ছত্তীসগঢ়ে বন্ধ্যাকরণ শিবিরের মারণযজ্ঞের পর প্রথম যে প্রশ্নটা মাথায় আসে, তা হল, যত জন মহিলা শিবিরে গিয়েছিলেন, তাঁদের সকলের থেকে কি যথাযথ সম্মতি নেওয়া হয়েছিল? তাঁরা সবাই টিউবেকটমির ফলাফল স্পষ্ট জানতেন কি? জানতেন, যে তাঁরা আর কখনও মা হতে পারবেন না?
সাক্ষ্য বলছে, অনেকেই জানতেন না। যেমন এক জন এসেছিলেন জ্বরের চিকিত্সার আশায়। এই মেয়েদের সবাই নিম্নবর্গের দরিদ্র মেয়ে, দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী, বিপিএল কার্ড রয়েছে। গৌরেলার শিবিরে আদিম জনগোষ্ঠী বলে চিহ্নিত বাইগা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর চার জন মেয়েকে বন্ধ্যাকরণ করা হয়, যাঁদের জনসংখ্যা ক্রমহ্রাসমান বলে ১৯৭৯ সালে বন্ধ্যাকরণ নিষিদ্ধ করে সরকারি নির্দেশ রয়েছে। তাঁদের মধ্যে চৈতি বাই মারা গেছেন। তাঁর স্বামী বলেছেন, মৃত্যুর পর চৈতির হাতের আঙুল দিয়ে সম্মতির কাগজে টিপছাপ দেওয়ানো হয়। চৈতি সাক্ষর ছিলেন, তাঁর টিপছাপ দেওয়ার প্রয়োজন পড়ত না।
মেয়েরা যে গর্ভধারণের যন্ত্র নয়, কখন মা হবেন, ক’টি সন্তানের মা হবেন, আদৌ হবেন কি না, এ সব মেয়েরাই নির্ধারণ করবেন— মন্ত্রীরা সম্মেলনে-সম্মেলনে এমন সব চমত্কার কথা বলে বেড়ান। ২০১২ সালে লন্ডনের পরিবার পরিকল্পনা সম্মেলন কেন্দ্রীয় সরকার বলে এসেছিল, স্বাস্থ্য প্রকল্প থেকে বন্ধ্যাকরণের ‘লক্ষ্যমাত্রা’ উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে অতঃপর মেয়েদের সচেতন সম্মতিতেই সরকার গুরুত্ব দেবে। কথাগুলো এখন গেল কোথায়?
ছত্তীসগঢ়ে এই মেয়েদের সবাই নিম্নবর্গের দরিদ্র মেয়ে। তাঁদের অনেকের কাছে বন্ধ্যাকরণ করিয়ে পাওয়া ছশো থেকে চোদ্দোশো টাকাটুকুও খুব প্রয়োজনীয়। পরিবারের কাজে না এলেও স্বামীদের মদ খাওয়ার টাকা তো জুটবে। তাই স্বামীরাও অনেক সময় বাধ্য করেন বন্ধ্যাকরণ করিয়ে আসতে, হাতে হাতে পাওয়া যাবে নগদ টাকা। অস্ত্রোপচার ঠিক ভাবে হলে তার পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে খুব বেশি সময় লাগে না। অস্ত্রোপচার যাতে ঠিক ভাবে হয়, তার জন্য সুপ্রিম কোর্ট কয়েকটি নির্দেশও দিয়েছে। বলা হয়েছে, এক জন শল্যচিকিত্সক দিনে একটি ল্যাপারোস্কোপে দশটির বেশি বন্ধ্যাকরণ করতে পারবেন না, পুরো দল মিলে ত্রিশটির বেশি নয়। ছত্তীসগঢ়ের ডাক্তারবাবু চার-পাঁচ ঘণ্টায় ৮৩টি অপারেশন করেছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের তোয়াক্কা না করেই। চিকিত্সকরা বলছেন এটাই দস্তুর। তাঁদের ওপর সরকারি লক্ষ্যমাত্রা পূরণের চাপ থাকে। যাঁর হাতে এই দিন মারা গেলেন তেরো জন, তিনি এক দিনে তিনশোটি বন্ধ্যাকরণও করেছেন। এ বছর ২৬ জানুয়ারি পুরস্কৃত হয়েছেন এক লক্ষ বন্ধ্যাকরণের ‘কৃতিত্ব’-এর জন্য।
একটি পরিত্যক্ত হাসপাতালে নোংরা ধুলোমাখা মাটিতে তোশকের উপর রেখে শল্যচিকিত্সা করে ছেড়ে দেওয়া কোনও স্বাস্থ্যবিধিতে লেখা নেই। তবু হয়, কারণ গরিব মানুষকে যা দেওয়া হবে, সেটাই তার চোদ্দোপুরুষের ভাগ্যি— এ ভাবেই আমরা ভাবতে শিখেছি। তাঁদের আবার সম্মতি কী? আপনি-আজ্ঞে কেন? মেয়ে হলে তো আরও বলা— তাদের কিছু বোঝাতে যাওয়াই দায়! তাই তাঁরা মারা যাবেন, অন্ধ হবেন, প্রতিবন্ধী হয়ে ফিরবেন বন্ধ্যাকরণ শিবির থেকে, ছানি কাটানোর শিবির থেকে।
মেয়েরা যে সব সন্তান স্বেচ্ছায় ধারণ করেন না, বরং যথাসময়ে ঠিক পরামর্শ ও গর্ভনিরোধক সাহায্য পান না বলে, অথবা পরিবারে পুত্রসন্তানে অদম্য বাসনায় তাঁরা ইচ্ছের থেকে বেশি সন্তান ধারণ করতে বাধ্য হন— এই কথাটি গত দুই দশকে তাত্ত্বিকরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন। তথ্যও সে কথাই বলছে। তা ছাড়া, গরিব মানুষদের মধ্যে অনেক সময়েই কোনও বিপদের মুখোমুখি দাঁড়ানোর মতো পর্যাপ্ত উপকরণ থাকে না, নিজেদের সন্তান ছাড়া। তাই সরকার সক্রিয় হলে, তার কল্যাণপ্রকল্প দরিদ্র মানুষের কাছে পৌঁছলে সন্তানসংখ্যা কমে, যেমন কমে জীবনযাপনের ধরন বদলালে, সন্তানদের বড় করতে বেশি করে অর্থের সংস্থানের প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ালে। সমীক্ষায় অবশ্য দেখা গিয়েছে, ভারতেও কোনও কোনও ক্ষেত্রে ধর্মীয় হস্তক্ষেপের জন্য শিক্ষার উন্নতি সত্ত্বেও মেয়েরা জন্মনিয়ন্ত্রণ করার অধিকার পান না।
তবু এখনও গরিব পরিবারকে লক্ষ্য বানিয়ে সরকারের বন্ধ্যাকরণের প্রকল্প অব্যাহত, বিশেষত ২০২০ সালের মধ্যে ন’টি ‘হাইফোকাস’ রাজ্যে জনসংখ্যা ‘নিয়ন্ত্রণে’ আনার পরোক্ষ প্রকল্প চলছেই। লন্ডন সম্মেলনে সরকার বলেছে, কোনও লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হচ্ছে না, কিন্তু ২০২০ সালের মধ্যে চার কোটি আশি লক্ষ সন্তানধারণক্ষম মেয়ের কাছে গর্ভনিরোধক পৌঁছে দেওয়া হবে। সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যিনি যেমন চাইবেন, তাঁর জন্য তেমন গর্ভনিরোধকেরই ব্যবস্থা হবে। বড়ি বা ‘কপার টি’-র মতো সাময়িক ব্যবস্থাও যেমন পাওয়া যাবে, তেমনই বন্ধ্যাকরণের মতো পাকাপাকি ব্যবস্থাও। বাস্তব কিন্তু অন্য রকম। সাময়িক ব্যবস্থাগুলোর দেখা মেলে না, তাই এ দেশের ৩৭ শতাংশ মেয়ে বন্ধ্যাকরণকেই বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। সরকারি হাসপাতালে গর্ভপাত করাতে গেলে বহু বাধা। আর যদি বা ব্যবস্থা হয়, তা হলে সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ্যাকরণও করিয়ে দেওয়া হয়। মেয়েটির টিপছাপ থাকে ঠিকই, কিন্তু সে মেয়ে বুঝতেই পারে না যে সে আর কখনও মা হতে পারবে না। তারিখ পেরিয়ে যাওয়া গর্ভনিরোধক অনেক সময় কাজ করে না। সব স্তরে চূড়ান্ত অসংবেদনশীল আচরণও মেয়েদের বাধ্য করে বার বার সাময়িক গর্ভনিরোধকের জন্য না এসে একেবারে ‘আপদ চুকিয়ে’ ফেলতে।
কেন্দ্রীয় সরকারের বন্ধ্যাকরণ করালে যেমন মেয়েরা টাকা পান, তেমনই পান শল্যচিকিত্সক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরাও। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে মেয়েদের শিবিরে আনার জন্য। অতএব, বন্ধ্যাকরণে অনেকেরই বাড়তি আগ্রহ থাকে। যে ন’টি রাজ্যে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের সরকারি চেষ্টা চলছে, সেখানে স্বাস্থ্যকর্মীদের স্কুটার, সোনার জিনিস, এমনকী ন্যানো গাড়ি পর্যন্ত উত্সাহ দেওয়ার জন্য পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এই স্বাস্থ্যকর্মীরা (এবং দালালরা) অবিবাহিতা, এমনকি মানসিক প্রতিবন্ধীদের পর্যন্ত বন্ধ্যাকরণ করিয়েছেন, সেই সাক্ষ্যও রয়েছে। বিশেষ রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যবিমা যোজনার ফলে এখন কিছু দালালের আরও বাড়াবাড়ি। ছত্তীসগঢ়েই ২০১২ সালে বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে যোগসাজসে সাত হাজার মেয়ের জরায়ু বাদ দেওয়ার অস্ত্রোপচার করা হয়। সেটাও আর এক রকম বন্ধ্যাকরণ।
গরিব মেয়েদের শুধু পরিসংখ্যান হিসেবে না দেখে মানুষ হিসেবে দেখতে পারে আমাদের সরকার? উত্সাহ-ভাতা পুনর্বিবেচনা করবে? এই মেয়েদের সম্মতি তো শুধু ভোটের বোতাম টেপার জন্য নয়। তাঁদের জীবনগুলো কোন খাতে বইবে, সেই প্রশ্নটাও যে তাঁদের সম্মতির অপেক্ষা রাখে, ভেবে দেখলে হয় না? পুরুষদের বন্ধ্যাকরণ মেয়েদের তুলনায় অনেক সহজ, নিরাপদ। কিন্তু জরুরি অবস্থার ভূত এই কথাটা আর তুলতে দেয়নি, ফলে তা প্রচারেও আসেনি। এ বার সে দিকে তাকালে হয় না?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy