আলাপ। নাদিন গর্ডিমার ও নবনীতা দেব সেন। কলকাতা, ২০০৮।
দিনটা ছিল ৫ ডিসেম্বর ২০০৮। জোহানেসবার্গের পার্ক টাউন ধনী ইহুদি পল্লি, সুন্দর বাগান-ঘেরা এই বাংলো বাড়িগুলো নাকি অগ্নিমূল্য। ফোনে আমাদের নির্দেশ দিলেন নাদিন: ‘সদরে নয়, খিড়কি-দোর দিয়ে ঢুকে এসো, সোজা উঠোনে গাড়ি পার্ক করে রান্নাঘরের ঘণ্টি বাজাবে। তিন-তিনটে গাড়ি চুরি হয়েছে এ বাড়ির সামনে থেকে!’ সেই নির্দেশ মতো পৌঁছে গেলুম। ঘণ্টি বাজাতেই সহাস্য নাদিন নিজে এসে দোর খুলে দিলেন, সঙ্গে এক সুদর্শন, বলশালী সারমেয়। ঢুকে দেখি ঝাঁ-চকচকে বিশাল রান্নাঘরের এক কোণে, ছবির বই থেকে উঠে এসে, বনেট আর এপ্রন পরে টুল পেতে বসে আছেন এক হাস্যমুখী আফ্রিকান গৃহসেবিকা। দেখে মনে হবে এই ঘরে রান্নাবান্না কেন, কোনও গৃহকর্মই হয় না। বাথটাবওলা মস্ত স্নানের ঘরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে ইংল্যান্ডের পুরনো ব্রিটিশ বাথরুম মনে পড়ল। উনি মনের কথা টের পেলেন, ‘আমার বাড়ির বয়েস একশোর বেশি।’ রান্নাবাড়িটা মূল বাড়ি থেকে আলাদা করে দেওয়া যায়, বিশাল এক দরজা আছে। ভয়াবহ ভাবে নাদিন প্রিভেসি পছন্দ করেন। তাঁকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলুম, ‘তুমি আত্মকথা লিখবে না? দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষ মুক্তির ইতিহাসের সাক্ষী তোমার গোটা জীবন।’
‘না। আমি ব্যক্তিগত জীবনের মর্যাদা রক্ষায় বিশ্বাস করি। বাইরের লোকের সঙ্গে তা ভাগ করে নেবার নয়।’
হ্যাঁ, বাজারে একটা ‘জীবনী’ আছে তাঁর, কিন্তু লেখক কিছু অবাঞ্ছিত ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ এনে ফেলায় পুরো বইটিই নাদিন অস্বীকার করেছেন। তাঁকে কোমল দেখতে, কিন্তু নিজের ধ্যানধারণায় কঠোর।
আমাদের প্রথম আলাপ ২০০৭-এর ২০ এপ্রিল, উইটস ইউনিভার্সিটিতে অমর্ত্য সেন প্রদত্ত ‘নাদিন গর্ডিমার লেকচার’ উপলক্ষে এক আফ্রিকান রেস্তোরাঁর নৈশভোজে। ‘অমর্ত্য-নাদিন কথোপকথনে’ সেদিন ছাত্রছাত্রীদের প্রচণ্ড ভিড় ছিল, হলের দরজাই শুধু নয়, বাইরের গেট বন্ধ করে দিতে হল। নিজের শহরেও এতটাই জনপ্রিয়তা নাদিনের। ঠিক সম্রাজ্ঞীর মতো চলাফেরা। নিচু, কিন্তু শক্ত গলায় নিজের বিশ্বাসের কথা উচ্চারণ করেন। মানুষটি ছোট্টখাট্টো, জুড়ে থাকেন অনেকখানি জায়গা।
কিন্তু সেদিন রাতে তিনি আমার শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছিলেন অন্য কারণে। জীবনকে কতখানি ভালবেসে বেঁচে রয়েছেন প্রতি মুহূর্তে। বক্তৃতার পরে এক আফ্রিকান রেস্তোরাঁয় নৈশভোজ ছিল। আমার পা ব্যথা, বিদ্ঘুটে খাবারগুলো মেয়েই এনে দিচ্ছে। কিন্তু অশীতিপরা রূপসী তরুণী নাদিন বারবার ভক্তদের চক্রব্যূহ ভেদ করে, নিজেই উঠে গিয়ে বিশাল টেবিল থেকে প্রতিটা পছন্দসই খাবার বেছে আনছেন কুমিরের মাংসের কাটলেট, উটপাখির মাংসের বড়া, ঝিনুকের মাংসের চাটনি, মালবা পুডিং আপরুচি খানা! নিষ্ঠা দেখেই আমি বিমোহিত। বাঃ, এঁর ইন্দ্রিয়ের তেজ যৌবনের চেয়ে কম কোথায়?
কিন্তু সে দিন ভাব হয়নি, হল পরের বছর, কলকাতায়, রাজভবনে এক নৈশভোজে, গোপাল গাঁধীর আমন্ত্রণে। নাদিন গোপালের বন্ধু, মহাত্মা গাঁধীর ভক্ত। দক্ষিণ আফ্রিকার অহিংস মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শের মূলে তাঁকেই আগে রাখেন, তার পরে ম্যান্ডেলাকে। পরের দিন আমাদের কফির আড্ডা জমল গ্র্যান্ডে, তখনই আন্তরিক আমন্ত্রণ জানালেন, ‘দক্ষিণ আফ্রিকায় কোনওদিন গেলে আমার কাছে যেয়ো।’
‘এই তো সামনের হপ্তাহেই আসছি’
‘কিন্তু, আমি যে তখন মেক্সিকো যাচ্ছি, আমার বন্ধু কার্লোস ফুয়েন্তেসের আশি বছরের জন্মদিনে’, একটু মুশকিলে পড়লেন যেন, ‘ওদের স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব, না গেলে সিলভিয়া কার্লোস দুজনেই ভীষণ বকবে।’
‘ঘুরে আসুন, সময় আছে, এখন থাকব কেপটাউনে। তিন হপ্তা পরে জোহানেসবার্গে যাবার কথা।’
‘‘বাঃ, তখন নিশ্চয় এসো, দেখা হবে।’ উজ্জ্বল মুখে বাড়ির ঠিকানা, ফোন নম্বর দিলেন। সেই নেমন্তন্ন রক্ষা করছি আজ। দালান দিয়ে যেতে যেতে দেখলুম প্রচুর বইপত্তর ভরা, আলো-আঁধারি একফালি ঘর, জানলার পাশে লেখার টেবিল। দেখে জিজ্ঞেস করলুম, ‘তোমার লেখাপড়ার ঘর?’ নাদিন বললেন, ‘আমার সব।’ নাদিনের একটি ছবি তোলার অনুমতি চাইলুম, পড়ার ঘরে। আমার মুখে চেয়ে হেসে বললেন, ‘এ বাড়ির যে-কোনও জায়গাতে আমার ছবি নিতে পারো, এ ঘর বাদে। এটা আমার প্রাইভেট স্পেস। শোয়ার ঘরের চেয়েও প্রাইভেট। লেখার সময়ে আমি ফোন ডিসকনেক্ট করে দিই। দরজা বন্ধ রাখি। পরিপূর্ণ মনোযোগ দিই লেখায়। বিরক্ত করতে দিই না কাউকে।’ এই ঘরে একান্তে বসে অবাধে সৃষ্টিকর্ম করেন উনি। আমার মতো হাটের মাঝখানে বসে, ফোন ধরে, দোর খুলে, সবার সব দাবি মিটিয়ে, অবশিষ্ট সময়ে কেনই বা লিখবেন?
‘এত পুরনো টাইপরাইটার? কম্পিউটারে লেখো না?’
শিউরে উঠে নাদিন বলেন, ‘ন্না রে বাবা, ও সব নতুন যন্তরে আমার বিশ্বাস নেই। সেলফোন আর কম্পিউটার, এই দু’খানি বস্তু আমি আমার বাড়িতে ঢুকতে দিইনি!’
ফুলে ভরা বাগান একটা পার্কের মতো বড়, ঢেউ খেলানো সবুজ মাঠ দিগন্তে মিশেছে। বসার ঘরে ভর্তি ফুল। সর্বত্র ফুল। ‘সব তোমার বাগানের?’
‘সব নয়। কিছু উপহার পাওয়া।’
উনি ঘণ্টি বাজান, সেবিকাটি ট্রেতে সাজিয়ে চা আনে। নিজের হাতে ঢেলে দিতে দিতে মুম্বইয়ের ২৬ নভেম্বরের সন্ত্রাস নিয়ে কথা বলছেন। নরিম্যান পয়েন্টে ইহুদি হত্যার প্রসঙ্গও এল। পৃথিবী জুড়ে হিংসার প্রকোপ, আর বিশ্বশান্তি নিয়ে উদ্বেগ। নন্দনা বাগান দেখতে গেল। ‘তোমার মেয়েটি বড় সুন্দরী।’
‘তুমিও তো।’ হেসে নাদিন বলেন, ‘ছিলাম।’
‘আচ্ছা, এখন কী লিখছ?’
‘একটা নতুন উপন্যাস ধরেছি।’ খুশি-খুশি গলায়।
‘বাঃ, বিষয়বস্তু কী, জানতে পারি?’
‘উপন্যাস লেখার সময়ে আমি কখনও তা নিয়ে আলোচনা করি না।’ এ বারে কণ্ঠ কঠোর।
‘ঠিক আছে, বরং শুনি মেক্সিকোতে কেমন কাটল?’
‘দারুণ!’ ঝলমলিয়ে হেসে উঠলেন, ‘সিলভিয়া যেমন সুন্দরী, তেমনি গুছুনে, কার্লোসের সব কাগজপত্র গুছিয়ে রাখে, আর অসম্ভব ভাল রান্না করে, অপূর্ব বার্থডে লাঞ্চ তৈরি করেছিল। কিন্তু ছোট করেই...’
‘কবে ফিরলে?’
‘এই তো, ফেরার সময়ে আকাশপথেই আমার পঁচাশি পূর্ণ হল।’ একটু বিব্রত হাসলেন নাদিন।
‘সে কী? একা একা? জন্মদিনের উত্সব হল না?’
‘আমি উত্সব চাইনি। এই যে এত ফুল, সব সেদিনকারই। ছেলেমেয়েরা বাড়িতে এসেছিল।’
আমাদের সঙ্গী তাগাদা দিচ্ছেন। ‘একটু দাঁড়াও’ বলে নাদিন আমাকে তাঁর নতুন গল্পের বইটি এনে দিলেন। ‘বেঠোফেন ওয়জ ওয়ান সিক্সটিন্থ ব্ল্যাক।’ ভিতরে ঝর্নাকলম নিয়ে লিখে দিলেন: ‘টু ডিয়ার নবনীতা, উইথ প্লেজার অ্যাট সিয়িং ইউ আগেন! ইন ওয়র্ম ফ্রেন্ডশিপ, নাদিন।’
সেদিনকার বাড়িভর্তি ফুল, সেই ২০ নভেম্বরের যত ফুল, এখনও শুকোয়নি, নাদিন। শুকোবে না ১৩ জুলাই, ২০১৪, ইন ওয়র্ম ফ্রেন্ডশিপ, নবনীতা।
১৭-৭-১৪ ভালো-বাসা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy