নতুন পর্ব। দুই বিদেশ মন্ত্রী ওয়াং ই এবং সুষমা স্বরাজ। দিল্লি, ৮ জুন। ছবি: এএফপি।
কুনমিংয়ের মাটি ছোঁওয়ার আগের মুহূর্তে বিমান থেকে ভোরের আলোয় এক ঝলক শহরটাকে দেখে বুঝবার জো নেই যে, এই শহর চিনের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা একটি প্রদেশ ইউনান-এর রাজধানী। কাকতালীয় ভাবেই, তিয়েন আন মেন স্কোয়ারের সেই ঘটনার রজতজয়ন্তীর দিনে চিনের এই শহরে পা রাখবার পরে মহাসড়ক, উড়ালপুল, গগনচুম্বী অট্টালিকার ভিড়ে সে ধন্দ আরও বেড়ে যায়। এই কুনমিং কিনা কলকাতার ‘টুইন সিটি’ অর্থাত্ দোসর-নগরী বলে ঘোষিত! পরিসংখ্যান অনেক কিছু জানালেও অনেক সময়েই সব খবর জানায় না, সে কথা আর এক বার প্রত্যয় হল বটে। আবার কলকাতার জন্য মন খারাপ লাগাটাও কিছুটা চেপে বসল।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে চিনের মানুষজন ভারতের নতুন সরকার, নতুন প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে জানতে ভীষণ আগ্রহী। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদী ভারতকে আর্থিক ক্ষমতায় চিনের সমতুল করে তুলতে কতটা সক্ষম, সেই প্রশ্নও উঠতে লাগল সামরিক প্রসঙ্গ অবশ্যই উহ্য। তবে সব কিছুকে ছাড়িয়ে একটা প্রশ্নই বড় হয়ে দেখা দিতে লাগল: চিনের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখা মোদী তাঁর অভিষেকে সে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানালেন না কেন? কেনই বা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর প্রথম বিদেশ সফরের জন্য চিনকে বেছে নিলেন না?
নতুন সরকার যে ভারতের প্রতিবেশকে অগ্রাধিকার দিতে চলেছে, মোদীর অভিষেক কূটনীতির চালেই তা স্পষ্ট হয়েছিল। ভৌগোলিক ভাবে অপেক্ষাকৃত দূরে থাকা দেশগুলির পরিবর্তে প্রতিবেশীদের দিকে যে বেশি নজর দেওয়া প্রয়োজন, নতুন সরকারের প্রাথমিক পদক্ষেপগুলিতে তার ইঙ্গিত রয়েছে। সেই কারণেই সার্কভুক্ত দেশগুলির রাষ্ট্রনেতারা সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলেন। ইতিহাসগত ঘনিষ্ঠতা কিংবা বৈরিতা এবং সাংস্কৃতিক যোগাযোগের পাশাপাশি ভৌগোলিক নৈকট্য যে বিদেশ নীতিতে যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক, সম্ভবত সেই উপলব্ধিরই পরিণতি এটা।
সুতরাং দিল্লির নতুন নীতিকাররা বেজিংয়ের সঙ্গে কী ধরনের সম্পর্ক তৈরি করতে চাইছেন, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন। চিন নিকট প্রতিবেশী, সন্দেহ নেই। সে দেশ এখন ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক সঙ্গীও বটে। চিন ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যের মাত্রা আরও বাড়াতে আগ্রহী। ষাটের দশকের চরম পারস্পরিক বৈরিতাকে পিছনে ফেলে এশিয়ার এই দুই বৃহত্ দেশ গত তিন দশকে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতার পথে যথেষ্ট দৃঢ় পদক্ষেপ করতে সক্ষম হয়েছে। ক্রমবর্ধমান দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য দু’দেশের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক দূরত্বও হয়তো কিছুটা কমিয়েছে। বাছাই করা কিছু ক্ষেত্রে ভারতের পরিকাঠামো উন্নয়নে চিনের সম্ভাব্য বিনিয়োগ দুই দেশের বোঝাপড়া বাড়াতে পারবে। তবে দ্বিপাক্ষিক সীমান্ত বিতর্ক আদৌ থেমে যায়নি। দফায় দফায় দু’দেশের আলোচনা সত্ত্বেও অরুণাচল প্রদেশের অধিবাসীদের চিনে যাওয়ার জন্য ‘স্টেপ্ল্ড’ ভিসা দেওয়া থেকে শুরু করে অন্যান্য সীমান্ত বিতর্ক আজও অব্যাহত। এবং, দুই দেশের বাণিজ্যে ঢল নামলেও চিনের সাপেক্ষে ভারতের বাণিজ্যিক ঘাটতির অঙ্ক ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।
এই প্রেক্ষাপটে মোদীর শপথের পরে পরেই চিনের রাষ্ট্রপ্রধান শি চিনফিং-এর বিশেষ দূত হিসেবে যখন সে দেশের বিদেশ মন্ত্রী ওয়াং ই ভারত সফরে আসেন, তখন নয়াদিল্লি যে দক্ষিণ এশিয়ার নেতৃত্বের বিষয়ে নতুন ভাবে ভাবতে চলেছে, ভারতের বিদেশ মন্ত্রী সুষমা স্বরাজ সে কথা চিনকে আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন। প্রসঙ্গত, শ্রীলঙ্কায় হাম্বানতোতা, পাকিস্তানে গোয়াদর কিংবা অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের সোনাদিয়াতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চিনের ভূমিকার প্রতি দিল্লি অবশ্যই সতর্ক নজর রেখেছে। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর সফরসূচিতে চিন এই মুহূর্তে অগ্রাধিকার না পেলেও উত্তরের এই অতিকায় প্রতিবেশী যে তাঁর সরকারের বিদেশ নীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান নিতে চলেছে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই।
এটা মোটেই কোনও আকস্মিক সমাপতন নয় যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রথম বিদেশ সফরের জন্য ভুটানকে বেছে নিলেন। এখন ভুটানের সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ২০০৭ সালে নতুন ভাবে সম্পন্ন মৈত্রী চুক্তি অনুসারে পরিচালিত। ভুটানের নিরাপত্তার বিষয়টি এখনও ভারতের তত্ত্বাবধানে থাকলেও নতুন এই চুক্তি সে দেশের বিদেশ নীতিকে আগের তুলনায় অনেকটা স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। থিম্পুর সঙ্গে নয়াদিল্লির সাম্প্রতিক কিছু ভুল বোঝাবুঝির নিরসন ছাড়াও ভুটানের পরিকল্পনা ব্যবস্থা, বিশেষত জলবিদ্যুত্ প্রকল্পে ধারাবাহিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়াও এ বারে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর লক্ষ্য ছিল। ভুটানে উত্পন্ন বিদ্যুতের সিংহভাগই ভারত আমদানি করে। ভুটানে নয়াদিল্লির আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তায় এই বিদ্যুত্ উত্পাদনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেলে তা আগামী দিনে ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তাকেই আরও সুদৃঢ় করবে। আবার অন্য দিকে, ভারতই ভুটানের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক সহযোগী।
সর্বোপরি, সম্প্রতি চিন ও ভুটানের মধ্যে দফায় দফায় যে দ্বিপাক্ষিক সীমান্ত আলোচনা চলেছে, আগামী মাসেই তার পরের দফা হওয়ার কথা। এই আলোচনার ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ চুম্বি উপত্যকার উপরে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে যদি চিনের নিয়ন্ত্রণ চলে আসে, তা হলে উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে বাকি দেশের স্থলপথে একমাত্র সংযোগসাধক শিলিগুড়ি করিডর-এর বিপন্নতা বাড়বে। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পরে তিন সপ্তাহের মধ্যে নরেন্দ্র মোদীর সর্বপ্রথম বিদেশ সফর ভুটানে হওয়ায় আপাতবিচারে বিস্ময়ের উদ্রেক হলেও আসলে এই সফর সুপরিকল্পিত। লক্ষণীয়, ইতিমধ্যেই মোদীর সফর শেষে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে জানিয়েছেন, ভুটানে চিনা দূতাবাস হবে না।
মোদীর পরবর্তী সফর জাপানে। চিন ও জাপানের পারস্পরিক সম্পর্কের সমস্যা অনেক দিনের। দক্ষিণ চিন সাগরে ইদানীং এই দুই দেশের সম্পর্ক আরও তিক্ত হয়েছে। তাই এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, প্রাথমিক সফরসূচিতে জাপানকে রেখে চিনের উপর চাপ তৈরি করা মোদীর অন্যতম লক্ষ্য। বর্তমান সরকার অদূর ভবিষ্যতে দেশের পরিকাঠামোয় যে উন্নতি সাধনে আগ্রহী, তার জন্য সম্ভাব্য জাপানি বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে।
ভুটান ও জাপানের পরেই প্রধানমন্ত্রী যাবেন নেপালে। ১৯৯৭ সালের পরে এই প্রথম ভোরতের প্রধানমন্ত্রী নেপালে যাচ্ছেন। সে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনার পাশাপাশি নরেন্দ্র মোদী ভারত ও নেপালের মধ্যে বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তির চূড়ান্ত রূপ দিতে চান। ভুটান বা নেপালের মতো স্বল্পকায় প্রতিবেশীও যে দিল্লির কাছে আদৌ উপেক্ষণীয় নয়, এই সফরে সেই বার্তাও দিতে চাইছেন তিনি।
ভুটান সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী স্পষ্ট বলেছেন, ভারত শক্তিশালী হলে পড়শিরাও নিরাপদ বোধ করবে। অদূর অতীতে কোনও কোনও সময়ে নয়াদিল্লির গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল গোছের অবস্থান আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার পথেই অন্তরায় হয়েছে। সেই প্রেক্ষিতে পড়শিদের প্রতি মোদী সরকারের বাড়তি গুরুত্ব প্রদর্শন খুবই তাত্পর্যপূর্ণ।
আমেরিকা অতীতে গুজরাত গণহত্যার সাপেক্ষে মুখ্যমন্ত্রী মোদীর বিষয়ে কড়া অবস্থান নিলেও প্রধানমন্ত্রী মোদীকে সে দেশে স্বাগত জানাতে উদ্গ্রীব। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত্ও প্রায় স্থির। অন্য দিকে, চিনের বিদেশ মন্ত্রক ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফরসূচির দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখছে। এই প্রেক্ষিতে মোদী সরকার ভারতের বিবেচনাপ্রসূত বা বুদ্ধিদীপ্ত জাতীয় স্বার্থ (এনলাইটেন্ড সেল্ফ ইন্টরেস্ট) রক্ষার জন্য দ্বিতীয় প্রজন্মের জোটনিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করবে কি না, সময়ই তার জবাব দেবে। তবে চিনের আতঙ্কে না ভুগেও পারস্পরিক নির্ভরশীলতার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করে এই বৃহত্ শক্তির মোকাবিলা সম্ভব। মোদী সম্পর্কে চিনের সরকারি মহলে যে উত্সাহ রয়েছে, ইদানীং কোনও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে সেটা দেখা যায়নি। বেজিং তো এটাও জানে যে, চিনের ক্রমবর্ধমান ইসলামি মৌলবাদকে মোকাবিলা করতে গেলে মোদী অত্যন্ত স্বাভাবিক মিত্র। আফগানিস্তান থেকে বছর শেষে মার্কিন সেনা প্রত্যাহৃত হলে তাই এই অঞ্চলে চিন ও ভারতের কৌশলগত সহযোগিতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে।
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক।
মতামত ব্যক্তিগত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy