আপনি নিজের বিধানসভা এলাকায় ফিরে যান।’’ অনুব্রত সটান বলেন, ‘‘আপনার কাছে কি লিখিত কোনও অর্ডার আছে? তা হলে দেখান। আমি সেই অর্ডার মেনে নেব।’’
ম্যাজিস্ট্রেট কোনও উত্তর দিতে পারেননি। কেষ্টও আর তাঁদের তেমন পাত্তা দেননি। মেজাজে ঘুরে গিয়েছেন সিউড়ি, দুবরাজপুর, ইলামবাজার।
সন্ধে সাড়ে সাতটায় মুখচোখে ক্লান্তির ছাপ নিয়ে নিচুপট্টির বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নামলেন বিপুলদেহ নেতা। জানা গেল, কমিশনের নির্দেশ এসেছে— আজ, রবিবার সন্ধে ছ’টা পর্যন্ত বোলপুর বিধানসভা এলাকার বাইরে বেরোতে পারবেন না তিনি। দলের বিশ্বস্ত স্ট্রাইকার-ডিফেন্ডাররা তা শুনেই বলে দিলেন, এতে ‘দাদার’ কোনও অস্বস্তি হওয়ার কথা নয়।
অবশ্য অনেক আগেই কেষ্ট বলে দিয়েছেন— ‘‘আমার রোগ-বালাই নেই, অস্বস্তি কীসের? বাহিনী বাহিনীর মতো, আমি আমার মতো আছি!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy