কার যুদ্ধ? ব্রিটিশ ভারতের সেনা, ফ্রান্সের মাটিতে, জার্মানির সঙ্গে লড়াইয়ে। অক্টোবর, ১৯১৪। ছবি: গেটি ইমেজেস।
এক জন সাহিত্যিক, আর এক জন গণিতজ্ঞ। ভার্জিনিয়া উলফ্ আর বার্ট্রান্ড রাসেলের বন্ধুত্ব গভীর। হঠাত্ই ভার্জিনিয়া লক্ষ করলেন, বার্ট্রান্ড উল্টেপাল্টে একটা আলাদা মানুষ হয়ে গেলেন ক’বছরের মধ্যে। বিস্ময়াহত ভার্জিনিয়া ডায়রিতে সে কথা লিখেও রাখলেন। বার্ট্রান্ডও নোট করলেন, বড্ড ব্যঙ্গবঙ্কিম অন্ধকারময় মানুষ হয়ে যাচ্ছেন তিনি। লিখলেন, ফাউস্ট যেমন মেফিস্টোফিলিস-এর সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে আর পরে সম্পূর্ণ দুটো আলাদা লোক হয়ে গিয়েছিল, তাঁর ক্ষেত্রেও তেমন হল, হল কেবল একটিমাত্র যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে। যে যুদ্ধ দেখলেন, তাতে আর ‘শুভ’য় বিশ্বাস রাখবেন না তিনি। জানবেন, মানুষমাত্রেই প্রথমত ও প্রধানত নিষ্ঠুর। ধ্বংস ও হিংসা তার অস্তিত্বের তারে তারে বাঁধা। ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ পাল্টে দিল মানুষটাকে।
যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই। এত বড়, এত ভয়ানক, এত লম্বা একটা যুদ্ধ আগে দেখেনি মানবসভ্যতা। আজকের চেনাশোনা পৃথিবীটি অনেক অর্থেই ওই যুদ্ধের নির্মাণ। সে সময় এই যুদ্ধটা না ঘটলে ইতিহাসের ধারা অনেকটাই ভিন্ন খাতে বইত। রাসেলের ভবিষ্যদ্বাণী: অস্ত্রের বদলে অস্ত্র দিয়ে সমস্যা সমাধান না করে মানুষ সমস্যা সৃষ্টিতেই পারদর্শী হয়ে উঠবে। রবীন্দ্রনাথ বললেন, জাতীয়তাবাদ নামক বন্দিত আদর্শটির মধ্যেই যে গভীর অসুখ, সেটাকে উপড়ে না ফেললে দুনিয়া অ-বাসযোগ্য হয়ে যাবে। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বা এরিক মারিয়া রেমার্ক-এর মতো মার্কিন বা জার্মান ঔপন্যাসিক, বা তরুণ ব্রিটিশ কবি আইজ্যাক রোজেনবার্গ (যিনি যুদ্ধক্ষেত্রেই মারা যান) সাহিত্যে দিয়ে গেলেন যুদ্ধদুনিয়ার ভয়ানক সব ছবি। তাঁরা নিশ্চয় জানতেন, ‘আ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’ কিংবা ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’-এর মতো বাক্যবন্ধ পরের শতাব্দীর সবসেরা প্রহসন হয়ে উঠবে?
কেন এই যুদ্ধ এত আলাদা? এত যুগের রক্তাক্ত ইতিহাস পেরিয়ে বিশ শতকে পৌঁছেও কেন এটাকেই ‘প্রথম’ বলি আমরা? এর আগে ‘বিশ্ব’ কথাটা যুক্ত হয়েছে বলেই তো? কিন্তু কেন-ই বা ‘যুদ্ধ’ শব্দের আগে ‘বিশ্ব’ যোগ? অনেক দেশ একসঙ্গে লড়াইয়ে নেমেছে বলে?
সেটা একটা বড় কারণ নিশ্চয়। তবে কি না, আমরা সাধারণত ভাবি ‘অনেক’ দেশ মানে শুধু এক দিকে জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গারি, অন্য দিকে ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ভাবি না, পুরো ছবির একটুখানি মাত্র এটা। যতই ‘ইউরোপিয়ান ওয়ার’ বলে চালানোর চেষ্টা হোক, এটা মোটেই শুধু পশ্চিমি দেশগুলোর কাহিনি নয়। ‘ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ ঘিরে পরতে পরতে জড়িয়ে পড়েছিল তিন-তিনটে মহাদেশের বহু লক্ষ মানুষ, ইতিহাসে প্রথম বার। এর আগে কখনও একই যুদ্ধে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকায় কামানগর্জন শোনা যায়নি। একই যুদ্ধে আল্প্সের তুষারভূমি আর ইরাক-আরবের তপ্ত মরুবালুকায় লুটিয়ে পড়েনি নানা দেশের নানা ভাষার নানা ধর্মের লোক, যারা জানেও না, ঠিক কেন, কী জন্য তারা মরছে। ‘অনেক’ দেশের তালিকাটা আসলে বিরাট লম্বা। সেখানে থাকবে ভারত, যার ১৪ লক্ষ মানুষ এ যুদ্ধের শরিক। আয়ার্ল্যান্ড: যাকে কয়েক লক্ষ স্বেচ্ছাসেবক পাঠাতে হয়েছিল। নিউজিল্যান্ড: যে দেশের প্রতি পাঁচ জনের এক জন ট্রেঞ্চে গিয়েছিল। কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া: যাদের প্রতি সাত জনের এক জন সৈনিক হয়েছিল। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বহু দেশ, যারা বিপুল সংখ্যক যুদ্ধকর্মী পাঠিয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার এক লক্ষ ছত্রিশ হাজার, পশ্চিম আফ্রিকার এক লক্ষ সত্তর হাজার, আর উত্তর আফ্রিকার তিন লক্ষ কালো মানুষ, যারা ব্রিটেন ও ফ্রান্সের যুদ্ধ নিজেদের দেশের যুদ্ধ বলে মানতে বাধ্য হয়েছিল। উপনিবেশ হলেই-বা! এদের ‘উপযোগিতা’ এই বিশ্বময় যুদ্ধেই প্রতিষ্ঠা পেল, প্রথম বার।
‘অন্যান্য’ দেশগুলোর আরও এক ভূমিকা ছিল। যুদ্ধের বাস্তব তো কেবল রণাঙ্গন নিয়ে তৈরি হয় না, বাইরের বিস্তীর্ণ সমাজেও তার কোপ পড়তে থাকে। এত পুরুষ ঘরের বাইরে, দেশের বাইরে, তাদের কাজগুলো করবে কে? চাষবাস হোক, পশুপালন হোক, কলকারখানা হোক, চালাতে তো হবে। অনেক অতিরিক্ত উত্পাদনও লাগবে, নয়তো এত বড় সেনাবাহিনীর হ্যাপা সামলানো যাবে না! সুতরাং লোক চাই। কে দেবে লোক? দেবে উপনিবেশ। দিস্তে দিস্তে পোস্টার ছাপা হল: দ্য এম্পায়ার নিড্স মেন!
শুরু করল ফ্রান্স। আফ্রিকা আর ইন্দো-চিনের কলোনি থেকে কয়েক লক্ষ মানুষকে জাহাজে করে তুলে এনে কাজে ঢুকিয়ে দিল। কত রকম কাজ: অস্ত্র-কারখানা থেকে শুরু করে আঙুরের খেত, সর্বত্র। দেখাদেখি এগিয়ে এল ব্রিটেন, আমেরিকা, জার্মানি। শুধু চিন থেকেই ইউরোপে দেড় লক্ষ মানুষ এল কর্মী হতে। এই হল যুদ্ধের বিশ্বায়ন। প্রথম বার।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে চিন। আলজিরিয়া থেকে ফিজি। এরা কি আগে চিনত পরস্পরকে? নিশ্চয়ই না। চার বছরে তৈরি হল প্রথম ‘গ্লোবাল’ সমাজ। ব্রিটেনের কর্নওয়ালবাসী বা জার্মানির বাভারিয়াবাসী আগে চর্মচোখে বিদেশি দেখেইনি মোটে, এই প্রথম পঞ্জাবি-গুজরাতিদের উপর নির্ভরশীল হল তারা। জামাইকার কালো মানুষ আর তুরস্কের ধর্মভীরু মুসলিম হাত মিলিয়ে কাজ ধরল। বর্ণবিদ্বেষ কোথাও বাড়ল কোথাও বা কমল। মার্কিন বাহিনীতে দেখা গেল অধিকাংশই ‘নিগ্রো’ আর ‘রেড ইন্ডিয়ান’, যারা মরলে তেমন কিছু এসে যায় না! এ বৈষম্যের প্রতিবাদেই জোরদার হল নাগরিক অধিকারের লড়াই। যে নারীবাহিনী আজ ঘটনাচক্রে উত্পাদনক্ষম, তাই ‘মূল্যবান’, আমেরিকায় ব্রিটেনে তীব্র হল তাদের অধিকারের দাবি। কালান্তক যুদ্ধে লকলকিয়ে বেড়ে ওঠে হিংসার সংস্কৃতি, খুলে যায় নানা অধিকারের দরজাও!
এবং তৈরি হয় আক্রমণের নতুনতর যন্ত্রপাতি। যুদ্ধের গোড়ায় ইউরোপের দেশগুলো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল হাজার হাজার ঘোড়াকে ‘প্রস্তুত’ করতে, যুদ্ধের প্রধান দায়িত্ব তারা সামলাবে এটাই তখনও দস্তুর। পাঁচ বছরে পাল্টে গেল সংঘর্ষের কৃত্কৌশল। রাইফেল মেশিনগান ফিল্ডগান ট্যাঙ্ক এয়ারক্রাফট-এর কাছে ঘোড়ারা নেহাতই বেচারি হয়ে পড়ল। যুদ্ধ-‘বিশ্বায়ন’ও সহজতর হল। ইরাকে বা আলজিরিয়ায় যুদ্ধের ঘোড়া পৌঁছে দেওয়া যায় না, কিন্তু সৈন্যদের হাতে নিমেষে তুলে দেওয়া যায় মেশিনগান! এর আগে ব্রিটেনের কোনও যুদ্ধের জন্য আফ্রিকাবাসী গোলাবারুদ তৈরি করেনি। মার্কিন যুদ্ধের জন্য মেক্সিকো বা চিলির শস্তা শ্রমিকরা অস্ত্র বানায়নি। অস্ত্রশিল্পের বিশ্বায়ন খুলে দিল সামরিক প্রযুক্তির বিপ্লবের রাস্তা।
সবচেয়ে বড় বিশ্বায়নটা এল যুদ্ধ-ভাবনায়। পক্ষ-অপক্ষ নির্বিশেষে মহামানবতীরের সর্বত্র যে যুদ্ধ ছড়িয়ে দেওয়া যায়, যুদ্ধকে যে অনায়াসে নির্দিষ্ট ‘যুদ্ধক্ষেত্র’-এর বাইরে নিয়ে আসা যায়, বিমান-হানা নামক একটি ঘটনা দিয়ে নিশ্চিন্ত জনজীবনেও অবাধে মৃত্যুবর্ষণ চালানো যায়: জানা গেল এই প্রথম। বিশ্ব এ ভাবেই তার যুদ্ধ নির্মাণ করে নিল। ঐতিহাসিক নয়? কে না জানি, বিশ ও একুশ (হয়তো বাইশ বা তেইশও) শতক জুড়ে আমরা এই ভাবনা আঁকড়েই বাঁচছি, বাঁচব। ইজরায়েল থেকে ইউক্রেন, নিশ্চিন্ত প্রাত্যহিকতার মধ্যেই বিছিয়ে দিচ্ছি যুদ্ধের মারণ। মানুষের নিষ্ঠুরতা কত আন্তর্জাতিক, রাসেল তো তা দেখেছিলেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy