জয়ী। গাঁধীনগরে নরেন্দ্র মোদী। ১৬ মে, ২০১৪। ছবি: পিটিআই।
তাঁর ঘরে বসে তিনি যখন কোনও সাক্ষাত্কার দেন, তখন এক বাঙালি সন্ন্যাসীর মূর্তি টেলিভিশনের কল্যাণে আমরা সকলেই দেখতে পাই। শোনা যায়, সেই বাঙালি সন্ন্যাসীর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি নিতান্ত বালক বয়সে বেলুড় মঠে এসেছিলেন সন্ন্যাসী হতে। এই সন্ন্যাসী, স্বামী বিবেকানন্দ নিতান্ত তরুণ বয়সে পরিব্রাজক হয়ে এক ‘ভারত ভাবনা’ গড়ে তুলেছিলেন: দরিদ্র, মূর্খ, ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল, নানা জাতি-বর্ণ-ভাষার নানা মুখের এক উজ্জীবিত ঐক্যবদ্ধ ভারত ভাবনা।
আজ যখন সভা-সমিতি বা মিডিয়ায় নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদী ‘এক ভারত’ ও ‘শক্তিশালী ভারত’-এর কথা বলে তাঁর শ্রোতাকুলকে ক্রমাগত আপ্লুত করতে থাকেন, তখন তার মধ্যে বিবেকানন্দ অনুপ্রাণিত ভারত এবং সংঘ পরিবার অনুপ্রাণিত হিন্দুস্তান কতটা মিলেমিশে থাকে তার অনুপাত নির্ণয় করা কঠিন, কিন্তু ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে এ কথা স্পষ্ট হয়ে গেল যে নানা ভাষা, নানা মতের বিচিত্র ও বিশাল এই দেশকে তিনি অন্তত কিছু দিনের জন্য হলেও একসূত্রে বেঁধে দিতে পেরেছেন তাঁর মুখ এবং মুখোশের অতিপ্রত্যয়ী অভিব্যক্তিতে। ব্রিটিশ সংবিধান ও কলোনীয় শাসন থেকে পাওয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ-সমর্থন-নির্ভর আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্রের ভিত্তি প্রায় টলমল করিয়ে এ বার তিনি যে বিপুল জনসমর্থনে ক্ষমতায় আসীন হলেন, তার ধাঁচ অনেকখানিই মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সমতুল। নতুবা, এমন এক ক্যাডার-ভিত্তিক দল, তার পোড়খাওয়া প্রাজ্ঞ নেতৃবর্গকে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক করে কেন তাঁর মুখোশে ঢেকে দেবে আসমুদ্রহিমাচল! অথবা, স্থলে-জলে-অন্তরীক্ষে সর্বব্যাপী প্রচারে কেনই বা বিজেপি বা এনডিএ-র সরকার না বলে স্লোগান ওঠে, ‘অব কি বার, মোদী সরকার’?
তাই ২০১৪-র লোকসভা ভোট ভারতীয় রাজনীতির এক জলবিভাজিকা হয়ে দাঁড়াল, যেখানে দলের চেয়েও, সংসদীয় ব্যবস্থার চেয়েও বড় হয়ে উঠেছেন নেতা এবং তাঁর মুখ। আসলে কংগ্রেস হেরেছে এই মুখটার কাছেই, ওই মুখের চেয়েও প্রতিস্পর্ধী কোনও মুখ তুলে ধরতে পারল না বলেই। এমন মুখ কংগ্রেস শেষ দেখেছে ইন্দিরা গাঁধীর মধ্যে, যিনি ষাটের দশকে কংগ্রেস সিন্ডিকেট-এর বর্ষীয়ান বিরোধী নেতাদের নস্যাত্ করে মধ্যমঞ্চ দখল করেছিলেন, ক্রমে দেবকান্ত বরুয়ার মতো অসংখ্য কংগ্রেসিদের চোখে হয়ে উঠেছিলেন, ‘ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া’। কিন্তু ইন্দিরা গাঁধীর ছিল পারিবারিক নেতৃত্বের বিপুল উত্তরাধিকার। সঙ্গে ছিল তখনও সর্বশক্তিমান কংগ্রেস-এর ভারতময় সংগঠন। এর বিপরীতে নরেন্দ্র মোদীর তহবিলে আছে সর্বশক্তিময় এক সংগঠনের অনুগত সেনানী থাকার কাহিনি এবং টম-ডিক-হ্যারির চেয়েও নগণ্য পারিবারিক ঐতিহ্য। তাই, সাধারণ ‘চা বিক্রেতা’ বালক বা স্বল্প-পরিচিত আরএসএস-এর প্রচারকের পরিচয় পেরিয়ে মোদী যেখানে পৌঁছলেন, তাতে স্বচ্ছন্দে বলা চলে, তাঁর ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তার গ্রাফ প্রায় নব্বই ডিগ্রি আবর্তন করেছে।
এই বিপুল জনসমর্থনের পিছনে অবশ্যই মিডিয়া ও কর্পোরেট দুনিয়ার অবদান আছে। কিন্তু তার চেয়ে বড় অবদান কংগ্রেস পরিচালিত ইউপিএ-২ সরকারের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি ও মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা। এখানে বলা দরকার, সাধারণ মানুষ দুর্নীতির চেয়েও চিন্তিত ছিল মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে। নিত্যপ্রয়োজনীয় নানান সামগ্রী থেকে রান্নার গ্যাস বা পেট্রোপণ্যের দাম ক্রমাগত বেড়ে চলায় ভারতের আমজনতা প্রতিদিন বিপর্যস্ত হয়েছে। তখন আবার এর পাশাপাশি, কিছুটা এর কারণ হিসেবেও, ‘দুর্নীতি’ জনমনে সামনের সারিতে চলে এসেছে। এই সব কিছুই খানিকটা সহনীয় হয়ে উঠতে পারত সরকারের নীতিনির্ধারকদের সুদৃঢ়, কর্মতত্পর প্রত্যয় থাকলে এবং দলের মধ্যে জনপ্রিয় স্পষ্টদ্রষ্টা নেতৃত্বের উপস্থিতি দেখা গেলে। ইউপিএ-২ সরকার ও কংগ্রেস দল এই দুইয়ের মধ্যে দেখা গেছে এর যথেষ্ট অভাব, অনেক ক্ষেত্রে প্রায় শূন্যতা।
এক দিকে সনিয়া গাঁধীর নেতৃত্বে চলা জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদের (এনএসি) জনঅধিকারমুখী নানা প্রকল্পের রূপায়ণ এবং অন্য দিকে মনমোহন সিংহ পরিচালিত উদার অর্থনীতিতে বিশ্বাসী সরকার এই দুইয়ের অনুপানে ইউপিএ-২ সরকার হয়ে উঠেছিল এক সোনার পাথরবাটি। এনএসি বা প্রধানমন্ত্রী, সরকারি নীতি কার কথায় চলবে, এই দ্বন্দ্বে সরকার এবং দল, দুইই ক্রমশ দীর্ণ হয়েছে, দুটি চিন্তাধারার সংঘাত ও ফারাক বেড়েছে এবং সরকারে বাসা বেঁধেছে এক না-সারা অসুখ: নীতি নির্ধারণে এবং রূপায়ণে পক্ষাঘাত। এক দিকে সরকার এবং অন্য দিকে ইউপিএ-র সভাপতি, ক্ষমতার এই দুটি মুখের আসলটি কে, তা জনগণ এবং কংগ্রেস উভয়েই বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দলের নেতৃত্বের সমস্যা। দলের নেতা যে মনমোহন সিংহ নয়, সবাই জানতেন। কিন্তু সনিয়া বা রাহুল এঁদের মধ্যে কে সর্বোচ্চ নেতা, সে বিষয়ে কি কংগ্রেসিরাও নিশ্চিত ছিলেন? তাই, ‘প্রধানমন্ত্রিত্বের পদপ্রার্থীর ঘোষণা কংগ্রেস আগেভাগে করে না’ এমন দাবি করার পরেও যখন শেষ পর্যন্ত রাহুলকেই মোদীর বিপ্রতীপে স্থাপন করা হল, তখন কি ইতিমধ্যেই বড় দেরি হয়ে যায়নি?
আবার যে সব জনমুখী কার্যক্রমের কথা (যেমন সর্বজনীন শিক্ষা, তথ্য, খাদ্যের অধিকার তথা গ্রামীণ রোজগার যোজনা প্রভৃতি) কংগ্রেসের নেতারা বড়মুখ করে টিভিতে বলতে ভালবাসেন, তার কথা রাজনৈতিক ভাবে তাঁরা সেই সব অগণিত প্রান্তিক মানুষের কাছে কতটা নিয়ে যেতে পেরেছেন, যাঁরা এই সব প্রকল্পে সরাসরি উপকৃত? কংগ্রেস এক দিকে মূল্যবৃদ্ধি রুখতে পারেনি, অন্য দিকে জনমুখী রাজনীতির সফল বিপণন করে প্রাপ্য ফসল ঘরে তুলতে পারেনি। ফলে, অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন জনমুখী প্রকল্পের সুবিধাভোগী মানুষজনও বুঝতে পারেননি যে, কংগ্রেস সরকারই এই সব প্রকল্পের রূপকার। খেয়াল করবেন, সচরাচর স্থানীয় সরকারের দ্বারাই এই সব সুবিধা বিতরিত হয় এবং বহু রাজ্যেই সেই সরকার কংগ্রেসের নয়, বেশ কয়েকটি রাজ্যে বিজেপি’র, ফলে বিপণনের ব্যর্থতা কংগ্রেসের পক্ষে বিশেষ ভাবে ক্ষতিকর হয়েছে। অন্য দিকে মূল্যবৃদ্ধি যে কেন্দ্রীয় সরকারের কারণেই, বিরোধীদের এই প্রচার মানুষ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছেন। ফলে, এই সব মানুষ দলে দলে মোদীর পক্ষে ভোট দিয়েছেন।
জনসাধারণের উলটো পিঠে যে শিল্প ও কর্পোরেটমণ্ডলী, তাঁরাও সরকার ও শাসক দলের সিদ্ধান্তহীনতা ও (এবং তাদের মতে) মুক্তকচ্ছ জনমনোরঞ্জনী নীতিগুলি মেনে নিতে পারেননি। বাণিজ্যের ‘বৃদ্ধি’কেই (গ্রোথ) ‘বিকাশ’ বা উন্নয়ন ভাবা এই প্রভাবশালী শ্রেণির মানুষের কাছেও ইউপিএ-২ সরকার অতি দ্রুত জনপ্রিয়তা হারাচ্ছিল। ফলত, তাঁরা ছিলেন এক শক্তপোক্ত দ্বিধাহীন মুখের সন্ধানে, যে প্রয়োজনে অপ্রীতিকর সিদ্ধান্ত নিতেও পিছপা হবে না। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে, তাঁর কৃতসিদ্ধান্ত পদক্ষেপের মধ্যে এবং সর্বোপরি রাজনীতির সর্বোচ্চ পদে পৌঁছতে তাঁর সীমাহীন উচ্চাশী পরিশ্রমের মধ্যে ভারতের ক্রমশ হতাশ হতে থাকা বাণিজ্যমণ্ডলীর মানুষেরা তার সন্ধান পেলেন এবং নানা ভাবে, বিশেষত প্রচারমাধ্যমে তাঁরা মোদীর ভাবমূর্তিকেই দেশের ‘একমাত্র’ পছন্দ হিসেবে সামনে তুলে ধরতে চাইলেন।
আবারও বলা দরকার, এই বিপুল সংখ্যাধিক্য মোদী কেবল কর্পোরেটদের কাছ থেকেই পাননি, পেয়েছেন এক বিপুল সংখ্যক সাধারণ, মধ্যবিত্ত, প্রান্তিক মানুষের, এমনকী কিছু সংখ্যালঘুর, কাছ থেকেও। ভারতের এক নম্বর বিপণন-পুরুষ নরেন্দ্র মোদী এদের সকলের কাছেই ফিরি করেছেন নানা রঙের হরেক কিসিমের স্বপ্ন। এদের অনেকেরই ধারণা, মোদীর কাছে আছে এক জাদুদণ্ড, যা দিয়ে নিমেষে পূরণ হবে সকল আশা।
স্বপ্নপূরণের বিপুল প্রত্যাশাই হয়তো মোদীর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কী করে তিনি শেষ অবধি সব কিছু মেলান, কী করে ২০০২-এর গোধরা-পরবর্তী দাঙ্গার স্মৃতিকে তিনি ফিকে করে দেন, কী করেই বা আরএসএস-এর প্রবল নিয়ন্ত্রণকামী সংগঠন ও কেন্দ্রীয় বিজেপির কলহপরায়ণ নেতৃত্বকে তিনি ‘জাগ্ল’ করে যান, এ সবের দিকেই ইন্ডিয়া ও ভারত উভয়েই তাকিয়ে থাকবে। তবে আজকের দিনে যে ‘অ্যাডভান্টেজ মোদী’, সে কথা মেনে নেওয়া ছাড়া তাঁর প্রবল বিরোধীদেরও গতি কী?
শ্রীচৈতন্য কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy