Advertisement
১০ জানুয়ারি ২০২৫
Right to Education in India

মানবাধিকারের সুতোয় বাঁধা শিক্ষা-সহ অনেক কিছুর অধিকার, কোথায় দাঁড়িয়ে আমাদের দেশ?

ভারতের সংবিধানও শিক্ষার অধিকারকে একটি মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

প্রতীকী চিত্র।

প্রতীকী চিত্র।

দেবী চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৭:২৬
Share: Save:

প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসে বিশ্ব জুড়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস পালিত হয়। ভারতও এর ব্যতিক্রম নয়। দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রতিটি মানুষের মানুষ হিসাবে বাঁচার ন্যূনতম চাহিদা বা অধিকারগুলির কথা। ১৯৪৮ সালের ১০ই ডিসেম্বর রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদে বিশ্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে এর ভিত্তিস্তম্ভ গ্রহণ করা হয়। সেটিকে কেন্দ্র করে বিশ্বে মানবাধিকার চেতনার এক দীর্ঘ যাত্রাপথের সূচনা হয়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ ইত্যাদির ভেদাভেদ নির্বিশেষে মানুষের মৌলিক অধিকারগুলির স্বীকৃতি দেওয়া হয়। মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে অন্যান্য অধিকারের পাশাপাশি, ২৬ নম্বর ধারায় সর্বজনীন শিক্ষার অধিকার স্বীকৃত। সেখানে বলা হয়েছে, প্রতিটি মানুষের শিক্ষার অধিকার আছে, যা প্রাথমিক স্তরে বাধ্যতামূলক এবং বিনামূল্যে হওয়া উচিৎ।

ভারতের সংবিধানও শিক্ষার অধিকারকে একটি মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০০২ সালের ছিয়াশিতম সংবিধান সংশোধন আইন অনুসারে, সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত ২১ ‘এ’ ধারাতে ৬ থেকে ১৪ বছরের শিশুদের বিনামূল্যে বাধ্যতামূলক শিক্ষার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে, শিক্ষার প্রসারের প্রতিশ্রুতিকে রূপায়িত করতে কেন্দ্র এবং রাজ্য স্তরেও গৃহীত হয়েছে নানা প্রকল্প।

তবু , বাস্তব ছবিটা নানা দিক থেকে উদ্বেগের। এক দিকে, বিপুল সংখ্যক ছেলেমেয়ে আজও স্কুলের বাইরে। হয় তারা কখনও স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়নি, নয়তো ভর্তি হয়েও কোনও না কোনও ক্লাসে তারা স্কুলছুট। অন্য দিকে, শিশু শ্রমিকের সংখ্যাও দুশ্চিন্তার কারণ। বলাবাহুল্য, এই দুইয়ের মধ্যেকার সংযোগ স্পষ্ট। দারিদ্র শিক্ষার চাহিদা ও আকঙ্ক্ষার কণ্ঠ রোধ করে। এ ক্ষেত্রে, ছাত্রদের মিড ডে মিল, বিনামূল্যে শিক্ষাদান এবং নানা খাতে আর্থিক অনুদানের যে সব পরিকল্পনা রয়েছে, তা যথোপযুক্ত বা যথেষ্ট আকর্ষণীয় নয়। যে কোনও হতদরিদ্র পরিবারে একজন শিশু পরিবারের আয় বৃদ্ধির যন্ত্র হিসাবে গণ্য হয়। বিষয়টি যতই অবাঞ্ছিত এবং লজ্জাজনক হোক না কেন, বাস্তবে শিশুটির শ্রমই বাড়ির অন্যদের জন্য অন্নসংস্থানের সুযোগ করে দেয়।

কোভিডের দু’টো বছর এই পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। বহু পরিবাররেই অর্থসংস্থানের সব পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। কোথাও আবার বড় রকম ধাক্কা আসে জীবন ও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে। অনেকেই সে ধাক্কা আজও সামলে উঠতে পারেননি। এই সমস্ত পরিবারে সন্তানদের শিক্ষার পিছনে ব্যয় ও পড়াশোনার বিষয়ে মনসংযোগ করা বিলাসিতা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে সে সব পরিবারের পড়ুয়ারা ধীরে ধীরে অনেকেই স্কুলছুট হয়ে পড়ে।

কোভিড পরিস্থিতির চাপে দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে অনলাইনে পঠনপাঠন চলে। পরবর্তীকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দরজা খুললেও অনলাইনে জ্ঞান আহরণ পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই ব্যবস্থায় শহরাঞ্চলের মধ্যবিত্ত ও স্বচ্ছল পরিবারের পড়ুয়ারা মানিয়ে নিতে পারলেও, প্রান্তিক এলাকার প্রান্তিক পরিবারের এসব একরকম বিড়ম্বনা হয়ে দাঁড়ায়। এই পরিবারগুলির অধিকাংশই আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া সংখ্যালঘু, তফশিলি জাতি, জনজাতি গোষ্ঠীর। বংশ পরম্পরায় এরা বঞ্চিত এবং ঐতিহাসিকভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্রাত্য। ফলে দ্বিধাবিভক্ত সমাজে ক্রমশ বিভাজন আরও বাড়তে থাকে। এক দিকে থাকে স্কুলে ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত, স্কুলছুট এবং অতি কম-সুবিধাযুক্ত সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়া অগণিত নিম্নবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়ে। অন্য দিকে, বিলাসবহুল, উচ্চমানের, অত্যাধুনিক কর্পোরেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির পড়ুয়ারা। এই দুই কাঠামোর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কি সস্তার শ্রমিক ও মালিক গড়ার ভিন্নভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা ও পরিকাঠামো বললে ভুল হবে? বিশেষত, যেখানে, বিশ্বায়িত দুনিয়ায় বেসরকারিকরণই প্রধান থিম !

শিক্ষার অধিকার মানবাধিকারের ধারণার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবে যুক্ত। এটি যেমন একটি মৌলিক অধিকার, তেমনই অন্যান্য অধিকার উপলব্ধ করার অমূল্য হাতিয়ার। ফলে, শিক্ষালাভের পথে প্রতিবন্ধকতাগুলি ভাঙ্গা অতি আবশ্যক। সেটা করতে হলে মানবাধিকারের সারমর্ম বুঝতে হয়। সেখানে শিক্ষার অধিকারকে কোনও বিচ্ছিন্ন অধিকার হিসাবে বিবেচনা করলে চলে না। খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্য সুনিশ্চিত না হলে, শিক্ষার অধিকারকে কি সুনিশ্চিত করা সম্ভব? পরিবারের নিরাপত্তা ছাড়া কি শিশুর নিরাপত্তা হয়? আবার কর্মসংস্থান ছাড়া কি একটি পরিবারের নিরাপত্তা সম্ভব? ফলে, শিক্ষার অধিকারের কথা বলতে গেলে আমাদের অন্যান্য অনেক মৌলিক অধিকারের প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। কারণ, মানবাধিকারের চেতনায় আলাদা আলাদা অধিকারগুলি এক সুতোয় বাঁধা, একটার ওপর আরেকটা নির্ভরশীল।

(লেখিকা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপিকা)

অন্য বিষয়গুলি:

Human Rights Right to Education Primary Education Indian Education System
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy