বিবাদী স্বর: সিপিআইএম-এর বিক্ষুব্ধ/বহিষ্কৃত প্রতিবাদীদের নতুন সংগঠন ‘গণমঞ্চ’-র সভা। কলকাতা, ৭ অগস্ট, ২০১৪
যখন তরুণ ছিলাম, নেতারা যা বলতেন, তা-ই ছিল আমাদের বেদবাক্য। সেই সত্তরের দশকে রাজনৈতিক মতাদর্শে বামপন্থী হওয়াটাই ছিল প্রায় অবশ্যম্ভাবী। ঘটনাচক্রে সরকারি বামপন্থীদের সঙ্গে ঘর করিনি। বরং ঝোঁকটা ছিল বেসরকারি বা বিপ্লবী বামপন্থার প্রতিই। তখনকার কথাই বলছিলাম। সে কালে আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া হত, নেতা যখন বলছেন, তখন এর বাইরে কিছু হতে পারে না। নেতা ঠিক কি ভুল, এই মূল্যায়ন অবশ্যই প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাধারার ফল। পার্টি-বিরোধী আচরণেরই শামিল। অর্থাত্, নেতা জিন্দাবাদপন্থীদেরই সম্পত্তি, আর তারাই তাঁকে রক্ষা করবে সাধারণ র্যাঙ্ক অ্যান্ড ফাইল-এর হাত থেকে, বা বলা ভাল তাদের রোষ থেকে। এই বাতিক সংক্রমিত হয়েছে সরকারি বাম দলগুলির ক্ষেত্রেও। অথবা হয়তো আসলে বিপ্লবী পার্টির বেশ কিছু নেতা এই ব্যাধিটা নিয়েই শোধনবাদী দল ছেড়ে বিপ্লবী দলে এসেছিলেন।
যৌবনজলতরঙ্গ রাখিবে কে। তারুণ্য চিরস্থায়ী নয়, সময়ের নিয়ম মেনেই আস্তে আস্তে প্রবীণ হলাম। বিপ্লবী বামপন্থাকে চুলোর দুয়ারে চালান করে জীবনের যুদ্ধে নেমে পড়লাম। জীবন তার অনেক দানের মধ্যে আমাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে ফেলল মাও-ত্সে-তুং-এর দেশে। সম্ভবত অনেক দিনের সুপ্ত আগ্রহ থেকেই চিনের কমিউনিস্ট পার্টির চালচলন সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়ার হাতছানিকে অগ্রাহ্য করা গেল না। শুরু হল সুযোগ আর সময়কে কাজে লাগানো। কখনও হুনানে মাওয়ের আদি বাড়ি, কখনও একে-তাকে ম্যানেজ করে বেজিং-এ পার্টির অফিস ঘুরে বেড়ানো বা কিছুটা সময় বার করে পিকিং ইউনিভার্সিটিতে দিনের পর দিন চক্কর খাওয়া, এ সবই ক্রমশ একটা অভ্যাসে পরিণত হল। আর তারুণ্যের উত্সাহ থেকে রেহাই পাওয়ার ফলে ইতিহাসকে যেন একটু ঠিক করে, নিজের চোখে দেখতে উত্সাহিত হয়ে পড়লাম, হয়তো একটু বেশি করেই।
কী দেখলাম? কী বুঝলাম? একের পর এক উদাহরণ দেখলাম কমিউনিস্ট পার্টির মূল্যায়নের। মাওয়ের মূল্যায়ন করল চিনা পার্টি। বলল, মাও ৭০ ভাগ ঠিক, ৩০ ভাগ বেঠিক। এই মূল্যায়নের কপি চিনের যে কোনও জাতীয় গ্রন্থাগারে পাওয়া যায়। বেজিং এবং হুনান-এ (সম্ভবত মাওয়ের জন্মভূমি বলে) এর ইংরেজি অনুবাদও আছে। ভারতের এবং বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের নেতারা আজ পর্যন্ত ইএমএস, সুরজিত্ বা প্রমোদবাবুর মূল্যায়নের ঝুঁকিই নিলেন না। প্রাক্তন নেতাদের মূল্যায়ন করলে ভবিষ্যতে নিজেদের মূল্যায়ন হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কমিউনিস্টদের এই মূল্যায়নের শৃঙ্খলা বা পদ্ধতির ফলে চিনা পার্টি তার সংগঠনকে উত্তরোত্তর মজবুত করতে পেরেছে, ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্তটা নিতে পিছপা হয়নি।
ভারতের সরকারি মার্ক্সবাদীদের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা হচ্ছিল এক নবীন বন্ধুর সঙ্গে। তার যুক্তিতে, বলনে-চলনে এবং উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশেও দেখলাম আমাদের অতীতকে। বার বার ফিরে যাচ্ছিলাম তরুণ বয়সে। সে-ও সেদিনকার আমার মতোই বিশ্বাস করে যে, মার্ক্সবাদ সর্বশক্তিমান। এবং, সে দিনের মতোই, এ-ও বিশ্বাস করে যে, রাতারাতি পার্টির নেতৃত্ব পরিবর্তনে লাভ কিছু হবে না। তর্ক তুললে জোরের সঙ্গে, উত্তেজনা মিশ্রিত গলায় বলে, ‘বর্তমান নেতাদের একটা অতীত আছে, পার্টি সংগঠন তৈরিতে তাঁদের যথেষ্ট ত্যাগ আছে, সে দিকটাও দেখতে হবে, পাল্টে দাও বললেই পাল্টানো যায় না, সুতরাং আরও সময় চাই।’ শুনতে শুনতে ভাবলাম, ও তরুণ, ওকে নেতারা যা বোঝাচ্ছেন বা বুঝতে বলছেন, ও তা-ই বেদবাক্য ভেবে বুঝে নিচ্ছে। ঠিক যে রকমটা হয়েছিল সেই সত্তরের দশকে।
এই তরুণদের উদ্দেশে, বামপন্থী ইতিহাসের আরও একটা উদাহরণ একটু বলে রাখি। সেই চিনা কমিউনিস্ট পার্টিরই ইতিহাস। সালটা ১৯৭৬। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের বাড়াবাড়ি নিয়ে চিনা কমিউনিস্ট পার্টি বিচলিত হয়ে পড়ল। অনুসন্ধানে দেখা গেল, পার্টির তত্কালীন চরম ক্ষমতাশালী নেতৃত্বই এর জন্য দায়ী। মাওয়ের স্ত্রী চিয়াং ছিং এবং তাঁর আরও তিন সঙ্গীকে পার্টি হুঁশিয়ারি দিল। বন্ধ হল সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অনুশীলন, বন্ধ হল তার বাড়াবাড়িও। ওই ‘চার চক্রী’কে বহু দিন গৃহবন্দি রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কারণ, পার্টি তার অনুসন্ধানের প্রক্রিয়া শুরু করল। কে ঠিক কে ভুল, কী ঠিক কী ভুল, তার বিশ্লেষণ চলল। চলল কয়েক বছর। অতঃপর রীতিমত খোলা আদালতে বিচার হল। শাস্তি হল চিনা পার্টির তত্কালীন দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতানেত্রীদের। সারা বিশ্ব সেই বিচার প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিল।
সেই বিচার নিয়ে অবশ্যই অনেক তর্ক, অনেক সন্দেহ থেকে গেছে। তাতে পার্টির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বসংঘাতের কতটা ভূমিকা ছিল, গোষ্ঠী উপগোষ্ঠীর প্রতিহিংসার ছায়া কতখানি পড়েছিল, তা নিয়ে তর্ক থাকতে পারে, কিন্তু পার্টি নীরব নিশ্চল হয়ে থাকেনি, সমস্ত সমস্যাকে একখানা ধামা নিয়ে চাপা দিতেও ব্যস্ত হয়নি।
ভারতবর্ষের, বলা ভাল বাংলার (ভারতের অন্যত্র তাঁদের খুঁজতে দূরবিন লাগে) সরকারি বাম নেতাদের মূল্যায়ন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy