Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪
প্রবন্ধ ২

বাতিওয়ালার নিজের ঘরে আলো জ্বলবে?

গরিব মানুষের জীবনে ক্ষত সারাতে কাজ করেন স্বেচ্ছাসেবী বা অসরকারি সংস্থার কর্মীরা। মানুষের প্রয়োজনে রাস্তায় নেমে সামাজিক আন্দোলনও করেন। অথচ তাঁরা নিজেরা ন্যূনতম প্রাপ্যও পান না। সুকান্ত সরকার।সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতায় বাতিওয়ালা সন্ধেবেলায় রাস্তায় রাস্তায় আলো জ্বালাত, অথচ তার নিজের ঘরেই আলো জ্বালানোর সামর্থ্য ছিল না। গরিব মানুষের জীবনে ক্ষত সারাতে কাজ করেন যাঁরা, তাঁদের অবস্থাও বাতিওয়ালারই মতো। ওঁরা বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী বা অসরকারি সংস্থার কর্মী।

শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতায় বাতিওয়ালা সন্ধেবেলায় রাস্তায় রাস্তায় আলো জ্বালাত, অথচ তার নিজের ঘরেই আলো জ্বালানোর সামর্থ্য ছিল না। গরিব মানুষের জীবনে ক্ষত সারাতে কাজ করেন যাঁরা, তাঁদের অবস্থাও বাতিওয়ালারই মতো। ওঁরা বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী বা অসরকারি সংস্থার কর্মী। প্রয়োজনে রাস্তায় নেমে সামাজিক আন্দোলনও করেন। সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম থেকে শুরু করে নানা জমি আন্দোলনেও ছিলেন অনেকেই। অথচ কর্মস্থলে তাঁরা অবহেলিত, বঞ্চিত। অধিকাংশ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীরা ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত। এ বার তাঁরা নিজেদের অধিকারের জন্য রাস্তায় নেমে আন্দোলন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ওঁদের সমস্যার ব্যাপারে রাজ্য শ্রম দফতরও মাথা ঘামাতে শুরু করেছে।

এক তরু, বয়স বছর ত্রিশেক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃতত্ত্বে এমএ পাস করে শহরের একটি বড় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় কাজ করেন। মাস গেলে পাঁচ হাজার টাকা পান। সাপ্তাহিক ছুটি থাকলেও ক্যাজুয়াল লিভ, আর্নড লিভ, এমনকী ঘোষিত কোনও মেডিক্যাল লিভ নেই তন্ময়দের। ইএসআই, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি তো দূরের কথা। সব মিলিয়ে ওই সংস্থায় কাজ করেন সাতাশ জন, সকলেরই এক অবস্থা। বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়িত করাই ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রধান কাজ। বেশ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার একাধিক কর্মী জানিয়েছেন, তাঁরা যা মাইনে পান তা থেকে অনেক বেশি অঙ্কের টাকার ভাউচারে সই করিয়ে নেওয়া হয়। তাঁদেরই এক জন, এক তরুণী, বলেন, “কী করব? উপায় নেই। চাকরির বাজারের যা অবস্থা, সব অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করছি।”

একটি বড় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার এক কর্মীর অভিযোগ, “বেশির ভাগ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ব্যবসা করছে। দারিদ্র দেখিয়ে ব্যবসা। কর্মীদের যত্‌সামান্য পয়সা দেয়। সুযোগসুবিধের বালাই নেই। মাইনে বেশি চাইলে বা ছুটি চাইলে কর্তৃপক্ষ বলে, তোমরা তো সেবামূলক কাজ করছ।”

অনেক সময় ‘ডোনার’ এজেন্সি কর্মীদের চেক-এ মাইনে দিতে বললে সংস্থার কর্তৃপক্ষ বাড়তি টাকা কর্মীদের কাছ থেকে আগে নিয়ে নেয়, তার পর চেক ইস্যু করে, এমন অভিযোগও শোনা গেল। সব আমলেই শাসক দলের সঙ্গে ওই সব স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি সুসম্পর্ক রেখে চলে। এখন রাজনৈতিক দলের অনেক নেতারও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা রয়েছে। নির্বাচনী বিধি এড়িয়ে সেই সংস্থাগুলিকে নির্বাচনের সময় দল ব্যবহার করে।

রাজ্যে প্রায় ১৪ হাজার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় কাজ করেন লক্ষাধিক মানুষ। বেশির ভাগই মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে এখন ‘ডেভেলপমেন্ট সেক্টর’ বলার চল শুরু হয়েছে। এমনই এক জনের সঙ্গে আলাপ হল। ১৯৯৫ সাল থেকে পথ-শিশুদের লেখাপড়া শেখায় এমন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় কাজ শুরু করেন। মাস গেলে পেতেন সাড়ে তিনশো টাকা। ২০০১ সালে তিনি অন্য একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় কাজে যোগ দেন। সেখানে মাইনে পেতেন এক হাজার টাকা। ২০১২ সালে তাঁর মাইনে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার। তিনি বলেন, “গরিব মানুষের উন্নয়নের জন্য প্রকল্প দেখিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা আনেন কর্তৃপক্ষ, কিন্তু কর্মীদের ন্যূনতম অধিকারও নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন না। অথচ তাঁদের জীবনযাপনের ধরন দেখে অবাক হতে হয়।”

কর্মীদের মাইনে দেওয়ার ক্ষেত্রে কেন ন্যূনতম মজুরি মানা হয় না? একটি স্বেছাসেবী সংস্থার কতৃর্পক্ষের তরফে যুক্তি শোনা গেল, “আমাদের কর্মীরা মাইনে নিয়ে মাথা ঘামান না। আমরা যে টাকা পাই তার বেশির ভাগটাই গরিব মানুষের জন্য খরচ করি। কাজের ব্যাপারে আমাদের এখানে কর্তৃপক্ষ বা কর্মী বলে আলাদা করে চিন্তা করি না। কাজটাই আমাদের সকলের কাছে প্রাধান্য পায়।” আর এক জনের কথা জানা গেল, যিনি তাঁর পরিচালিত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাজের সুবাদে দেশবিদেশ ঘুরে বেড়ান। পুরুলিয়া এবং ঝাড়খণ্ডের কয়েকটি এলাকায় আদিবাসী শিশুদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে তাঁর স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। সব মিলিয়ে জনা ত্রিশেক কর্মী। দু’একজনকে বাদ দিলে বাকিদের মাইনে এক হাজার থেকে শুরু করে তিন হাজার টাকার মধ্যে। অন্যান্য সুবিধের বালাই নেই। কেন এই অবস্থা? তিনি বলেন, “আমরা বাণিজ্যিক সংস্থা নই। একটি অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। কোনও বিশেষ আইন মেনে কর্মীদের মাইনে দিতে আমরা বাধ্য নই।” বস্তুত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনও নির্দিষ্ট সংস্থা না থাকায় অধিকাংশ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা যা খুশি তাই করে চলেছে বলে অভিযোগ করেছেন নাগরিক মঞ্চের সম্পাদক, মানবাধিকার আন্দোলনের দীর্ঘ দিনের কর্মী নব দত্ত।

কিছু কিছু অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক-কর্মীরাও শ্রম আইন অনুযায়ী কিছু সুযোগসুবিধা পান। দেশের বেশ কয়েকটি জায়গায় শ্রম আইন মেনে বাড়ির পরিচারকদের ছুটি-সহ নানা রকম সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। স্বেচ্ছা-শ্রমও তো শ্রম, তবে তা শ্রম আইনের আওতায় আসবে না কেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। পিছিয়ে পড়া মানুষের সেবা ছাড়াও তাঁদের অধিকারের জন্যে লড়াই যাঁরা করেন তাঁদেরই অধিকার থেকে বঞ্চিত করে কিছু শিক্ষিত মানুষ। নববাবুর কথায়, “তথাকথিত ডেভেলপমেন্ট সেক্টরের কারিগরদের শ্রমিক-কর্মীর মর্যাদা যে সব সংস্থা দেয় না, তারা মানুষের উন্নয়ন করবে! এ তো কাঁঠালের আমসত্ত্ব!”

শ্রম দফতরের ঘোষিত ন্যূনতম মজুরিও দেওয়া হয় না অধিকাংশ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীদের। শ্রম দফতর ওই সব সংস্থার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থাও নেয় না। রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী পুর্ণেন্দু বসু বলেন, “স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীরা অভিযোগ জানালে নিশ্চয় ব্যবস্থা নেব। ওঁরা ন্যূনতম মজুরি পাওয়ার যোগ্য। কয়েক জন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। কয়েকটি মামলাও করা হয়েছে।” শ্রমমন্ত্রী জানিয়েছেন, কোনও সংস্থায় যদি দশ জনের বেশি কর্মী কাজ করেন তা হলে তাঁদের প্রত্যেককে ইএসআই-এর আওতায় আনা বাধ্যতামূলক, কুড়ি জনের বেশি কর্মী কাজ করলে পিএফ-এ টাকা জমা দেওয়াও বাধ্যতামূলক। অভিযোগ, অধিকাংশ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্তৃপক্ষই এই সব আইনকানুন জানেন না, জানলেও মানেন না। তাই, বহু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীরা মর্যাদা আর প্রাপ্য সুবিধা পাওয়ার জন্য রাস্তায় নামার দিকেই পা বাড়াচ্ছেন। তবে, এখনই কোনও রাজনৈতিক দলের বা প্রতিষ্ঠিত শ্রমিক সংগঠনের ছাতার তলায় যেতে রাজি নন তাঁরা। প্রকৃত অর্থেই সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে চাইছেন এই সমাজসেবকরা। ওঁরা কি শ্রমিকের মর্যাদা পাবেন? বাতিওয়ালার ঘরে আলো জ্বলবে?

অন্য বিষয়গুলি:

post editorial sukanta sarkar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy