ওইখানে...:বাঁধের কাজ যেখানে চলছে, সেখানেই ছিল জমি। শোলেমারি নদীর ধারে উত্তর গোপালনগর গ্রামে। ছবি: দিলীপ নস্কর
ভেঙেছে ঘর। ত্রাণ নিয়ে বিতর্ক। ভোটের মুখে আমপান বিধ্বস্ত এলাকার ছবি
নদীর পাড়ে কাটা রয়েছে মাটি। মাটি কাটছে যন্ত্র। চলছে বাঁধ গড়া।
ঘূর্ণিঝড় আমপান উত্তর গোপালনগর গ্রামকে ভুগিয়েছে, তাণ্ডবে। নদীর জল ঢুকে নষ্ট হয়েছে ফসল। ধসেছে বাড়ি। সেখানে রাজ্য সরকারের উদ্যোগে এ বাঁধ মানে ভবিষ্যতের ভরসা, তাই না?
‘‘নিশ্চয়ই’’, বলেন স্থানীয় বাসিন্দা দুলাল পাত্র। তবে জোড়েন, ‘‘ওই ভরসাতেই বাড়ি ধসে পড়লেও কাঠা আটেক জমি বিনা লেখাপড়ায় দিয়েছিলাম। বলা হয়েছিল, ১০০ দিনের কাজ পাব। পাইনি। আংশিক ক্ষতিপূরণ পেয়েছি। জমির দাম কি এতই কম?’’
দক্ষিণ ২৪ পরগনার পাথরপ্রতিমায় শোলেমারি নদী গিয়েছে গ্রাম ঘেঁষে। এ এলাকায় বাঁধ জীবনের অন্য নাম, এক বাক্যে মানছেন সবাই। কিন্তু বাঁধে কি সব প্রশ্ন আটকায়?
গ্রামবাসী জানাচ্ছেন, গত মে মাসে আমপানের পরে, অনেকে টাকা পেয়েছেন। তবে সেটা ঝড়ে ঘরের ক্ষতি হওয়ার টাকা, না এলাকায় নদীবাঁধের জন্য জমি দেওয়া বাবদ পাওয়া ‘সাম্মানিক’— তা স্পষ্ট হচ্ছে না তাঁদের কাছে। যার পাকা বাড়ির কিছু হয়নি, সে কী করে ক্ষতিপূরণ পায় বা একই পরিবারের অনেকে কী করে ক্ষতিপূরণ পেল ‘প্রশ্ন’ আছে তা নিয়েও। তবে তৃণমূল পরিচালিত গোপালনগর পঞ্চায়েতের উপপ্রধান, বিদায়ী বিধায়ক এবং প্রশাসনের দাবি, যা হয়েছে, তাতে স্বচ্ছতার অভাব নেই।
চাষ, দিনমজুরি, পশুপালনের উপরেই জীবন চলে গ্রামের। ‘দুয়ারে সরকার’ কর্মসূচি ঠিক দুয়ারে (হাঁটা পথে এক ঘণ্টা দূরে) না হলেও সেখানে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের কার্ড করিয়েছেন, কাস্ট সার্টিফিকেট পেয়েছেন অনেকে। কিন্তু ক্ষতিপূরণের প্রশ্নে ‘ধন্দ’ রয়ে গিয়েছে।
‘‘জলে-ঝড়ে বাড়ি বলে কিছু ছিল না’’, স্মৃতিচারণ বৃদ্ধা রাধারাণি মণ্ডলের। সরকারি ত্রাণ মেলেনি? ‘‘ত্রিপল পেয়েছি। এলাকায় আসা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা চিঁড়ে, মুড়ি দিয়েছিল।’’ ক্ষতিপূরণ? ‘‘পাইনি’’, দাবি বৃদ্ধার। পাশে দাঁড়ানো তাঁর আত্মীয়া রিতারানি মণ্ডল ঝাঁঝিয়ে ওঠেন, ‘‘এখানে তেলা মাথায় তেল দেওয়া হয়।’’
৬৩ বছরের বিমলা পাত্র আঙুল তোলেন, ‘‘ওইখানে ছিল দু’বিঘা জমি। ধান-খড় বেচে বছরে ৮০ হাজার টাকা আয় হত।’’ আঙুল যে দিকটা দেখায়, নদীর ধারে সেখানে মাটি কাটছে যন্ত্র। বৃদ্ধা ও তাঁর পড়শিদের একাংশের দাবি, আমপানের পরে, তৃণমূলের কিছু নেতা ও প্রশাসনের তরফে তাঁদের বলা হয়, ফের এমন ঘূর্ণিঝড় হলে নদীর পাড় ভেঙে খেতে জল ঢোকা আটকাতে বাঁধ দিতে হবে। সে জন্য জমি লাগবে। ঠিক হয়, যাঁর যত জমি বাঁধের জন্য লাগবে, সে অনুপাতে তিনি বা তাঁর পরিবার ক্ষতিপূরণ এবং ১০০ দিনের প্রকল্পে কাজ পাবেন।
এই সূত্রেই তৃণমূলের একাংশের দিকে আঙুল তুলেছেন বিজেপির মথুরাপুর সাংগঠনিক জেলা সভাপতি দীপঙ্কর জানা। তাঁর অভিযোগ, ‘‘লোক ঠকানো হয়েছে ওখানে। তা নিয়ে সরব হওয়ায় আমাদের কয়েক জনকে মিথ্যা অভিযোগে জেলে ভরা হয়েছে।’’ লিখিত সম্মতি ছাড়া, বাঁধের জন্য জমি নিয়ে মানুষকে ভুল বোঝানোর অভিযোগ করেছেন এলাকার সিপিএম নেতা সত্যব্রত দাসও।
পরিস্থিতি ঠিক কী?
পরিচ্ছন্ন লোক বলে এলাকায় পরিচিত পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য চিন্ময় বেরা। বছর সাতাত্তরের এই প্রাক্তন শিক্ষক জানান, ঝড়ে বাড়ির একাংশ ভেঙেছে তাঁর। বাঁধের জন্য তিন বিঘা জমি দিয়ে তিনিও ২০ হাজার টাকা পেয়েছেন। তাঁর দাবি, ‘‘বাঁধের জন্য জমি নেওয়া হলে, ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার আশ্বাস ছিল দলের তরফে। ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রকাশের প্রস্তাবও দিয়েছিলাম। আমাকে বলা হয়েছে, মাথা ঘামাতে হবে না।’’
পঞ্চায়েতের উপপ্রধান তৃণমূলের দেবরঞ্জন গিরি বলছেন, ‘‘মাস্টারমশাইয়ের শরীর-স্বাস্থ্যের কথা ভেবে ওঁকে চাপ নিতে নিষেধ করেছে দল।’’ তাঁর দাবি, উত্তর গোপালনগরে যেখানে বাঁধের কাজ চলছে, সেখানে ১০-১৫ বিঘা জমি ব্যবহারের জন্য স্থানীয় বাসিন্দারা লিখিত সম্মতি দিয়েছেন। ত্রাণের টাকা দিতে গিয়ে দু’-একটা ক্ষেত্রে গোলমাল হয়ে থাকতে পারে। জানাচ্ছেন, এলাকায় ৪,৫০০ জব-কার্ডধারীর মধ্যে ১,২৫০ জনকে বাড়ি, ৬০০ জনকে পূর্ণ ক্ষতিপূরণ এবং পঞ্চায়েত এলাকায় ১৩ কিলোমিটার রাস্তার কাজে কিছু জনকে লাগানো হয়েছে। বিজেপির অভিযোগ উড়িয়ে বলেছেন ‘‘গা-জোয়ারি করে ক্ষতিপূরণের টাকা আদায়ের মতলবে আমার উপরে হামলা করেছিল ওরা।’’
বিদায়ী তৃণমূল বিধায়ক সমীরকুমার জানার বক্তব্য, ‘‘সভা করে বলেছিলাম, ‘প্রাণে বাঁচার জন্য নদীবাঁধ করতে হবে’। মানুষ স্বেচ্ছায় জমি দিয়েছেন। শুধু উত্তর গোপালনগর কেন, পাথরপ্রতিমার একাধিক জায়গায় মানুষের দেওয়া জমিতেই বাঁধ গড়া চলছে। ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরিতে ত্রুটি হয়েছে বলে নির্দিষ্ট করে জানালে ব্যবস্থা নেব।’’
আমপানের সময়ের জেলাশাসক পি উলাগানাথন বদলি হয়েছেন। তিনি মন্তব্য করতে চাননি। বর্তমান জেলাশাসক অন্তরা আচার্যকে ফোন ও মেসেজ করা হলেও জবাব মেলেনি। বিডিও রথীনচন্দ্র দে-র দাবি, ক্ষতিপূরণের টাকা বিলিতে ত্রুটি হয়নি। নিয়ম মেনে কেউ ১০০ দিনের প্রকল্পে আবেদন করেও কাজ পাননি বলে অভিযোগ জানালে, দেখা হবে। ব্লক প্রশাসনের এক আধিকারিক বলেছেন, ‘‘কোনও ব্যাপারে কারও আপত্তি নেই বলেই তো বাঁধ হচ্ছে।’’ ‘‘পারস্পরিক সম্পর্কের বোঝাপড়ায় চলছে পাথরপ্রতিমা’’, দাবি বিধায়কের।
সবাই সহমত বলে মনে হয় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy