Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
প্রবন্ধ ২

মনোরোগী বলে সন্তান কেড়ে নেবেন না

মানসিক রোগী, এই অজুহাতে সম্প্রতি পাভলভ মানসিক হাসপাতালের বাসিন্দা মল্লিকা চক্রবর্তীর সদ্যোজাত শিশুটিকে সরিয়ে দেওয়া হল অন্যত্র। বাড়ির ঠিকানা বলতে না পারায় রাস্তা থেকে অন্তঃসত্ত্বা মল্লিকাকে পাভলভে ভর্তি করে গিয়েছিল পুলিশ। চিত্তরঞ্জন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মল্লিকার ছেলে জন্মায়।

রত্নাবলী রায়
শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

মানসিক রোগী, এই অজুহাতে সম্প্রতি পাভলভ মানসিক হাসপাতালের বাসিন্দা মল্লিকা চক্রবর্তীর সদ্যোজাত শিশুটিকে সরিয়ে দেওয়া হল অন্যত্র। বাড়ির ঠিকানা বলতে না পারায় রাস্তা থেকে অন্তঃসত্ত্বা মল্লিকাকে পাভলভে ভর্তি করে গিয়েছিল পুলিশ। চিত্তরঞ্জন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মল্লিকার ছেলে জন্মায়। কিন্তু মল্লিকার ঠিকানা যে পাভলভ, তাই তিনি অন্য নবজননীদের থেকে আলাদা! নতুন মায়েরা বাচ্চা নিয়ে বাড়ি যান। মল্লিকাকে এক বোঝা দুঃখ নিয়ে ফিরতে হয় মানসিক হাসপাতালে।

এমনটা আগেও ঘটেছে। গত বছর জানুয়ারি মাসে মুনিয়া বর্মণ নামে এক মহিলা পাভলভের ওয়ার্ডেই সন্তানের জন্ম দেন। পরে তাঁদের একটি সরকারি হাসপাতালে পাঠানো হয়। সুস্থ হওয়ার পর মুনিয়া পাভলভেই ফিরে আসেন। কিন্তু তিনি যে মানসিক রোগী। তাই সন্তানকে কাছে রাখতে পারবে না। মায়ের অমতেই শিশুটিকে দিয়ে দেওয়া হয় কোথাও একটা।

প্রশ্নটা এখানেই। কেন মানসিক হাসপাতালে সন্তানকে নিয়ে থাকা যাবে না? কেন মায়ের কাছ থেকে শিশুকে আলাদা করে দেওয়া হবে? মানসিক রোগী হলেই যে কোনও মা সন্তানকে কাছে রাখতে পারবেন না, এমনটা কোথাও বলা নেই। আইনও এই ব্যাপারে চুপ। পুরোটাই হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মর্জিমাফিক। পরিকাঠামো আর রোগীর মানসিক অবস্থার দোহাই দিয়ে সন্তানকে মায়ের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়। ধরে নেওয়া হয় সেই মা সন্তানকে দেখভাল করতে অক্ষম। এই ধরে নেওয়া কীসের ভিত্তিতে? এর কি কোনও প্রমাণ আছে যে মানসিক ভাবে অসুস্থ মা সন্তান প্রতিপালনে অক্ষম? পুরোটাই আসলে সামাজিক নির্মাণ। যেমন আমারা ভেবেই নিই যে, মানসিক রোগীরা নিজের পক্ষে বা অন্য কোনও মানুষের প্রতি বিপজ্জনক। সবচেয়ে চিন্তার বিষয়, এমন ঘটনা বার বার ঘটবে। রাস্তায় আবারও মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় থাকবেন। তাঁদের ‘সেফ কাস্টডি’ বা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ‘পাগলা গারদে’ পুরে দিয়ে ‘কর্তব্য’ সারবে পুলিশ। আর প্রসবের পর একই ভাবে তাঁদের সন্তানকে মায়ের থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হবে।

অক্ষমতার দোহাই

২০০৯ সালে পঞ্জাবে ১৯ বছরের একটি মেয়ে ধর্ষিত হওয়ার পর অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। মেয়েটির মানসিক অবস্থা জানার জন্য সরকারি হাসপাতাল মনস্তাত্ত্বিক ও মনোরোগবিশেষজ্ঞদের নিয়ে তিন সদস্যের কমিটি তৈরি করে। কমিটি বিধান দেয়, মেয়েটি মানসিক প্রতিবন্ধী। তাঁর মনের বয়স মোটে ন’বছর। অতএব তিনি মা হওয়ার যোগ্য নন। তাই তাঁর গর্ভপাত করানো উচিত।

এই অক্ষমতার কথা বার বার ঘুরে ঘুরে আসে। যদি ধরেও নিই, মেয়েটির মনের বয়স নয়, তার মানে এই নয় যে তিনি নিজের জীবনের যে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার হারিয়েছেন, বা সিদ্ধান্ত নিতে অক্ষম। হতেই পারে, সে সিদ্ধান্ত ভুল। কিন্তু তাঁকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে হবে আমাদেরই। বিশ্বাস করতে হবে যে, তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তা ছাড়া, সুযোগ না দিলে কী করে বোঝা যাবে সেই মা সন্তান প্রতিপালনে সত্যিই অক্ষম কি না? দিল্লির সরকারি মানসিক হাসপাতাল আই এইচ বি এ এস (ইনস্টিটিউট অব হিউম্যান বিহেভিয়ার অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্স)-এ গিয়ে দেখেছি মানসিক রোগিণী সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন, শিশুটি যাতে পড়ে না যায়, সেই খেয়াল রাখছেন, তার জামা গুছিয়ে রাখছেন। ওঁরা যদি পারেন, আমাদের এখানকার মনোরোগী কোনও মা কেন পারবেন না? আসলে যে কোনও সহজ পন্থা বের করে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলাই আজও দস্তুর।

১৯৯০-এ মহারাষ্ট্রের সিরুতে ১৭ জন মানসিক প্রতিবন্ধী মেয়ের জরায়ু বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। চিকিৎসক, নার্স সহ যাঁরা এটি করলেন, তাঁদের কাছে এটি কোনও অমানবিক ব্যাপার নয়। তাঁদের যুক্তি, মেয়েগুলির স্বার্থেই এ কাজ করা হয়েছে। এর বিরুদ্ধে রিট পিটিশন দাখিল করা হয়। ২০০৯-এ সরকারি হোম কর্তৃপক্ষ হলফনামা দিয়ে জানান তাঁরা যা করেছেন ঠিক করেছে। কারণ এই মেয়েদের হাইজিনের বোধ নেই। কিন্তু এ ভাবে তো মেয়েগুলোর যৌনতা ও মাতৃত্বের অধিকার কেড়ে নেওয়া হল। মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হল। মানসিক স্বাস্থ্য আইন অনুযায়ী এটাও অমানবিক।

আইন কী বলে

মানসিক স্বাস্থ্য আইন বলে, প্রত্যেকটি রোগীর মানবাধিকারকে সম্মান করতে হবে। অমানবিক, নিষ্ঠুর ও অসম্মানজনক আচরণ আটকাতে হবে। মানসিক রোগীদের অধিকার রক্ষার একটি আর্ন্তজাতিক আইনে ভারত স্বাক্ষর করেছে। সেখানে বিশ্বের মানুষের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ যে মানসিক রোগের কারণে কোনও রকম বৈষম্যমূলক আচরণ করবে না। যে কোনও কারণেই একটা মানুষ অক্ষম হতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য নিজেকে সেই ভাবে পরিবর্তিত করা, যাতে সেই মানুষটি তাঁর সকল প্রকার স্বাচ্ছন্দ্য, মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত না হন।

এই যদি আইন হয়, তবে মায়ের কাছ থেকে সন্তানকে সরকার ছিনিয়ে নিতে পারে কি? ঝামেলা এড়ানোর তাগিদ থেকে মেয়েদের নিজের দেহের উপর, নিজের সন্তানের ওপর অধিকারকে রাষ্ট্র কী করে অস্বীকার করতে পারে? আর, কেউ মনোরোগী হতেই পারেন। কিন্তু সেটা কাটিয়ে যে তিনি কোনও দিনও বেরোতে পারবে না, এমন তো নয়? আর মানসিক রোগী হওয়াটা তাঁর একমাত্র পরিচয়ই বা হবে কেন? তাঁর অন্য আরও পরিচয় আছে। শুধুমাত্র মানসিক রোগের ওপর ভিত্তি করে কেন তাঁর জীবনের সিদ্ধান্ত অন্যরা নিয়ে নেবেন?

দেশের আইন বা আন্তর্জাতিক সনদের দিকে তাকানোর পাশাপাশি মল্লিকার ঘটনাটা দেখলে পরিষ্কার বোঝা যায়, ওঁর প্রতি যে আচরণ করা হয়েছে তা নির্মম, অমানবিক। মল্লিকার ঘটনায় রাষ্ট্রের অদক্ষতাই প্রকাশ পায় মাত্র। রাষ্ট্র পারেনি মানসিক অসুস্থ মানুষটির স্বাচ্ছন্দ্য, মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষা করতে। রাষ্ট্রের না পারার মাসুল গুনছেন মা ও শিশু।

সন্তানকে কেড়ে না নিয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন কোনও মহিলা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হলে তাঁর বিশেষ দেখভালও নিশ্চিত করা দরকার। মা ও শিশু যাতে মানসিক হাসপাতালে একসঙ্গে থাকতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। সমাজকে বিশ্বাস করতে হবে, ওঁরাও মাতৃত্ব পালনে সক্ষম। সর্বোপরি এমন পরিববেশ তৈরি করা দরকার, যাতে তাঁরা বিষয়টি অনুধাবন করে নিজেদের মতামত জানাতে পারেন। রাষ্ট্রের দায়িত্ব, হাসপাতালের দায়িত্ব, ও নারী অধিকার নিয়ে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের দায়িত্ব, এবং আপামর জনসাধারণের দায়িত্ব এই ধরনের মহিলাদের সাহায্য করা। যাতে তাঁরা এই বিষয়ে নিজেদের মত প্রকাশ করতে পারেন। আর কোনও মুনিয়া বা মল্লিকার কোল থেকে যেন তাঁদের সন্তানকে কেড়ে নেওয়া না হয়।

অন্য বিষয়গুলি:

post editorial ratnabali roy mental patient
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE