এক টাকার পাঠশালা। নিজস্ব চিত্র।
জলেই কাটে জীবনের অধিকাংশ সময়। পেশায় মার্চেন্ট নেভির নাবিক। সামুদ্রিক ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে জাহাজকে সঠিক দিশায় পৌঁছে দেওয়াই তাঁর কাজ। জলের পাশাপাশি স্থলভাগেও তিনি একই কাজে লিপ্ত। গত কয়েক বছর ধরে উত্তর ২৪ পরগনার টুনিঘাটা গ্রামের প্রান্তিক পড়ুয়াদের জীবনকে সঠিক দিশা দেখাতে উদ্যোগী সঞ্জীব কাঞ্জিলাল। বছর ৪২-এর এই যুবক তাঁর অন্যান্য সহযোদ্ধাদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন ‘১ টাকার পাঠাশালা’।
হাবরা জেলার কুমড়াকাশিপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনস্থ টুনিঘাটা গ্রামেই জন্ম সঞ্জীবের। পড়াশোনা শেষ করে শুরু চাকরি জীবন। তবে দশটা-পাঁচটার গতে বাঁধা চাকরি নয়। ইচ্ছে ছিল, জলের জীবন বেছে নেওয়ার। মার্চেন্ট নেভির নাবিক হয়ে সেই ইচ্ছে পূরণ হয়। গত ১৫ বছর ধরে সেই চাকরি করেই সংসার চলে। কিন্তু ছোট থেকে আরও একটা সুপ্ত ইচ্ছে ছিল সঞ্জীবের। সমাজসেবার। বিশেষত, নিজের এলাকার উন্নয়নের জন্য কিছু করার। চাকরিজীবনের কিছুটা পুঁজি জমিয়ে তাই সেই ইচ্ছেপূরণের পথে পা বাড়ান। সমাজসেবামূলক কাজের জন্য এলাকার তরুণ প্রজন্মকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘টুনিঘাটা পিপলস মুভমেন্ট অফ হিউম্যান রাইটস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’।
কিন্তু সঞ্জীব ও তাঁর সহযোগীরা কী করবেন, সেই বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা ছিল না তাঁদের। করোনা অতিমারির আগে পারুইপাড়া অঞ্চলের জেলে পরিবারগুলি তাঁদের নজরে আসে। এলাকার আদি বাসিন্দা তাঁরা। সেখানকার বৃহৎ নাংলা বিলে ডিঙি নৌকোয় চেপে সারা দিন মাছ ধরেই তাঁদের সংসার চলে। বড়দের পাশাপাশি এই কাজে সামিল হন পরিবারের ছোটরাও। তাই অধিকাংশ ছেলেমেয়ে হয় স্কুলে ভর্তিই হয় না কিংবা ভর্তি হলেও স্কুলছুট। সরকারি স্কুলের চতুর্থ, পঞ্চম বা সপ্তম শ্রেণির হাজিরা খাতায় তাদের নাম থাকলেও একটি বাক্যও তারা সঠিক ভাবে পড়তে বা লিখতে পারে না। এ রকম পড়ুয়াদের স্কুলমুখী করার জন্যই সঞ্জীবরা উদ্যোগী হন। সালটা ২০১৭। এর পরে ২০১৯ থেকে শুরু হয় ‘এক টাকার পাঠশালা’-র পথচলা। শুরুতে পড়ুয়ার সংখ্যা ছিল ৪-৫ জন। অক্ষর পরিচিতি ছাড়াও ছোটদের সৃজনশীলতার দিকেও নজর দেন সঞ্জয় ও সংগঠনের সদস্যরা। শুরু হয় গান, নাচ, তবলা, আঁকা, নাটক এবং কম্পিউটারের ক্লাসও। সঠিক ভাবে পাঠদানের জন্য বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকও নিয়োগ করা হয়।
কিন্তু যে পড়ুয়ারা স্কুলে যেতে চায় না, তাদের কী করে এই পাঠশালায় নিয়ে আসছেন? সঞ্জীবের কথায়, “আমরা নানা রকম কৌশল প্রয়োগ করার চেষ্টা করি। যাতে ওরা পাঠশালায় আসা বন্ধ না করে, তার জন্য কখনও ওদের বিরিয়ানি বা অন্যান্য খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করি, আবার কখনও জামাকাপড় উপহার দিই। পাশাপাশি খেলাচ্ছলে নানা জিনিস শেখাই। যাতে পাঠশালার প্রতি আকর্ষণ না কমে।” সবাই মিলে চেষ্টা বিফলে যায়নি। এখন পড়ুয়ার সংখ্যা বেড়ে ২৫ থেকে ৩০ জন। এমনকি, করোনাকালে যখন স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা কমে গিয়েছিল, এই পাঠশালায় পড়ুয়ার সংখ্যা বেড়ে হয়েছিল ৮০-৮৫ জন। সেই সময়ে দিনের বিভিন্ন সময়ে বাড়ি বাড়ি গিয়েও ক্লাস নিতেন তাঁরা।
সঞ্জয়ের কথায়, “আমাদের পাঠশালার কোনও নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই। শুরুতে এলাকার মেহগনি গাছের ছায়ায় খোলা মাঠে ক্লাস হত। এর পরে নাংলা বিলের পাশে ক্লাস স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু বিলের জল ডাঙায় উঠে আসায় ক্লাসের জায়গা আবার বদল হয়। ক্লাসের আয়োজন করা হয় পার্শ্ববর্তী বাগানে। তবে নিজেদের অফিসেও কিছু ক্লাস করাই।”
সঞ্জীব জানিয়েছেন, এই কাজের অধিকাংশ খরচ তিনিই বহন করেন। তবে সহযোগিতা করেন তাঁর সংগঠনের সদস্য, পরিচিত জন এবং সহৃদয় ব্যক্তিরা। পড়ুয়ারাও গুরুদক্ষিণা হিসাবে এক টাকা দেয়। যার বিনিময়ে তাদের হাতেই খাতা, পেন তুলে দেওয়া হয়। আর তাই এই উদ্যোগটি ‘এক টাকার পাঠশালা’ নামে পরিচিত। উদ্দেশ্য একটাই, প্রান্তিক পড়ুয়াদের শিক্ষার আঙিনায় ফিরিয়ে আনা। তবে শুধু নিজের এলাকাতেই এই সাধু উদ্যোগকে সীমিত রাখেননি সঞ্জীব। সম্প্রতি পুরুলিয়ার আদিবাসী পড়ুয়াদের স্কুলমুখী করার দায়িত্বও কাঁধে তুলে নিয়েছেন তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy