Advertisement
Back to
Nandigram Incident

নীলবাড়ি থেকে দিল্লিবাড়ির লড়াই, ভোট এলেই বার বার খবরে সেই নন্দীগ্রাম! পদ্ম বনাম ঘাসফুলে উত্তাপ তুঙ্গে

বুধবার রাতে নন্দীগ্রামের সোনাচূড়ার মনসাবাজার এলাকায় দুষ্কৃতীদের হাতে খুন হন স্থানীয় বিজেপি নেতা সঞ্জয় আড়ির মা রথিবালা আড়ি। সঞ্জয় নন্দীগ্রামে বিজেপির তফসিলি মোর্চার সম্পাদক।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০২৪ ২৩:২৭
Share: Save:

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বনাম শুভেন্দু অধিকারী। গত বিধানসভা ভোটে দুই যুযুধান পক্ষের মুখোমুখি লড়াইয়ে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উত্তপ্ত ছিল পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম। উত্তাপ ছিল নীলবাড়ির লড়াইয়ের ফলাফল ঘোষণার দিনেও। এ বার দিল্লিবাড়ির লড়াইয়েও আবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসে পড়ল সেই নন্দীগ্রাম! আগামী ২৫ মে তমলুক কেন্দ্রে ভোট। নন্দীগ্রাম তমলুক কেন্দ্রেরই অন্তর্গত। ভোটের তিন দিন আগে সেখানে বিজেপির এক মহিলা কর্মীর খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবার উত্তাল হল রাজ্য-রাজনীতি।

বুধবার রাতে নন্দীগ্রামের সোনাচূড়ার মনসাবাজার এলাকায় দুষ্কৃতীদের হাতে খুন হন স্থানীয় বিজেপি নেতা সঞ্জয় আড়ির মা রথিবালা আড়ি। সঞ্জয় নন্দীগ্রামে বিজেপির তফসিলি মোর্চার সম্পাদক। দুষ্কৃতী হামলায় তিনিও জখম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। দলীয় সূত্রে খবর, রথিবালাও বিজেপির কর্মী ছিলেন। এই ঘটনায় তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ তুলে বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই সোনাচূড়ায় বিক্ষোভ দেখান বিজেপির কর্মী-সমর্থকেরা। রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে, টায়ার জ্বালিয়ে, গোটা দিন জুড়ে অবরোধ-বিক্ষোভ চলে। যা দেখে জমি আন্দোলনের সময়কার মিল খুঁজে পেয়েছেন অনেকেই।

ঘটনার খবর পেয়েই দুপুরে নন্দীগ্রামে যান বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু। শুভেন্দু নন্দীগ্রামেরই বিজেপি বিধায়ক। নীলবাড়ির লড়াইয়ে মমতাকে হারিয়েছিলেন তিনি। দলীয় কর্মীর খুনে তৃণমূলের বিরুদ্ধেই অভিযোগের আঙুল তুলেছেন শুভেন্দু। তাঁর দাবি, যাঁরা খুন করেছেন, পুলিশ তাঁদের সঙ্গে বৈঠকও করেছে! তাঁর কথায়, ‘‘খুনিরা থানায় এসেছিল। যারা খুন করেছে, মাকে খুন করেছে। রথিবালা আড়ি সঞ্জয় আড়ির মা নন, তিনি আমার মা। খুনিদের সঙ্গে এখনই মিটিং করেছেন। আমি জানতে চাই, খুনির সঙ্গে এখনই মিটিং করেছেন কেন? মজা দেখাব আইসিকে!’’ পরে নন্দীগ্রাম থানায় গিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে এফআইআর-ও দায়ের করান। থানায় যাওয়ার পথে এলাকায় মোতায়েন থাকা কেন্দ্রীয় বাহিনীকে শাসাতেও দেখা গিয়েছিল বিরোধী দলনেতাকে।

তৃণমূল অবশ্য দাবি করেছে, এই ঘটনায় তারা জড়িত নয়। স্থানীয় নেতা শেখ সুফিয়ানের দাবি, বিজেপিতে নব্য এবং আদির মধ্যে তুমুল লড়াই চলছে। সেই লড়াইয়েরই বলি হয়েছেন রথিবালা। ঘটনার দায় শুভেন্দুর উপর চাপিয়েছেন সুফিয়ান। তাঁর দাবি, ‘‘শুভেন্দু অধিকারী জানেন যে, নন্দীগ্রামে ডেফিসিট খাব, তাই একটা শেষ পেরেক মারতে হবে। যে মনসাবাজারে ঘটনাটি ঘটেছে, সেখানে তৃণমূলের একটি ঝান্ডাও নেই। তবে আমাদের কিছু সমর্থক ওখানে থাকেন। ওরা (বিজেপি) রাত ১২টার পর গিয়ে আমাদের লোকেদের বাড়ি ভাঙচুর করে, মারধর করে। তা নিয়েই আদি এবং নব্য বিজেপির মধ্যে গন্ডগোল, মারামারি, ফাটাফাটি হয়। এক জনের মৃত্যু হয়েছে। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। কোনও মৃত্যু সমর্থন করি না। প্রশাসনকে বলব এর বিহিত করা হোক।’’

বৃহস্পতিবার সকাল থমথমে ছিল সোনাচূড়া। এলাকায় মোতায়েন ছিল বিশাল পুলিশবাহিনী। নিহতের বাড়িও বিজেপির কর্মী-সমর্থকদের ভিড়ে ভিড়াক্কার। সেখানে সংবাদমাধ্যমের লোকেদের বুধবার রাতের ঘটনার বিবরণ দেন রথিবালার বৌমা সুবর্ণা আড়ি। তিনি জানান, রাত তখন প্রায় ২টো। বাড়িতে ঘুমোচ্ছিলেন তাঁর ভাসুর। হঠাৎই ফোন আসে। তিনি ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। বাইরে তখন তুমুল চিৎকার-চেঁচামেচি! খবরও তত ক্ষণে রটে গিয়েছে। কিছু দুষ্কৃতী নাকি বাজার এলাকায় জড়ো হয়েছে। বিপদ আঁচ করেই ভাসুরের পিছু পিছু গিয়েছিলেন শাশুড়ি। সেখানে তুমুল গন্ডগোলের মধ্যে খুঁজছিলেন ছেলেকে। সেই সময় মাথায় ভারী কিছু দিয়ে মেরে তাঁর শাশুড়িকে খুন করা হয়!

এই ঘটনার পর এলাকায় কয়েক জন তৃণমূল কর্মীর বাড়ি, দোকান জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে বিজেপির বিরুদ্ধে। বৃহস্পতিবার সেই সব ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে এলাকায় যায় তৃণমূলের প্রতিনিধি দল। সেই দলে ছিলেন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, পার্থ ভৌমিক, সৌমেন মহাপাত্রেরা। সেখানে তাঁদের গো ব্যাক স্লোগান দেওয়া হয়। রাজীব বলেন, ‘‘আমরা এলাকার তৃণমূল নেতা-কর্মীদের বার্তা দিতে চাই যে, তাঁরা যেন কোনও প্রকার ঝামেলায় না জড়ান। তাঁদের উপর হামলা হলেও বিষয়টি নিয়ে পুলিশকে অভিযোগ জানাতে বলা হয়েছে। পুলিশ আইন মতো ব্যবস্থা নেবে। তবে কেউ যেন আইন নিজের হাতে তুলে না নেন, সেই বার্তাই দিয়েছি আমরা।’’

বিজেপি দাবি করেছে, তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উস্কানিমূলক ভাষণের জেরেই খুনের ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে রাজীব বলেন, ‘‘অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কোথায় উস্কানিমূলক কথা বলেছেন, আমাদের দেখান তো! বরং শুভেন্দু অধিকারী ও তাঁর দলের নেতারা প্রায়শই বিস্ফোরক কথা বলে মানুষকে উত্ত্যক্ত করছেন। কারা বলেছিল বাংলায় শীতলখুচি করে দেব! এই বোমা বিস্ফোরণ করব!”

পরিবারের বয়ান

কাঁদতে কাঁদতে সুবর্ণা বলছিলেন, ‘‘কে একটা ভাসুরকে ফোন করল। ফোন করে বলল, বাইরে ঝামেলা হচ্ছে। শিগগির আসতে। সে কথা শুনেই ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল ভাসুর। তখন বাইরে তুমুল চিৎকার হচ্ছে। ছেলে ফিরছে না দেখে শাশুড়ি দেখতে গিয়েছিল। তার পরেই এই ঘটনা!’’ সুবর্ণা জানান, তাঁদের বাড়ির অদূরেই বাজার। রথিবালা ছেলের খোঁজে বেরিয়ে যাওয়ার কিছু ক্ষণের মধ্যো চিৎকারের তীব্রতা আরও বেড়ে যায়। হঠাৎই গ্রামের এক জন জানান, রথিবালা ও সঞ্জয়কে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা মেরে ফেলে রেখে গিয়েছে! ওই বধূর কথায়, ‘‘আমিও চিৎকার করতে করতে ছুটে যাই। চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে গ্রামের লোকেরাও ঝাঁকে ঝাঁকে বেরিয়ে আসে। গ্রামের লোকেদের আসতে দেখে পালিয়ে গিয়েছিল ওরা (হামলাকারীরা)। গ্রামের লোকেরা তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল শাশুড়ি আর ভাসুরকে। কিন্তু শাশুড়িকে বাঁচাতে পারলাম না আমরা!’’ বৃহস্পতিবার দুপুরেও বাজারের রাস্তায় চাপ চাপ রক্তের দাগ ছিল। পাশেই রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন বিজেপির কর্মী-সমর্থকেরা। তাঁদের মধ্যে এক জন নিজেকে প্রত্যক্ষদর্শী বলে দাবি করে বলেন, ‘‘ছেলেকে খুঁজতে খুঁজতে ছুটে এসেছিলেন রথিবালা। সেই সময় বাজারে বিশাল ঝামেলা চলছিল। রথিবালা শুধু তাঁর ছেলেকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। কিন্তু ছেলে যে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে, তা অন্ধকারে বুঝতে পারেননি। অনেকেই চারদিকে আহত হয়ে পড়েছিলেন। সেই সময় অন্ধকারে ছেলেকে দেখতে না-পেয়ে বাজারের পাশে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছিলেন রথিবালা। তখনই কেউ পিছন থেকে রড দিয়ে তাঁর মাথায় সজোরে মেরে দেয়। মাথা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। সেখানেই লুটিয়ে পড়েন রথিবালা। রক্তে চারিদিক ভেসে যাচ্ছিল। এর পর গ্রামের প্রচুর লোক জড়ো হতেই হামলাকারীরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। সকলকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াও হয়। কিন্তু রথিবালাকে বাঁচানো গেল না!’’ মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে সকালেই হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলেন মেয়ে। কান্নায় ভেঙে পড়ে তিনি বলেন, ‘‘আমার দাদা আর মাকে মেরে দিল টিএমসির লোকেরা। ওরা ১০০ থেকে ১৫০ জন এসেছিল একসঙ্গে। সেই সময় বিজেপির যাকে সামনে পেয়েছে, ওরা মেরেছে। মাকে তো আর ফিরে পাব না! আমি এই দোষীদের কঠোর শাস্তি চাই। এদের সকলের যেন ফাঁসির সাজা হয়।’’

কী বক্তব্য তৃণমূলের

রাজীবের দাবি, গোটা ঘটনার পিছনে বিজেপির আদি-নব্য দ্বন্দ্ব রয়েছে। নন্দীগ্রামের যে জায়গায় ঘটনাটি ঘটেছে, সেখানে তৃণমূল দুর্বল। বিজেপিই ছাপ্পা দিয়ে ভোট করায়। আসলে দুই গোষ্ঠীর লড়াইয়ে মহিলার মৃত্যু হয়েছে। এখন সেই ঘটনা নিয়ে রাজনীতি করছে বিজেপি। রাজীবের মতে, “গতকাল অভিষেকের সভায় মানুষের ঢল নেমেছিল। হাজার হাজার মহিলা সেই সভায় ভিড় জমিয়েছিলেন। এ বার নন্দীগ্রামের দু’টি ব্লক থেকেই বিপুল পরিমাণে ভোট পাবে তৃণমূল। সেই জায়গায় আচমকা এমন একটি উত্তেজনার পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে, যাকে কাজে লাগিয়ে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের বাড়িছাড়া করার কৌশল নেওয়া হয়েছে। যে কায়দায় নন্দীগ্রামে সিপিএমের বাহিনী এলাকা দখল করত, এখন তারাই নব্য বিজেপির ভেক ধরে অবলীলায় এলাকায় সন্ত্রাস চালাচ্ছে।’’ রাজীবের সংযোজন, ‘‘এটাই তো নব্য বিজেপিদের রাজনীতি। ওরা বদলা চায়, আমরা বদল চাই। কারা এতগুলো ঘর ভেঙেছে, কারা এতগুলো দোকান-বাড়ি লুট করে আগুন ধরিয়েছে, এরা সকলেই নব্য বিজেপির কর্মী। যে এলাকায় মহিলার মৃত্যু হয়েছে, সেখানে বিজেপির একচ্ছত্র রাজত্ব রয়েছে। আদি-নব্য কোন্দলকে এখন তৃণমূলের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা হচ্ছে।”

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy