Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪

থোড়াই কেয়ার নজরদারি, জেলা চষে শেষ বেলায় নির্দেশ জারি অনুব্রতের

‘চমকে বেড়ায়, দৃষ্টি এড়ায়, যায় না তারে বাঁধা’— নির্বাচন কমিশনের নজরদারিতে থেকেও শনিবার বীরভূমে এমনই কাণ্ড করে বেড়ালেন অনুব্রত মণ্ডল! শুক্রবার কমিশনের জারি করা নির্দেশে অনুব্রতের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলা হয়নি। শুধু বলা হয়েছিল, তিনি যেখানেই যাবেন, সঙ্গী হবেন এক জন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তাঁকে ঘিরে থাকবে কেন্দ্রীয় বাহিনী। এবং এক জন ভিডিওগ্রাফার তাঁর গতিবিধি নজরবন্দি করবেন।

অনুব্রতর বাড়ির বাইরেই বাহিনী নিয়ে দাঁড়িয়ে নজরদারির দায়িত্বপ্রাপ্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মৃন্ময় দাস। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।

অনুব্রতর বাড়ির বাইরেই বাহিনী নিয়ে দাঁড়িয়ে নজরদারির দায়িত্বপ্রাপ্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মৃন্ময় দাস। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়
বোলপুর শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:২৪
Share: Save:

‘চমকে বেড়ায়, দৃষ্টি এড়ায়, যায় না তারে বাঁধা’— নির্বাচন কমিশনের নজরদারিতে থেকেও শনিবার বীরভূমে এমনই কাণ্ড করে বেড়ালেন অনুব্রত মণ্ডল!

শুক্রবার কমিশনের জারি করা নির্দেশে অনুব্রতের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলা হয়নি। শুধু বলা হয়েছিল, তিনি যেখানেই যাবেন, সঙ্গী হবেন এক জন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তাঁকে ঘিরে থাকবে কেন্দ্রীয় বাহিনী। এবং এক জন ভিডিওগ্রাফার তাঁর গতিবিধি নজরবন্দি করবেন। এমন নির্দেশে কাজ হবে কিনা, তা নিয়ে গোড়া থেকেই সংশয় প্রকাশ করেছিলেন বিরোধীরা। আর এ দিন দিনভর গোটা জেলা চষে ফেলার পরে সন্ধ্যায় যখন ‘কেষ্ট’কে বোলপুরের বাড়িতে ফিরতে এবং ভোট না-মেটা পর্যন্ত বোলপুরেই থাকতে বলল কমিশন, তখন তাঁর ‘কাজ’ সারা হয়ে গিয়েছে বলেই অভিযোগ বিরোধীদের। তাঁদের দাবি, ভোটের আগের লাভপুর এবং নানুরে কেষ্টর ‘নীতি’ মেনেই ভোটারদের ভয় দেখানো হয়েছে।

তৃণমূল অন্দরের খবর, জোট-আবহে তাঁর কাঁধে থাকা ১৪টি আসন (বীরভূমের ১১, বর্ধমানের তিন) জিততে ভোট-নীতি তৈরি রয়েছে কেষ্টর। সেই ছকেই নানুর, লাভপুরের জন্য ‘দাওয়াই’ ঢাকের ‘চড়াম চড়াম’ আওয়াজ। সেখানে ঢাকে কাঠি না চামড়ায় লাঠি পড়বে— বোঝা দায়।

বোলপুর, সিউড়ি, রামপুরহাটের জন্য ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’। অর্থাৎ, বিরোধীরা সেখানে কায়দা করতে পারবেন না ধরে নিয়ে একেবারে নিপাট ভদ্রলোকের ভোট।

আর ময়ূরেশ্বর, সাঁইথিয়া, দুবরাজপুর, হাঁসন, মুরারই, নলহাটির মতো বাকি আট আসনে চিরাচরিত ‘গুড়-জল’। মানে, প্রথমে মিঠে কথায় বোঝানো। কাজ না হলে ভয় দেখিয়ে ঠান্ডা করে দেওয়া।

তবে কোথাও যদি কেউ ‘কোচ কেষ্ট’র ‘নীতি’কে চ্যালেঞ্জ করার সাহস দেখায়? পঞ্চায়েত ভোটের আগে দেওয়া অমোঘ নিদান মনে রাখতে নির্দেশ গিয়েছে বোলপুরের নিচুপট্টির বাড়ি থেকে। কী সেই নির্দেশ? ‘‘কেন, বোম মারুন!’’ মনে করালেন জেলা তৃণমূলের এক বাহিনী-সর্দার। তাঁর কথায়: ‘‘দিনভর জেলা চষে দাদা বলে গিয়েছেন: ভ্যানিশ কর, বুথ দখল কর। লিড চাই, লিড।’’ তৃণমূলের এক জেলা নেতার কথায়, ‘‘যে অঞ্চল লোকসভার মতো লিড দিতে পারবে না, সেখানকার নেতাকে সরানো হবে। বলে দেওয়া হয়েছে, ‘লিড দাও, পদ থাকবে’। থানা-পুলিশ, বালি-কয়লা-পাথর-পঞ্চায়েত সব থাকবে। সরকার আমাদেরই থাকবে। সেটা বুঝেসুঝে কাজ করো।’’

বিরোধীরা বলছেন, কাজও শুরু হয়ে গিয়েছে। জংলা ছাপের ‘ব্যাটল ফেটিগ’ পরে তৃণমূলের বাইক বাহিনী নানুরের গ্রামে ভোটারদের শাসিয়েছে। তবে তৃণমূলের প্রার্থী অনুব্রত-ঘনিষ্ঠ গদাধর হাজরা অভিযোগ উড়িয়ে বলেন, “আধা-সেনা, পুলিশ থাকলেও কী ভাবে ৩০টি মোটরবাইকে শতাধিক লোক ওই এলাকায় তাণ্ডব চালাল, সেটাই তো বিস্ময়ের।’’

লাভপুরে সিপিএম এজেন্টদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে শাসানি চলছে বলে অভিযোগ জমা পড়েছে জেলাশাসকের কাছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় লাভপুর পশ্চিমপাড়ায় সভা করে তাঁদের বিপক্ষে ভোট দিলে কার্যত দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন তৃণমূলের বীরভূম জেলা সহ-সভাপতি আব্দুল মান্নান। মান্নানের বক্তব্য, তাঁদের বিরুদ্ধে যিনি ভোট দেবেন, কোনও রকম সরকারি সুযোগ-সুবিধা তিনি পাবেন না। সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিমের কথায়, ‘‘সূর্যকান্ত মিশ্রকে হারানোর জন্য মুখ্যমন্ত্রী যা চাই তা দেবেন বলেছিলেন। এটা ঠিক তার উল্টো অস্ত্র।’’

অভিযোগ না মানলেও জেলা তৃণমূলের এক নেতার সহাস্য দাবি, ‘‘নানুর-লাভপুরে যে ঢাক বেজেছে, তাতে বিরোধী ভোটারেরা ভ্যানিশ হয়ে যাবে।’’ কেষ্ট নিজে অবশ্য বলছেন, ‘‘এ জগতে কুনো কিছুই ভ্যানিশ হয় না। সবই থাকে, কিন্তু কিছুই দেখা যায় না। সিটাই জাদু।’’ সঙ্গে জুড়ছেন, ‘‘ভাইটি, আমি কিন্তু কিছুই বলি নাই।’’

এ দিন বিকেলে নানুরে অনুব্রত-ঘনিষ্ঠ এক নেতাকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘যা করার, সকাল ১০টার মধ্যে করে নেব আমরা। তেমনই নির্দেশ আছে।’’ কেষ্টদার নির্দেশ হল, বিরোধীদের বোঝানো এবং চমকানোতে কাজ না-হলে ভোটের দিন বাড়ি থেকে বেরোতেই দেওয়া হবে না। বুথে তৃণমুলের এজেন্টের সঙ্গে দু’-এক জন নির্দল প্রার্থীর নামে এজেন্ট বসানো হবে। আর বিরোধী দলের পোলিং এজেন্ট সাহস করে বুথে এলে তাঁদের বলে দিতে হবে, ‘প্রতিবাদ করবে না। শুধু মাথা নাড়বে’।

যদি তা না হয়? ‘‘নেটওয়ার্কে খবর চলে যাবে। ব্যবস্থা হয়ে যাবে’’ —দাবি তৃণমূলের এক জেলা নেতার। কী সেই নেটওয়ার্ক? বুথের খুঁটিনাটি নজরে রাখতে প্রথম স্তরে আছেন দলের পোলিং এজেন্টরা। তাঁরা বুথের ‘রিয়েল টাইম’ খবর পৌঁছে দেবেন ব্লক স্তরে। রিটার্নিং অফিসার বা বিডিওদের উপরে সেখান থেকে চাপ সৃষ্টি করা হবে। তাতে ডাল না-গললে ফোন যাবে কেষ্টদার কন্ট্রোল রুমে। সেখান থেকে ‘ব্যবস্থা’ নেওয়া হবে।

তৃতীয় পর্বের ভোট অবাধ করতে কমিশন যে দাওয়াই-ই দিক না কেন, তাকে থোড়াই কেয়ার অনুব্রত বাহিনীর। সিউড়ি শহর সভাপতি অভিজিৎ মজুমদারের কথায়, ‘‘নির্বাচন কমিশন মানে এত দিন জানতাম, হাতি-ঘোড়া কিছু হবে। এখন বুঝছি, আওয়াজটাই বেশি। কেষ্টদা খেলাটা ঠিকই খেলবেন।’’

শুক্রবার অনুব্রতকে যে শো-কজের চিঠি ধরানো হয়েছিল, শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জবাব পৌঁছয়নি বলে জানিয়েছে কমিশন। বিরোধী দলের নেতানেত্রী সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করায় এ দিনও ফের শো-কজ
করা হয়েছে কেষ্টকে। দুই শো-কজ সম্পর্কে তাঁর উত্তর, ‘‘ঠিক সময়ে জবাব দেব।’’ তিনি ভোটের দিন বোলপুর না ছাড়ার নির্দেশেও বিচলিত নন। মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বললেন, ‘‘দূর, আমি কোন ভোটের সময় বাড়ি থেকে বেরোই? ঢাক এমনি বাজাবে।’’

তবে নানুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অনুব্রতর ‘ঢাক’ বেসুরো শোনাবে বলে দাবি করেছেন দলে তাঁর বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর নেতা কাজল শেখের অনুগামীরা। আর ময়ূরেশ্বরে বিজেপি প্রার্থী লকেট চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘আমাদের পাল্টা রণনীতি তৈরি।’’ সিউড়ির সিপিএম প্রার্থী রামচন্দ্র ডোমেরও প্রত্যয়, ‘‘প্রবল গরমে গুড়-জল খেয়েই ভোটারেরা বুথে যাবেন, আর ভোট-যন্ত্রের বোতাম চড়াম চড়াম টিপে কেষ্ট মণ্ডলের পিঠেই ঢাক বাজাবেন।’’

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy