অভ্যর্থনা। গুলাম আলি ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১২ জানুয়ারি।ছবি: দেবজ্যোতি সরকার
২০১৫ অক্টোবরে, পঞ্জাবের পাটিয়ালা ঘরানার প্রবাদপ্রতিম গজল গায়ক, পাকিস্তানের নাগরিক গুলাম আলির একটি কনসার্ট অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল মহারাষ্ট্র রাজ্যের মুম্বই শহরে। শিবসেনা দলের হুমকি ও চাপে অনুষ্ঠান বাতিল হয়। ক্ষমতাসীন বিজেপিকে এ নিয়ে কিছুটা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। এই প্রেক্ষিতে নিজেদের ‘সহনশীলতা’ প্রমাণ করার প্রচেষ্টায় তৎপর হয় বেশ কিছু অ-বিজেপি রাজনৈতিক শক্তি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ও গুলাম আলিকে আমন্ত্রণ জানান পশ্চিমবঙ্গে অনুষ্ঠান করার জন্য। গত ১২ জানুয়ারি কলকাতার নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে ১৫০০০ শ্রোতার সামনে অনুষ্ঠিত হয় গুলাম আলির গজল সন্ধ্যা। সে দিনের সব ব্যবস্থাপনা ব্যক্তিগত ভাবে তদারকি করেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। গুলাম আলিকে তিনি সংবর্ধনাও দেন। দৃশ্যতই আপ্লুত হয়ে অভিজ্ঞ গায়ক মমতাদেবীর ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, ‘আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ। তিনি সরস্বতী রূপে আমাদের সকলের উপকার করেছেন।’
মমতাদেবীর গুলাম আলির অনুষ্ঠানের হোতা হওয়া নানা ভাবে ইঙ্গিতময়। তিনি এই সংকেত দিলেন যে, ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের সকল এলাকায় সকল মানুষ পাকিস্তানি সব কিছুকে বয়কট করার প্রশ্নে এককাট্টা নয়, সকল এলাকায় অসহনশীল শক্তিগুলির খবরদারিও চলে না। উপমহাদেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক পটভূমিতে এটি অবশ্যই একটি সুস্থ ও শুভ লক্ষণ। কিন্তু আমরা যদি এই অনুষ্ঠান ও পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার খুঁটিনাটি তলিয়ে দেখি, তা হলে দেখব ব্যাপারটি অতটা সহজ নয়। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের অভ্যন্তরে ধর্মনিরপেক্ষ ও সাম্প্রদায়িক সামাজিক-রাজনৈতিক স্রোতগুলির মধ্যে যে আপাতসহজ বিভাজন আছে, তার প্রেক্ষিতে মমতাদেবীর কিছু সংকেত ও চিহ্ন ব্যবহারের রাজনীতি কোন স্রোতগুলিকে পুষ্ট করে, সেটা পরিষ্কার করে বোঝা প্রয়োজন।
কলকাতায় গুলাম আলির গজল সন্ধ্যার উদ্যোক্তা ছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কোন দফতর? পাকিস্তানি গায়কের উর্দু গজলের যে আসলে কোনও ‘ধর্ম’ হয় না, তা বোঝাতে এটির উদ্যোক্তা হতেই পারত সংস্কৃতি দফতর বা নিদেনপক্ষে পর্যটন দফতর। কিন্তু আলোচ্য অনুষ্ঠানটির উদ্যোক্তা ছিল পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও অর্থ নিগম। পশ্চিমবঙ্গের ‘সংখ্যালঘু’দের মধ্যে নব্বই শতাংশের বেশি হলেন মুসলমান। তাঁদের সঙ্গে এক জন পাকিস্তানি গায়কের কী ভাবে কোনও ‘বিশেষ’ সম্পর্ক থাকতে পারে, তা পরিষ্কার নয়, যদি না পশ্চিমবঙ্গ সরকার বোঝাতে চায় যে পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জনগণের তুলনায় গুলাম আলি কোন অর্থে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানের বেশি কাছের। গুলাম আলির উর্দুও কোনও ‘বিশেষ সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানের সঙ্গে তাঁকে আবদ্ধ করে না, কারণ এ রাজ্যের মুসলমানদের নব্বই শতাংশের বেশি হলেন বাংলাভাষী। উদ্যোক্তা চয়নের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের জনগণের এক অংশকে স্রেফ তার ধর্মীয় পরিচিতির মধ্যে সীমিত করা এবং সেই গোদা পরিচিতিটিকে বেশ প্রকট ভাবেই পাকিস্তানের আর এক মুসলমান গায়কের সঙ্গে ‘বিশেষ ভাবে যুক্ত করা— এগুলি ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক আবর্তের সাম্প্রদায়িক ধারায় মুসলমান সম্বন্ধে চালু সবচেয়ে ক্ষতিকর স্টিরিয়োটিপিকাল ধারণাগুলিকেও হাওয়া দেয়। এই থেকে সোজা পৌঁছে যাওয়া যায় ওই পরিচিত ধারণাটিতেও, যা বলে: পাকিস্তানের প্রতি মুসলমানদের বিশেষ প্রেম আছে। বস্তুত, উপমহাদেশে সব রাষ্ট্রেই প্রধান ধর্মীয় সংখ্যালঘুকে ঘরশত্রু হিসেবে কল্পনা করার একটি সুদীর্ঘ লজ্জাজনক ঐতিহ্য চালু আছে, এমনকী রাজনৈতিক ভাবে যারা ধর্মনিরপেক্ষ অর্থে মন্দের ভাল বলে পরিচিত, তাদের মধ্যেও।
মমতাদেবী এই প্রথম বার সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও অর্থ নিগমের ঢালটি আধা-রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছেন, এমন নয়। এই নিগমেরই অনুস্থানগুলিতে তিনি ধর্মীয় সংখ্যালঘু, প্রধানত মুসলমানদের জন্য বিশেষ প্রকল্প ঘোষণা করেছেন। নানা বিশেষের মধ্যে একটি বিশেষ ভাবে দৃষ্টিকটু: পশ্চিমবঙ্গে একটি বিরাট নজরুল কেন্দ্র স্থাপনার ঘোষণা। নিখিল বাংলা-দেশে মুসলমান ঘরে জন্মানো ব্যক্তিত্ব খুব কম ছিলেন বা আছেন যাঁদের যশ হিন্দু-মুসলমানের ধার ধারে না। নজরুল ইসলাম তেমনই এক ব্যক্তিত্ব। লক্ষণীয়, ১৯৭১-পরবর্তী কালে (এবং তার আগেও) তাঁকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় কবি বানিয়ে আলতো করে নজরুলকে ‘বিশেষ’ ভাবে পূর্ব-বাংলার করে গড়ে তোলা হয়েছে। এই ‘বিশেষ’-এর মধ্যে ধর্মের ছাপ অনস্বীকার্য। মমতাদেবীর রকমসকম দেখে মনে হয়, তিনিও বোধহয় নজরুলের এই ভ্রান্ত চরিত্রায়নে আস্থা রাখেন, অন্তত রাজনৈতিক স্বার্থে। তাঁর সংখ্যালঘু উন্নয়ন মঞ্চকে ব্যবহার দেখিয়ে দেয় পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান কী শুনতে চান, সেই সম্বন্ধে তাঁর ঠিক বা বেঠিক ধারণা।
গত বছর মে মাসে মমতাদেবীর সরকার প্রখ্যাত উর্দু কবি আল্লামা ইকবালের নাতি ওয়ালিদ ইকবালকে কলকাতায় ডাকেন সরকারি সাহায্যে চলা পশ্চিমবঙ্গ উর্দু অকাদেমির সম্মেলন উপলক্ষে। লাহৌর থেকে এসে তিনি দীর্ঘপ্রয়াত ঠাকুর্দার সম্মানার্থে দেওয়া পুরস্কার গ্রহণ করেন। আবারও, কোন উর্দু কবিকে সম্মান দেওয়ার ব্যাপারে আপত্তির কীই বা থাকতে পারে? সমস্যা হল, তৃণমূল কংগ্রেস যে ভাবে উর্দু ও মুসলমানকে যুক্ত করে সেটা নিয়ে আল্লামা ইকবালের নাতিকে এনে সেই ব্যাপারটিকে বিশাল সংখ্যক হোর্ডিংয়ের সাহায্যে কলকাতার মুসলমানপ্রধান এলাকাগুলিতে প্রচার করে, তার পিছনের রাজনৈতিক হিসেবনিকেশ ও ধারণা নিয়ে। ঠিক যেমন এই দলের ২০১১ সালের ঘোষণাপত্রে মাদ্রাসা ও উর্দু স্কুলের ব্যাপারটি বেমালুম একসঙ্গেই বলা হয়েছে। এই ভাবেই, ঘোষণাপত্রে তারা গুলিয়ে ফেলে মুসলমান ও উর্দু, তাদের অনুষ্ঠান-সম্মানপ্রদানে উর্দু ও পাকিস্তান গুলিয়ে যায়, এবং পরিশেষে আভাস থাকে মুসলমান ও পাকিস্তানকে গুলানোর। শেষের ভ্রান্তিটিই সবচেয়ে বিপজ্জনক।
পশ্চিমবঙ্গের নব্বই শতাংশ মুসলমান বাংলাভাষী। আল্লামা ইকবাল বা উর্দু বা গোলাম আলি পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙালির থেকে যত দুরে, ততটাই দূরের সেখানকার মুসলমান বাঙালির থেকে। অথচ তৃণমূল কংগ্রেসের মুসলমান নেতৃত্বে আনুপাতিক হারে বাংলাভাষীদের প্রতিনিধিত্ব বেশ কম। দলের জন্মসূত্রে মুসলমান সাংসদদের চল্লিশ শতাংশ উর্দুভাষী, যেখানে রাজ্যের মুসলমানদের মধ্যে তাঁরা দশ শতাংশও না। এঁদেরকে নেতৃত্বে রাখার সুবিধে হল, জনভিত্তিহীন নেতাদের বসিয়ে দলের মুসলমানদের মধ্য থেকে স্বতন্ত্র জননেতা তৈরিকে আটকানো যায়, এই নেতাদের মুসলমানত্ব ভাঙিয়ে সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্বের দায়টিও সারা হয়। পশ্চিমবঙ্গের মোট অধিবাসীর সিকিভাগ হলেন মুসলমান বাঙালি। সেই বর্গ থেকে উঠে আসা স্বতন্ত্র জননেতা যে শর্তে দর কষাকষি করবেন, যে ভাবে নিজেদের রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে ক্ষমতার ভাগ-বাঁটোয়ারার অন্য বিন্যাস তৈরির সম্ভাবনা ধারণ করবেন, তা বর্তমান কায়েমি স্বার্থগুলির স্থিতিশীলতার পক্ষে বিপদ। দেশভাগ-পূর্ববর্তী কৃষক-প্রজা পার্টির আমলে শের-এ-বাংলা ঠিক এটিই করেছিলেন সামন্তপ্রভু নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের ‘শরিফজাদা’ নেতৃত্বের বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে। ১৯৭১-ও এক অর্থে এই আপাতবাঙালি ছুপা-‘উচ্চকুলশীল’ উর্দুপ্রেমীদের ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদের আর একটি ধাপ। দুঃখের বিষয়, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সাতচল্লিশের পর থেকে কোনও ফজলুল হককে পায়নি। তাই কলকাতায় উর্দু-পাকিস্তান আপ্যায়ন করে মুসলমান-মুসলমান খেলা করা সম্ভব। গুলাম আলির গজল সন্ধ্যাকে বুঝতে হবে সেই প্রেক্ষিতেও।
কোনও গোষ্ঠীর উপর ভিন্নতা আরোপ করতে করতে তা এক সময় ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের দৈত্যে পরিণত হতেই পারে। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান বাঙালির আর্থ-সামাজিক ক্ষমতায়নের যে রাজনীতি, তা গজল সন্ধ্যা ও নজরুল তীর্থের চমকের মাধ্যমে সম্ভব নয়। কারণ তার চাহিদাগুলি বিশালসংখ্যক হিন্দু বাঙালির থেকে আলাদা নয়। যথা খাদ্য নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ইত্যাদি। এই চাহিদাগুলি পূরণের যথাযথ পথটি কণ্টকময় ও লম্বা। সে পথে চলতে গিয়ে আশরাফ মুসলমান ও সবর্ণ হিন্দু কায়েমি স্বার্থে ঘা লাগলে অনেক বিরোধিতাও আসবে। কিন্তু সেই কঠিন পথের কোন সহজ বিকল্প নেই।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা’য় মস্তিষ্কবিজ্ঞানের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy