প্রতিদ্বন্দ্বী? লিয়োনেল মেসি (বাঁ দিকে) ও তাঁর ‘চ্যালেঞ্জার’ ফিয়োরেইয়া কাস্তিইয়ো।
গায়ে-গায়ে গুঁতোগুঁতি, পায়ে-পায়ে ল্যাং রক্ত-চাউনিতে এ-ওকে মেপে নেওয়ার খুনে ‘ইন্সটিংক্ট’ ফুটবল খেলাটার গায়ে বড্ডই বেশি পুরুষ-পুরুষ গন্ধ! বিশ্বকাপের গ্যালারিতে ব্রাজিল-পতাকা-রঙা যে বিকিনি-সাগরের ঢেউ, বা কালো চুল-কালো চোখ-নিখুঁত বক্ষ-বিভাজিকার যে হিস্পানি যুবতীরা, সব ওই পুরুষতান্ত্রিক উত্সব আয়োজনের কেকের মাথায় আইসিং! স্টেডিয়ামের ভেতরে বা টেলিভিশন সেটের সামনে বসে থাকা কোটি কোটি পুরুষ চোখের আরাম হয়, তাই ওরা আছে, হাসছে, দুলছে, নাচছে, কাঁদছে! ছেলেটা যদি মনে করে ‘মেরে অঙ্গনে মে তুম্হারা কেয়া কাম হ্যায়’, তা হলে ‘চলে যাও সিধে রাস্তা’ বলে ঘাড়টি ধরে বার করে দেবে।
যেমন দেওয়া হয় ইরানে। ধর্মগুরুর ফতোয়া-মাফিক সে দেশে মেয়েদের স্টেডিয়ামে গিয়ে ফুটবল ম্যাচ দেখা নিষেধ। ধরা পড়লে সিধে সংশোধনাগার বা বিশেষ হোম-এ নিয়ে গিয়ে তোলা হবে। সেখানে ওই মেয়েদের চিত্তশুদ্ধি করা হবে, যাতে ফুটবলের ভূত তাদের মগজে আর না চাপে। কয়েক বছর আগে একটা ছবি বানিয়েছিলেন ইরানের রাষ্ট্র-নিষিদ্ধ পরিচালক জাফর পানাহি। ‘অফসাইড’ নামে এই ছবিটায় পুরো ঘটনাটাই ঘটছে তেহরানের এক ফুটবল স্টেডিয়ামে, যেখানে বিশ্বকাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ডের ম্যাচ খেলছে ইরান আর বাহরিন। কিন্তু ছবিতে আমরা সে খেলার একটা-দুটো ঝলক ছাড়া কিছুই দেখতে পাই না, কারণ আসল খেলাটা তো হচ্ছে স্টেডিয়ামের পিছন দিকটায়। যেখানে পুরুষের পৃথিবীতে ‘অনুপ্রবেশ’-এর দায়ে কয়েক জন দুঃসাহসিনী ইরানি তরুণীকে আটকে রাখা হয়েছে। আর সেই মেয়েরা নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে তর্ক করে ফাটিয়ে দিচ্ছে। সেই তর্ক থেকে পরিষ্কার হয়ে যায়, এই মেয়েগুলো স্টেডিয়ামের পুরুষ রক্ষীদের চেয়ে ফুটবলের ব্যাপারে অনেক বেশি খবর রাখে। একটি মেয়ে তো নিজেই ফুটবলার। আর সে এত ভাল ড্রিবলিং করে যে তার ক্লাবের মেয়েরা আদর করে তাকে ‘ড্রিবল রানি’ বলে ডাকে। কিন্তু তার পরেও দেশের আইন তাকে পুরুষদের ফুটবল খেলা পুরুষ-দর্শকদের সঙ্গে এক স্টেডিয়ামে বসে দেখতে দেবে না।
কেন যে দেবে না, তার যুক্তিগুলো স্টেডিয়ামে থাকা রাষ্ট্রের প্রতিনিধি, মানে ওই সাদাসিধে, আধা-মফস্সলি নিরাপত্তা কর্মীদের কাছেও খুব পরিষ্কার নয়। তাই ওই তুখোড়-স্মার্ট শহুরে মেয়েগুলোর প্রবল আক্রমণের সামনে তারা নাজেহাল-দিশেহারা হয়ে যায়। এলোপাথাড়ি অজুহাত সাজায়। শেষ পর্যন্ত জোর করেই তাদের পুলিশ ভ্যানে তুলে সংশোধনাগারের দিকে রওনা করে দেয়।
ঐস্লামিক বিপ্লব-উত্তর ইরানে তো অনেক ব্যাপারেই মেয়েদের প্রচুর ‘কোরো আর কোরো না’ শুনে চলতে হয়। কিন্তু ফুটবল নিয়ে হুল্লোড় ব্যাপারটা যে ‘ব্যাটাছেলেদেরই’ মানায়, সেটা নিয়ে উন্নত প্রথম বিশ্ব থেকে শুরু করে আমাদের পাশের বাড়ির স্বাতীদির পিসিমা পর্যন্ত কারওই ভাবনায় খুব একটা তফাত নেই। আমরা যখন হাতকাটা গেঞ্জি আর হাফ প্যান্টুলুন পরে বাপিদের বাড়ির পাশের ছোট্ট খুপরি মাঠটায় বড় রবারের বল নিয়ে পেটাপিটি করতাম, তখন স্কুল-ফেরতা স্বাতীদিও কখনও-সখনও স্কার্ট-ব্লাউজ পরে আমাদের সঙ্গে নেমে মাঠের ডিপ-ডিফেন্সে, কলাবিনুনি বাঁধা স্বাতীদির ট্যাকল এড়িয়ে বল গোল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া বেশ কঠিনই ছিল।
বাংলায় তখনও মেয়েদের ফুটবল শুরু হয়নি। শান্তি মল্লিক, কুন্তলা ঘোষদস্তিদারদের নাম আমরা তখনও শুনিনি। তাই স্বাতীদিকে আমরা পাঁড় ইস্টবেঙ্গল-পাড়ার ছোটরা কখনও নইম, কখনও অশোকলাল ব্যানার্জির সঙ্গে তুলনা করতাম। ’৭৫-এর শিল্ড-ফাইনালে মোহনবাগানকে ৫-০ গোলে হারানোর বিকেলে স্বাতীদির পান্ডাগিরিতেই আমরা ফুটো ঘটি আর শ্যাম থাপা-সুভাষ ভৌমিকের ছবি নিয়ে গোটা পাড়া ঘুরেছিলাম। আর সে দিনই স্বাতীদি বাড়ি ফিরে মার খেল! ওর পিসিমা চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে গাল পাড়লেন ‘সিঃ, হায়া নেই তর? সোমত্ত মাইয়া, পুরুষ মান্সেদের সাথে হইহই করস্! আরে ফুটল অইল গিয়া ব্যাটাছিলাদের ঘুঁষি-লাথির খেলা! তর অহনে কী কাম?’ আমরা ‘পুরুষমান্সেরা’ তখন সিক্স-সেভেন, স্বাতীদি ক্লাস নাইন কি টেন! কী করেই বা তখন ভাবব, আরও সিকি-শতাব্দী পরে গুরিন্দর চাড্ডা নামে এক অনাবাসী মহিলা পরিচালক, এক পাঞ্জাবি-ব্রিটিশ মেয়ে-ফুটবলারকে নায়িকা করে আস্ত একটা ছবি বানাবেন? আর সেই সিনেমায় ফুটবল-নায়িকার ঘোর ‘স্বদেশি’ মা, টিপিকাল স্বাতীদির পিসিমার গলাতেই ডুকরে উঠবেন ‘ফুটবল সুট্বল? হায় রাব্বা!’ কলেজে উঠতে উঠতেই স্বাতীদির বিয়ে হয়ে গিয়েছিল।
অথচ ওই ’৭৫-এই কিন্তু ভারতে মেয়েদের ফুটবল টুর্নামেন্ট শুরু হয়ে গিয়েছিল। ও দিকে ফুটবলের জন্মভূমি ইংল্যান্ড, এমনকী শিল্পভূমি ব্রাজিলেও তখনও পর্যন্ত মেয়েদের ফুটবল খেলা নিষিদ্ধ। হ্যঁা, ইরানে মেয়েদের পুরুষদের ফুটবল খেলা দেখা যেমন নিষিদ্ধ, সে ভাবেই মেয়েদের ফুটবল খেলা আইনমাফিক বারণ ছিল ব্রাজিল, ইংল্যান্ড সহ অনেকগুলো প্রথম সারির ফুটবল খেলুড়ে দেশে। আপত্তির কারণ হিসেবে চিকিত্সাবিজ্ঞানের যুক্তি দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, মেয়েদের শরীরের গড়ন ফুটবলের মতো ‘বডি-কনট্যাক্ট গেমের’ ধকল নিতে পারবে না। মুখে অ্যানাটমির কথা বললেও, মনে মনে হয়তো ফুটবল-পায়ে মেয়েদের কতটা বেমানান লাগে, সেই ছবিটাই দেখার চেষ্টা চলছিল। মেয়েরা মত্স্য-কন্যার মতো সুইমিং পুল তোলপাড় করবে, ছোটখাটো স্কার্ট পরে ফুলপরীর মতো টেনিস কোর্টে উড়ে বেড়াবে! নরম-পেলব ফেমিনিন-সৌন্দর্যের সঙ্গে ওই খেলাগুলো বেশ যায়। সেখানে ফুটবলের মতো ধুমধাড়াক্কা মদ্দা-মদ্দা ব্যাপার, কেমন একটা লাগে না?
ফিফা-র কর্মকর্তারা ১৯৮৯-এর আগে মেয়েদের ফুটবলকে স্বীকৃতি দেননি। ফিফার দ্বিধা-দোলাচল ছিল বলেই মেয়েদের বিশ্বকাপটা শুরু হতে হতে ১৯৯১ হয়ে যায়। অথচ ১৯৮৩ সালেই শান্তি মল্লিককে ‘অর্জুন’ পুরস্কার দেওয়া হয়। মহিলা ফুটবলার হিসেবে তিনিই দেশের প্রথম ও একমাত্র ‘অর্জুন’! তাতে যে ভারতে মহিলা ফুটবলের মস্ত কিছু উন্নতি হয়েছিল, তা নয়। কিন্তু এটাও ঘটনা, ফুটবলের যারা প্রথম বিশ্ব, মানে ছেলেদের খেলায় ইউরো কাপ থেকে বিশ্বকাপ পর্যন্ত যে-সব দেশ মাঠে দাদাগিরি দেখায়, মেয়েদের বিশ্বকাপে তাদের চেয়ে কিন্তু অনেক বেশি সফল এশিয়ার দেশগুলো। প্রথম বার বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল চিন। এই মুহূর্তে বিশ্ব-চ্যাম্পিয়ন জাপান। এমনকী, যে ইরানে মেয়েদের পুরুষদের ফুটবল দেখতে দেওয়া হয় না, তাদেরও কিন্তু জাতীয় মহিলা ফুটবল দল আছে। মেয়েদের ফুটবল খেলাটা সেখানে নিষিদ্ধ নয়।
তার মানে এই নয় যে, ছেলেদের ফুটবলে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোয় মহিলা ফুটবল নিয়ে একেবারে উত্সাহের ঢেউ বইছে। ভারতের কথাই ধরুন। ফিফা র্যাঙ্কিং-এ ভারতীয় মহিলা ফুটবল দল, ছেলেদের অন্তত ১০০ ধাপ উপরে আছে। কিন্তু এ দেশে মেয়েদের ফুটবলটা আদৌ টিকে আছে কি না, সেই খবরটাই কেউ রাখে না! আসলে এ দেশ-বিদেশ কোথাও মেয়েদের ফুটবল খেলাটাকেই সিরিয়াসলি নেওয়া হয় না। এই মুহূর্তে ব্রাজিলে ফুটবলের এই মহাযজ্ঞে কেউ মেয়েদের ফুটবল-বোধবুদ্ধি নিয়ে কিছু জানতে চাইছে না! মিডিয়া ‘ওয়াগস’ বা তারকা ফুটবলারদের স্ত্রী-গার্লফ্রেন্ডদের গ্ল্যাম-কোশেন্ট আর ভাইটাল-স্টাটস নিয়েই মেতে আছে। এমনকী যে আর্জেন্তিনীয় মডেল-কন্যাটি ব্রাজিল-সৈকতে ফুটবল-জাগলিংয়ে ৮০০ পুরুষকে গো-হারা হারিয়ে এখন স্বয়ং মেসি’কে চ্যালেঞ্জ ছুড়ছেন, মিডিয়া তাঁকেও সাহসী-বিকিনি, উত্তেজক বক্ষ-বিভাজিকা সহ আইটেম গার্লই বানাতে চেয়েছে।
তবু বিশ্বকাপের এই সব হইহুল্লোড়ের মধ্যেই ব্রিটেনে মুক্তি পেয়েছে ৯৭ মিনিটের একটি তথ্যচিত্র ‘নেক্সট গোল উইনস’। পলিনেশীয় একটি ছোট্ট দ্বীপ-দেশের বিশ্বকাপ অভিযান নিয়ে এই ছবিতেই আমাদের আলাপ জাইয়া সায়েলুয়ার সঙ্গে। জাইয়া যে দেশের মানুষ, সেই আমেরিকান সামোয়াকে ভূগোলের বইতেই খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। আর ফুটবলের মানচিত্রে তো তাকে প্রান্তিকতম বললেও অনেক কম বলা হয়! কিন্তু একটা জায়গায় আমেরিকান সামোয়া পৃথিবীর সমস্ত ফুটবল-খেলুড়ে দেশদের হারিয়ে দিতে পারে। কারণ, তাদের দলে এক জন সায়েলুয়া আছে। জাইয়া সায়েলুয়া এক জন ‘ফ্যাপাইন’। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। পুরুষ হয়ে জন্মালেও মেয়ে হিসেবে বড় হয়েছেন। পলিনেশীয় সংস্কৃতিতে ফ্যাপাইন-দের সামাজিক স্বীকৃতি আছে। আর পাঁচ জনের মতো তাঁরাও স্বাভাবিক জীবনযাপন করেন ব্রাত্য, বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হয় না। কিন্তু সায়েলুয়ার মতো কোনও ফ্যাপাইনকে জাতীয় দলে ফুটবল খেলতে দেখা যায়নি। সায়েলুয়া ১৪ বছর বয়স থেকে জাতীয় দলের সেন্টার হাফে খেলছেন (এটাও একটা রেকর্ড)! কিন্তু আমেরিকান সামোয়ার ফুটবল দলের নতুন ডাচ ম্যানেজার টমাস রন্জেন সায়েলুয়াকে প্রথম একাদশে নিতেই চাননি! ফুটবল-পৌরুষের দীপ্তিতে আচ্ছন্ন প্রথম বিশ্বের কোচ তাঁর লম্বা চুল, কণ্ঠস্বর, হাঁটা-চলা, কথা বলার ভঙ্গি দেখে ভরসা করতে পারছিলেন না। কিন্তু ক্রমশ তিনি দেখলেন, সায়েলুয়া ম্যানিকিয়োর করা নখে যেমন যত্নে নেলপালিশ পরেন, চোখে মাসকারা লাগান, মাঠে তেমনই চোখ নিয়ে ট্যাকলে যান! দুর্দান্ত অ্যান্টিসিপেশন-এ বিপক্ষের আক্রমণ বানচাল করেন!
রন্জেন মানেন, সায়েলুয়া যদি ইংল্যান্ড, ইতালি, স্পেন বা নেদারল্যান্ডসের ফুটবলার হতেন, তা হলে তাঁকে হয়তো লিঙ্গবৈষম্য এবং যৌন হেনস্থার শিকার হতে হত। কিন্তু পলিনেশীয় ঐতিহ্য তাঁকে দেশের সেরা ডিফেন্ডার বানিয়েছে! ২০১১-এর নভেম্বরে ওশেনিয়ান্স জোন-এর কোয়ালিফায়িং রাউন্ডের ফুটবল ইতিহাসের প্রথম জয়ে সায়েলুয়ার বিরাট ভূমিকা ছিল। সেই জয়ের পরে ফিফা-র প্রেসিডেন্ট সেপ ব্লাটার সায়েলুয়াকে অভিনন্দন জানান। ‘বেন্ড ইট লাইক বেকহ্যাম’-এর ক্লাইম্যাক্স ম্যাচে জেস-এর ফ্রি কিক বেকহ্যামের শটের মতোই সোয়ার্ভ করে সামাজিক রক্ষণশীলতা আর পারিবারিক পিছুটানের হিউম্যান-ওয়াল টপকে গোলে ঢুকে গিয়েছিল। কাহিনিচিত্রে তো ইচ্ছাপূরণ ঘটেই থাকে। কিন্তু ‘অফসাইড’ ছবিতে ইরানি মেয়েরা স্টেডিয়ামে ঢুকে খেলা দেখতে না পারলেও, এই ২০১৪-র বিশ্বকাপে ইরানের বালিকারা সব অবরোধ ভেঙে, সব ফতোয়াকে ফু করে, রাস্তায়-রেস্তোরাঁয় ছেলেদের পাশাপাশি বসে ইরান-আর্জেন্তিনা ম্যাচ দেখেছেন। এখন সেপ ব্লাটারও কি ফুটবলের প্রখর আগ্রাসী পুরুষবাদের উল্টো রাস্তায় জাইয়া সায়েলুয়াকে এক বিকল্প লিঙ্গ-চেতনার ব্র্যান্ড-দূত করে দিতে পারেন, যাঁর হৃদয়ে নারী আর ট্যাকলিং-এ আত্মপরিচয় বুঝিয়ে দেওয়ার দৃঢ়তা? যদি পারেন, তা হলে বিশ্বকাপের শেষে হয়তো লিয়োনেল মেসিও ওই আর্জেন্তিনীয় যুবতীর সঙ্গে ফুটবল জাগলিং-এর চ্যালেঞ্জে নামবেন। হয়তো।
তথ্যঋণ: শুভ্রাংশু রায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy