খেড়িয়া-শবর জনগোষ্ঠীর প্রতিটি শিশুকে শিক্ষাদানের চেষ্টায় তৈরি হয়েছে স্বপ্নের স্কুলবাড়ি। সেই বাড়িতেই তিলে তিলে গড়ে উঠছে দুঃসাহসের স্পর্ধা। ইতিহাস অনুযায়ী, ব্রিটিশরা ‘জন্মগত অপরাধী’র তকমা দিয়েছিল খেড়িয়া-শবর জনগোষ্ঠীকে। সেই পরিচয় বদলাতে জনগোষ্ঠীর পরবর্তী প্রজন্মের ছেলেরা এখন মহাকাশের তারাদের সঙ্গে কথা বলে, জৈবিক উপায়ে কৃষিকাজ করে। অনেকে আবার ফুটবল খেলে আরও বড় হওয়ার স্বপ্নও দেখে।

ফুটবল খেলার জন্য প্রতিদিন বরাদ্দ থাকে বেশ কিছুটা সময়। নিজস্ব চিত্র।
সমাজের মূলস্রোতে এগিয়ে থাকার লড়াইটা আর পাঁচটা মানুষের মতো সহজ ছিল না নির্মল শবর, রমনিতা শবরের। নির্মল খেড়িয়া-শবর জনগোষ্ঠীর প্রথম স্নাতক এবং রমনিতা প্রথম মহিলা স্নাতক। এমন আরও ছেলেমেয়ে যাতে পড়াশোনার সুযোগ পায়, তার জন্য ২০১৯-এর ২৬ জানুয়ারি ক্রাউড ফান্ডিং দিয়ে তৈরি হওয়া রাজ্যের প্রথম আবাসিক স্কুল চালু করা হয়েছিল। সেই স্কুলের নাম স্বপ্নের স্কুলবাড়ি। পুরুলিয়ার মানবাজারের সিন্দরী গ্রামের সেই স্কুলকে ঘিরে অনেক আশা রাখেন নির্মল।
তিনি বর্তমানে একটি স্কুলের শিক্ষক। তবে, তাঁর বেতনের বেশির ভাগটাই স্কুলের ছেলেদের জন্য খরচ করেন তিনি। যেটুকু বাঁচে, তা শবর জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, খাদ্যের রসদ সংগ্রহে ব্যয় করেন। নিয়মিত বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে খেড়িয়া-শবরদের সঙ্গে কথা বলেন, তাঁদের বোঝান কেন পড়াশোনা করা প্রয়োজন, কেন টাকা অর্জনের জন্য ডিগ্রি থাকা প্রাসঙ্গিক। তাঁর এই প্রচেষ্টাই স্বপ্নের স্কুলবাড়ির ভিত গড়েছে।

খেলা শুরু আগে ওয়ার্ম আপ সেশন চলে। নিজস্ব চিত্র।
তবে তার জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিলেন কলকাতার বেশ কিছু তরুণ- তরুণী। কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ সাংবাদিক, আবার কেউ চিকিৎসক। স্কুল খোলার জন্য সমাজমাধ্যমে ক্রাউড ফান্ডিং করেছিলেন তাঁরা। অবশেষে ৭০০ জনের পাঠানো ২১ লক্ষ টাকা দিয়ে বানানো হয় ওই স্কুলবাড়ি। স্কুলের যাবতীয় দায়ভার শবর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের হাতে রয়েছে।
ওই স্কুলে সময়মতো ছেলেরা ঘুম থেকে ওঠে, পড়তে বসে, খাবার খায়, স্কুলে যায়, স্কুল থেকে ফিরে মাঠে খেলতে চলে যায়। কেউ কেউ গান, নাটক, কবিতা চর্চাও করে। একই সঙ্গে স্কুল চত্বর পরিষ্কার করা, বিছানা গুছিয়ে রাখা, গাছে জল দেওয়া, বিভিন্ন স্থানীয় পরব এবং উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করার মতো গুরুদায়িত্বও পালন করে প্রসেনজিৎ, দীপঙ্কর, কার্তিক, সাগর, শক্তিপদ, সোমনাথ, শ্রাবণ, সুবোধেরা। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোতে স্থানীয় স্কুলে এবং কোচিং সেন্টারেও পড়তে যায় ছেলেরা।

খেলাশেষে পড়তে বসার জন্য বেশি সময় ব্যয় করতে নারাজ ছেলেরা। নিজস্ব চিত্র।
রিল-সমাজমাধ্যমের হুটোপাটির বাইরে লালমাটির খোলা মাঠে দু’হাত তুলে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখে ছেলেরা। তারকা ফুটবলারদের বিখ্যাত শট খেলা বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান গাইতে পারাটা ওদের কাছে অন্যতম সাফল্য। এই স্বপ্নের দৌড়ে শামিল হতে চায় গ্রামের মেয়েরাও। তাই আগামী দিনে যাতে মেয়েরাও স্বপ্নের স্কুলবাড়ির সদস্য হতে পারে, তার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন নির্মলেরা।