জোতি বসুর সঙ্গে শৈলেন দাশগুপ্ত, লালুপ্রসাদ যাদব ও মুলায়ম সিংহ যাদব। —ফাইল চিত্র।
ফের ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললেন সনিয়া গাঁধী। এ বার জওহরলাল নেহরুর ১২৫তম জন্মবর্ষ উদযাপনের পটভূমিতে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলিকে একটি মঞ্চে আনার প্রচেষ্টা শুরু করলেন তিনি।
ভারতের রাজনীতিতে প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দল হল বিজেপি এবং কংগ্রেস। ভারতের সমকালীন ইতিহাস বলে, হয় বিজেপি বিরোধিতা আর তা না হলে কংগ্রেস বিরোধিতা— এই দু’টি রাজনৈতিক তাস বার বার ব্যবহৃত হয়। ভারতীয় রাজনীতি পেন্ডুলামের মতো কখনও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে, আবার কখনও বিজেপি-র বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়। ’৬৭ সালে বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভায় কংগ্রেস প্রথম ধাক্কা খেয়েছিল। তার পর ’৭৭ সালেও জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে কংগ্রেস বিরোধী মঞ্চ গঠিত হয়। ’৮৯ সালে বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহের প্রচেষ্টাও স্মতর্ব্য।
বাবরি মসজিদ ভাঙার পর সাম্প্রদায়িকতার বিষটি নতুন করে ভারতীয় রাজনীতির মেরুকরণের অন্যতম নির্ধারক হয়ে ওঠে। সে সময়ে নরসিংহ রাও ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ফলে কংগ্রেসের প্রতিও ভারতীয় সংখ্যালঘু সমাজের অনাস্থা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। কিন্তু মুদ্রার অন্য পিঠে বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবারের দাপটও বাড়তেই থাকে। কংগ্রেস ইউপিএ গঠন করে দশ বছর ক্ষমতায় থাকলেও নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে এ বার বিজেপি যে ভাবে ক্ষমতাসীন হয়েছে তাতে সাম্প্রদায়িকতা বনাম ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনৈতিক স্লোগান আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। নরেন্দ্র মোদী, গাঁধী এবং সর্দার পটেলকে সামনে রেখে ভারতীয় রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করার কথা বলেছেন যখন, তখন নেহরুর গুরুত্বকে মোদী কম করে দেখছেন, এই অভিযোগ তুলে সনিয়া গাঁধী নেহরুবাদী ধর্মনিরপেক্ষতাকে তুলে ধরে পাল্টা চাল দেওয়ার কথা ভাবছেন।
সনিয়া গাঁধী আসলে এক দিকে সিপিএম, অন্য দিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, লালু, মুলায়ম, নীতীশ কুমার দেবেগৌড়া প্রমুখ নেতাকে ডেকে এক নতুন মঞ্চ গঠন করার চেষ্টা করছেন। এখনই এই জোট প্রচেষ্টাকে নির্বাচনী রাজনীতির স্ফটিকে না দেখলেও এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে ভবিষ্যতে ‘রই্যালাইনমেন্ট অফ পলিটিক্যাল ফেসেস’ বা রাজনৈতিক ক্ষমতার পুনর্বিন্যাসের চেষ্টার বীজ সনিয়া বপণ করতেই চেয়েছেন। সব সময়ই এ ভাবেই হয়। বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহ ইলাহাবাদ উপনির্বাচনে কংগ্রেস নেতা সুনীল শাস্ত্রীকে পরাস্ত করার পর যখন গোটা দেশের রাজনীতিতে ঝড় তুলতে চেয়েছেন, তখন তিনি কলকাতায় গিয়েছিলেন এক বিতর্কসভায়। এসএফআই আয়োজিত সভাটি ছিল নেতাজি ইন্ডোরের সভাগৃহে। পরে কিন্তু সেই এসএফআই আয়োজিত বিতর্কসভাই হয়ে উঠল এক অকংগ্রেসি সরকার গঠনের প্রচেষ্টার প্রথম পদক্ষেপ।
মুলায়ম সিংহ যাদব
লালুপ্রসাদ যাদব
সনিয়ার প্রচেষ্টা কতখানি সফল হবে আর কতখানি হবে না, তার বিচার করা আমার আজকের উদ্দেশ্য নয়। নরেন্দ্র মোদীর সরকার আদৌ ধর্মনিরপেক্ষ সরকার হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবেন কি হবেন না, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে না চেয়ে আরও দেখতে চাই এ সরকারের কাজকর্ম।
আজ শুধু একটা বৃহত্ প্রশ্ন তুলতে চাই। তা হল, ভারতের প্রতিটি রাজনৈতিক দলই ধর্মকে রাজনীতির অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে চাইছে। ব্যবহার করতে চেয়েছে অতীতে বার বার, ভবিষ্যতেও কি তাই করবে?
বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবার সাম্প্রদায়িকতার তাস ব্যবহার করেছে। এটা কোনও নতুন অভিযোগ নয়। এক দিকে মোদী উন্নয়নের কথা বলছেন, অন্য দিকে অমিত শাহ ধর্মীয় মেরুকরণের ভিত্তিতে ভোটের রাজনীতিতে বিজেপি-র হিন্দুত্ব ভোটব্যাঙ্ককে আরও সুসংহত করে নির্বাচনী রাজনীতির বৈতরণী পার করতে চাইছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হল, তথাকথিত সেকুলার-পন্থীরা যা করছেন তা-ও কি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি?
হিন্দু রাজনীতির বিরুদ্ধে মুসলিম রাজনীতিই কি ধর্মনিরপেক্ষতা? বাবরি মসজিদ ভাঙার পর উত্তরপ্রদেশে মুলায়ম সিংহ যাদব যে রাজনীতি করেছিলেন তা কি সমর্থনযোগ্য? চতুরঙ্গ পত্রিকার সম্পাদক আবদুর রউফ লিখেছিলেন, যুক্তফ্রন্টের হরকিষেণ সিংহ সুরজিত্ কিংবা জ্যোতি বসুর মতো বিশিষ্ট মাকর্সবাদী নেতারাও মুলায়ম সিংহ যাদবের ইফতার পার্টিতে গেলে জনসাধারণের একটি বড় অংশ যথেষ্ট হতাশ হন। তাঁদের কট্টর ধর্মনিরপেক্ষ মতাদর্শের সঙ্গে এই আচরণও কিন্তু একেবারেই বেমানান। মুসলমান সমাজের প্রতি সৌহার্দ্য প্রদর্শনের জন্য এ ধরনের রাজনৈতিক আচরণের প্রয়োজন কী? মুসলমান সমাজেরও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে আস্থাশীল হয়ে ওঠার দায় নেই?
বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহ
সনিয়া গাঁধী
সম্প্রতি দু’টি ছবি দেখলাম। একটি হল কাশ্মীরের মানুষের বিচ্ছিন্নতার পটভূমিতে সাম্প্রতিক ছবি, অন্যটি হল ’৭৩ সালে তৈরি সথ্যুর গরম হাওয়া। দু’টি ভিন্ন সময়, ভিন্ন পটভূমি, কিন্তু দু’টি ছবিতেই ভারতীয় মুসলমান সমাজের বিচ্ছিন্নতার ছবি দেখা গিয়েছে, যাতে দায়ী কিন্তু মানুষ নয়, দায়ী হল রাজনৈতিক নেতৃত্ব। গরম হাওয়াতে দেখা যায় এক ধনী অগরার মুসলমান জুতো ব্যবসায়ী যিনি ’৮৭ সালের আগে মুসলিম লিগ করতেন। ’৮৭ সালের পর নিজের ব্যবসাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কংগ্রেসে যোগ দিচ্ছেন— আর সে ছবির প্রোটাগনিস্ট বলরাজ সাহানি আর এক জুতো ব্যবসায়ী। তিনি আপস না করায় বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার শিকার। এক ভয়ানক উপলব্ধি তাঁর এক সংলাপে, ‘অভি হিন্দুস্তান মে রহনা হ্যায় তো ভিখারি বনকে রহো, ব্যাপারি বনকে রহনা মুশকিল হ্যায়।’
এই হিন্দু-মুসলিম বিচ্ছিন্নতার শিকড় কিন্তু বিস্তৃত রাজনীতির মধ্যে। ইসলামের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় স্বাধীন যুক্তিবাদী চিন্তার একটা ধারা বরাবর মুসলিমদের মধ্যে ছিল। এই রকম এক যুক্তিবাদী গোষ্ঠীর নাম ছিল ‘মুতাজেলা।’ আধুনিক যুগেও স্যর সৈয়দ আহমেদ, কাজী আবদুল ওদুদের মতো অনেকে নিজেদের নয়া মুতাজেলা-পন্থী হিসাবে পরিচয় দিতে ভালবাসতেন। এই যুক্তিবাদীরা, শরিয়তকে অন্ধ ভাবে অনুসরণের পক্ষপাতী ছিলেন না। হিন্দুবাদীরা যেমন রাজনীতির সাম্প্রদায়িকতায় আক্রান্ত, ঠিক সে ভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে আর এক পাল্টা গোঁড়ামির মঞ্চ বানানো কাম্য নয়। ধর্মের মতো ধর্মনিরপেক্ষতারও কিছু আনুষ্ঠানিকতাকে মেনে নিন। ব্যক্তিজীবনে যাঁর যেমন ধর্মবিশ্বাস সে অনুযায়ী চলুন। কিন্তু রাজনীতির ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে কোনও ধর্মকেও প্রশ্রয় দেওয়া কাম্য নয়। সর্বজনীন দুর্গাপুজো বা কালীপুজোকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে যেমন ব্যবহার করা অনুচিত, তেমনই ইফতার ঈদের নামাজকেও রাজনীতিতে ব্যবহার না করাটাই হোক ধর্মনিরপেক্ষতার আনুষ্ঠানিকতা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy