Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
প্রবন্ধ ২

আনুগত্যের দাবি রুখে দিয়েছে যাদবপুর

তর্কশীল মুক্তচিন্তায় অভ্যস্ত যে পড়ুয়ারা, তাঁরা সহপাঠিনীর অসম্মানে সরব হবেন, তাঁদের দমিয়ে রাখতে চাইলে ক্ষমতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠবেন, বন্ধুসম শিক্ষকরাও অনুজদের পায়ে পা মেলাবেন, এ তো অনিবার্য।এখন কলকাতার দু’প্রান্তে প্রধান যে দুটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে তার মধ্যে বয়সে নবীন দক্ষিণ-প্রান্তীয় বিশ্ববিদ্যালয়টিই বর্তমানে আলোচনার কেন্দ্রে, কলরবের মধ্যে। ‘লাঠির মুখে গানের সুর/ দেখিয়ে দিল যাদবপুর’ এই স্লোগান শুনতে শুনতে ইতিহাসের অলিন্দে মন চলে যায়।

প্রশ্নশীল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনশন। ৬ জানুয়ারি, ২০১৫। ছবি: বিভাস লোধ।

প্রশ্নশীল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনশন। ৬ জানুয়ারি, ২০১৫। ছবি: বিভাস লোধ।

বিশ্বজিত্‌ রায়
শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০০
Share: Save:

এখন কলকাতার দু’প্রান্তে প্রধান যে দুটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে তার মধ্যে বয়সে নবীন দক্ষিণ-প্রান্তীয় বিশ্ববিদ্যালয়টিই বর্তমানে আলোচনার কেন্দ্রে, কলরবের মধ্যে। ‘লাঠির মুখে গানের সুর/ দেখিয়ে দিল যাদবপুর’ এই স্লোগান শুনতে শুনতে ইতিহাসের অলিন্দে মন চলে যায়। সেই প্রস্থান অকারণ নয়। যে কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গড়ে ওঠার ইতিহাসের সঙ্গে তার পরবর্তী সংস্কৃতির খানিকটা যোগ থেকেই যায়। যাদবপুরের ক্ষেত্রেও কথাটা সত্য।

শহরের প্রধান দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল সিপাহি বিদ্রোহের বছরে। পঠনপাঠনের কেন্দ্র হিসেবে তার জন্ম হয়নি। ছাত্র-শিক্ষকের কথোপকথনের মাধ্যমে যে চিন্তার বিস্তার, যেমন ঘটেছিল হিন্দু কলেজে ডিরোজিয়ো পর্বে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আদি পর্বে তেমন কোনও অবকাশই ছিল না। এ ছিল পরীক্ষা নিয়ামক সংস্থা: পাঠ্যসূচি নির্মাণ, সেই পাঠ্যসূচি মেনে পরীক্ষা নেওয়া, খাতাপত্র দেখে ফলাফল প্রকাশ করা, পড়ুয়াদের ডিগ্রি বিতরণ করা, এ-সবই ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক কাজ। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার শাসনতন্ত্র ও পঠনতন্ত্রের নিয়ামক হিসেবে সাহেব-শাসকদের পরিকল্পনা অনুযায়ী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আত্মপ্রকাশ করল। বিশেষ পাঠ্যসূচি ও নিয়মতন্ত্র কায়েম করে যে মুক্তচিন্তা আটকে দেওয়া যায়, সেই মহাজ্ঞান সাহেব প্রশাসকদের যথেষ্টই ছিল। সিপাহি বিদ্রোহের বছরে ঢাকা নিউজ-এ ‘এডুকেশন ফর দ্য নেটিভস’ নামে এক লেখায় বলা হয়েছিল, নেটিভদের মনে ও মাথায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার মাধ্যমে একটি বিশ্বাস খোদাই করে দেওয়া উচিত: সাহেব শাসকরা নেটিভদের থেকে শিক্ষিত, সাহেবি শিক্ষা উত্‌কৃষ্ট। ব্যস, তা হলেই নেটিভরা আর বিপ্লব করবে না, উত্‌কৃষ্ট উচ্চশিক্ষিত সাহেবদের শাসন মেনে নেবে। অর্থাত্‌, যত বেশি জানে, তত বেশি মানে! সাহেবরা এতে ফলও পেয়েছিলেন। সেন্ট্রাল টেক্সট বুক কমিটির অনুমোদিত বই ‘সরল কবিতা’-র দশম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে। কবি গগনচন্দ্র রায় ইংল্যন্ডেশ্বরী রানিকে বাহবা জানিয়ে লিখেছিলেন, ‘বিদ্যালয় শত শত/ স্থাপন করেছ কত/ পেয়ে তাতে বিদ্যালোক।/ পুলকিত কত লোক’।

তবে সবাই সাহেবি শিক্ষায় পুলকিত হচ্ছিলেন না। মুক্তচিন্তা আর স্বদেশি ভাবনার সূত্রগুলি যে শিক্ষাক্রম ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সাধারণ পড়ুয়াদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া উচিত, সেটা নেটিভদের মধ্যে অনেকেই ভাবছিলেন। সাহেবদের তৈরি করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই কাজটা করা শক্ত। তার জন্য চাই অন্য রকম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই ভাবনা থেকেই অনেকে শিক্ষার বিকল্প রূপ নির্মাণে সচেষ্ট। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আদিরূপ যে প্রতিষ্ঠানে নিহিত ছিল, সেই ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’ বিকল্প মুক্ত স্বদেশি শিক্ষার স্বপ্ন দেখেছিল। সেটা ১৯০৬ সালের কথা। রবীন্দ্রনাথ এর কয়েক বছর আগে থেকেই শান্তিনিকেতনে শিক্ষার অন্যরূপ নির্মাণে সচেষ্ট। ১৯০২-০৫ পর্বে লর্ড কার্জন বাঙালিদের নানা ভাবে দমিয়ে রাখতে চাইছিলেন, বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। জারি হয়েছিল দমনমূলক কার্লাইল, লায়ন ও রিজলি সার্কুলার। ছাত্ররা রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দিলেন, তিনশোর বেশি ছাত্রকে ঔপনিবেশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার করা হল। প্রধান শিক্ষক কালীপ্রসন্ন দাশগুপ্ত পদচ্যুত হলেন। এই রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মুক্ত-স্বদেশি শিক্ষালয় হিসেবে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের ভিত্তিপত্তন। পরে এখান থেকেই দুটি ধারা তৈরি হয়েছিল: বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ আর বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট। বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ। কারিগরি, বিজ্ঞান, সাহিত্য— তিন ধারার সমন্বয় ঘটানোর কথা ভাবা হয়েছিল এখানে। এখন যে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলা-সাহিত্য-কারিগরি-বিজ্ঞানের পাঠ দিয়ে থাকে, তার আদিরূপ এই প্রতিষ্ঠান। সংগত কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের নাম অরবিন্দ ভবন।

মুক্তচিন্তার ধারা যে বিশ্ববিদ্যালয়ের গোড়ার কথা, তার পড়ুয়াদের চরিত্র অন্য রকম হওয়ারই কথা। ষাটের দশকে যাদবপুরের সাহিত্য ও কলা বিভাগের পড়াশোনায় মুক্ত চিন্তার নানা ভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের স্বদেশিয়ানা তখন হয়তো সে আর বহন করছে না, কিন্তু নতুন নতুন চিন্তাভাবনাকে জায়গা করে দিচ্ছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিপুলসংখ্যক পড়ুয়ার ভার এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বহন করতে হত না। ফলে শিক্ষক ও পড়ুয়াদের সহজ যোগাযোগ গড়ে উঠতে পেরেছিল। কলা-সাহিত্য বিভাগের শিক্ষকেরাও অধিকাংশই অন্য রকম। গণতন্ত্র ও মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী। এলোমেলো ভাবে বিশিষ্ট কয়েক জনের কথা বলা যায়। আবহাওয়া তাতে টের পাওয়া যাবে।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের প্রাণপুরুষ ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। সিগারেট-সচল এই মানুষটি নিজে যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রগতিশীল ছাত্রজীবন কাটিয়েছিলেন, তেমনই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে সাহিত্যপাঠের রক্ষণশীলতাকে দূর করে দিয়েছিলেন। পরে ইংরেজি ও বাংলা বিভাগে এমন অনেকে ছিলেন যাঁরা ছাত্রদের ক্ষমতার স্বরূপ চিনিয়ে দিতেন। বাংলা বিভাগে শঙ্খ ঘোষের ‘রক্তকরবী’ পড়ানো কেবল নাটক পড়ানো ছিল না, ক্ষমতা কী ভাবে জাল বিছোয় আর সেই জাল থেকে কেমন করে বাইরে আসা যায়, এ ছিল তারও ক্লাস। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনায়াসে ছাত্র হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন পরিণত প্রতিষ্ঠিত বাদল সরকার। এই আবহাওয়া আশির দশকের শেষে নব্বইয়ের দশকের গোড়াতেও পূর্ণমাত্রায় ছিল। মাস্টারমশাইরা শুধু পড়াতেন না, তাঁদের পড়াশোনা তাঁদের জীবনযাপনের অঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। ইংরেজির সুকান্ত চৌধুরী তো কেবল শেক্সপিয়র-বিশেষজ্ঞ নন। নগর পরিকল্পনা নিয়ে তাঁর হাজার ভাবনা। সামর্থ্য থাকলেও ব্যক্তিগত গাড়ি কিনবেন না তিনি। তাঁর নগরভাবনায় যে সর্বত্রগামী ব্যক্তিগত গাড়ি বিরক্তিকর উপসর্গ। বিকেলবেলায় পড়ন্ত রোদে উজ্জ্বল চোখে বাস ধরার জন্য অপেক্ষা করতেন বিশ্বচারী সুকান্তদা। বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা গেটের বিপরীতে ছোটখাটো চা ও অন্যান্য খাবারের দোকান। এই দোকানগুলোতে শিক্ষক আর পড়ুয়ারা একসঙ্গে চা খেতেন, সিগারেট বিনিময়েও কারও কারও আপত্তি ছিল না। একসঙ্গে চা-সিগারেট খাওয়া বাইরের চিহ্নমাত্র। আসল কথা হল তর্কশীল হয়ে ওঠা। ক্লাসঘরের বাইরে মাস্টারমশাইরা যত্ন করে ছেলেমেয়েদের তর্কপরায়ণ করে তুলতেন। নানা মত প্রকাশ করতে দিতেন। তর্কশীল করে তোলার ক্ষেত্রে ফাজলামিরও বিশেষ ভূমিকা ছিল। এমনিতে ‘ফাজিল’ শব্দটির একাধিক অর্থ। এই শব্দে পণ্ডিত ও বাচাল, দুইই বোঝায়। যাদবপুরের বহু সুপণ্ডিত শিক্ষক অসম্ভব ফাজিল— বাচালতা, রসিকতা, রেডি উইট তাঁদের ঠোঁটে। মাস্টারমশাইরা গম্ভীর নন, পড়ুয়াদের সঙ্গে একসঙ্গে হ্যা হ্যা হো হো করেন। এতে ভয় যেত ভেঙে, প্রাতিষ্ঠানিকতার ছদ্মগাম্ভীর্য যেত উড়ে। এই যে সাম্প্রতিক বিপ্লবে যদুবংশীয়রা নানাবিধ সরস ক্যাচলাইন সরবরাহ করল, সে কি আর এমনি এমনি!

পাঠ্যসূচিতেও তার প্রতিফলন পড়ত। কলকাতার অপরাপর অধিকাংশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও সাহিত্য বিভাগের পাঠক্রম অন্য রকম, সময়ের দিক থেকে ‘আধুনিক’। পাঠ্যসূচির এই আধুনিকতা একুশ শতকের প্রথম দশকেও বজায় থেকেছে। কত কী যে ঢুকে পড়েছে! ক্ষমতার রূপ ও স্বরূপ নিয়ে কথা বলেছেন যে পাশ্চাত্য চিন্তকেরা, যাদবপুরের ছেলেমেয়েরা সেই ফুকো-লাকাঁর লেখায় মজেছে। মানবীবিদ্যা এখানে স্বমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। উনিশ-বিশ শতকের বাঙালি মহিলা লেখকদের রচনা খুঁজেপেতে চর্চা করেছে, প্রকাশ করেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে সরব হয়েছেন শিক্ষক-পড়ুয়ারা, ‘অপর’ যৌনতাকে বুঝতে চেয়েছেন। এই পাঠক্রমের কথা জানলে সমাজের রক্ষণশীলরা শিউরে উঠবেন। এমন খোলামেলা পাঠ্যসূচিতে অভ্যস্ত যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা, তাঁরা সহপাঠিনীর অসম্মানে সরব হবেন, তাঁদের দমিয়ে রাখতে চাইলে বা পুলিশি ব্যবস্থা নিলে ক্ষমতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠবেন, এ তো অনিবার্য। বন্ধুসম শিক্ষকরাও অনুজদের পায়ে পা মেলাবেন। এই আন্দোলনের শরীরের বাইরের চিহ্নগুলি নিয়ে মাঝেমধ্যেই কথা উঠেছে। কোন ছাত্রী কী পোশাক পরেছেন বা কার মুখের আগুন থেকে কে বৃষ্টিভেজা দিনে সিগারেট জ্বালিয়ে নিয়েছেন, তা নিয়ে অনেক রক্ষণশীল সরব হয়েছেন। তাঁরা খেয়াল করেননি, এই বাইরের পোশাক বা আপাত-নেশার চিহ্নগুলোর গভীরে আছে স্থিতিকামী স্বার্থপর সামাজিকতার বিরোধিতা। প্রতিষ্ঠিত সামাজিকতার বিরুদ্ধে এ-ও প্রশ্ন তোলার উপায়। শুধু বাইরের চিহ্ন দিয়ে এই আন্দোলনকে বিচার করা যাবে না। ভিতরের শক্তিটিকে বুঝতে হবে। ক্ষমতা যে প্রশ্নহীন আনুগত্য দাবি করে, যাদবপুরের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষক ও পড়ুয়ারা তা দিতে নারাজ। সহপাঠিনীর প্রতি অসম্মানের প্রশ্নে ক্ষমতাতন্ত্র সেই নির্জীব আনুগত্য দাবি করেছিল। যাদবপুর সেই দাবি রুখে দিয়েছে। গণতন্ত্রের পক্ষে এই প্রশ্নশীল প্রতিবাদ খুবই স্বাস্থ্যকর।

লেখক বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক

অন্য বিষয়গুলি:

post editorial biswajit roy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE