অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য নানা সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প চালু আছে অনেক দিন। নির্মাণকর্মী, পরিবহণ শ্রমিক, বিড়ি শ্রমিক, হকার, এমন ৬১টি ক্ষেত্রের শ্রমিকরা এর সুবিধা পান। শ্রম দফতরের তথ্য বলছে, লকডাউন যে দিন শুরু হল, সেই ২৩ মার্চ থেকে ৮ মে-র মধ্যে এ রাজ্যে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন ৩ লক্ষ ৪৩ হাজার ১১৬ জন। জুন মাস জুড়ে নথিভুক্ত হয়েছে আরও ১ লক্ষ ৮৬ হাজার নতুন নাম। ‘প্রচেষ্টা’ ও ‘স্নেহের পরশ’ নামে নতুন দু’টি প্রকল্পেও কয়েক লক্ষ শ্রমিক নাম লিখিয়েছেন। কিন্তু জুলাই মাস থেকে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের হেল্পলাইনে ফোন করলে জানানো হচ্ছে, ‘‘এখন অনলাইন আবেদন নেওয়া বন্ধ আছে।’’ অফলাইনেও তাই। দু’মাস আবেদন বন্ধ।
শ্রমিকেরা নতুন করে সরকারি প্রকল্পে নাম লেখাতে পারবেন না, তা-ই কেবল নয়, যাঁদের নাম লেখানো আছে, তাঁরাও সন্তানের শিক্ষা, পরিবারের চিকিৎসা বা কাজ হারানোর জন্য প্রাপ্য টাকা পেতে আবেদন করতে পারছেন না। লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। নিয়ম অনুসারে তাঁরা সর্বাধিক দশ হাজার টাকা পর্যন্ত অনুদান পেতে পারেন, প্রকল্পে জমানো টাকার তহবিল থেকে। এই দুঃসময়ে সেই টাকা কত জরুরি ছিল, সহজেই অনুমেয়। কিন্তু আবেদন নেওয়া হচ্ছে না বলে নিজেদেরই জমানো টাকা শ্রমিকেরা পাচ্ছেন না। কেউ কি ভাবতে পারেন, বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসার জন্য ‘মেডিক্লেম’-এর টাকা দাবি করলে মধ্যবিত্তকে বলা হচ্ছে, এখন আবেদন নেওয়া হবে না? নিমেষে শোরগোল পড়ে যাবে। অথচ কত সহজে খারিজ হচ্ছে শ্রমিকদের আবেদন।
সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প ছাড়াও, বিশেষ বিশেষ পেশার কর্মীদের কল্যাণের জন্য আলাদা আলাদা তহবিল রয়েছে, যা তৈরি হয়েছে সেস-এর টাকা দিয়ে। যেমন, নির্মাণকর্মী কল্যাণ তহবিল, যার পরিচালনায় রয়েছে এক স্বশাসিত বোর্ড (ওয়েস্ট বেঙ্গল বিল্ডিং অ্যান্ড আদার কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ড)। হিসেব অনুসারে ওই তহবিলে অন্তত ২৯০০ কোটি টাকা থাকার কথা। ওই তহবিল থেকে নথিভুক্ত নির্মাণ শ্রমিকেরা হাসপাতাল খরচ ছাড়াও, ওষুধ ও পরীক্ষার জন্য ২০ হাজার টাকা পেতে পারেন। মাতৃত্বকালীন সহায়তা (কন্যাসন্তান হলে ১৬,০০০ টাকা), সাইকেল, চশমা, এমন নানা ধরনের সুবিধা তাঁদের প্রাপ্য। যে হেতু কাজ-হারানো পরিযায়ী শ্রমিকদের একটা বড় অংশ নির্মাণ শ্রমিক, তাই লকডাউনের পর কেন্দ্র বলেছিল, নির্মাণকর্মী কল্যাণ তহবিলের জমা টাকা থেকে নির্মাণকর্মীদের অর্থ সাহায্য করা হোক। এই পরামর্শ (অ্যাডভাইজ়রি) গিয়েছিল সব রাজ্যে।
সেই অনুসারে পঞ্জাব সরকার তিন কিস্তিতে নথিভুক্ত নির্মাণকর্মীদের দিয়েছে ৯০০০ টাকা, হিমাচল প্রদেশ ৬০০০ টাকা, রাজস্থান ৩৫০০ টাকা, হরিয়ানা ৫০০০ টাকা, মহারাষ্ট্র ২০০০ টাকা, দিল্লি ১০,০০০ টাকা, উত্তরপ্রদেশ, অসম, কেরল দিয়েছে ১০০০-৩০০০ টাকা। পশ্চিমবঙ্গে ৩৯ লক্ষ ৯৩ হাজার নথিভুক্ত নির্মাণকর্মী আছেন, এক জনও ওই তহবিল থেকে এক টাকাও পাননি।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে রাজ্য প্রশাসন সম্প্রতি জানিয়েছে, কেন্দ্র শুধু নথিভুক্ত নির্মাণ শ্রমিকদের টাকা দিতে বলছিল। রাজ্য সব ধরনের অসংগঠিত শ্রমিককে সাহায্য করছে। রাজ্যে নথিভুক্ত অসংগঠিত শ্রমিক অন্তত এক কোটি ২০ লক্ষ। লকডাউনে অন্তত ২২ লক্ষ অসংগঠিত শ্রমিককে মাথাপিছু এককালীন এক হাজার টাকা দিয়েছে সরকার। তাতে সমস্যা কোথায়?
প্রথম সমস্যা আইনে। সেস যে উদ্দেশ্যে বসানো হয়, প্রাপ্ত টাকা কেবল সেই উদ্দেশ্যে খরচ করা যায়। অন্য কোনও প্রকল্পে বা তহবিলে সরানো যায় না, অন্য কাজে খরচ করাও নিষেধ। নির্মাণসংস্থাগুলির থেকে সেস বাবদ আদায় করা টাকা দিয়ে গঠিত নির্মাণকর্মী কল্যাণ তহবিলের টাকা নথিভুক্ত নির্মাণকর্মীর জন্যই ব্যবহার করতে হবে। নির্মাণকর্মী কল্যাণ তহবিলের টাকা অন্য শ্রমিকদের জন্য খরচ করে থাকলে রাজ্য সরকার আইন ভেঙেছে।
দ্বিতীয় সমস্যাটি নৈতিক এবং প্রশাসনিক। শ্রমিক কল্যাণের জন্য নির্মিত স্বশাসিত বোর্ডের যদি বাস্তবিক স্বশাসনের ক্ষমতা থাকত, তা হলে আইন ভেঙে তহবিলের টাকা সরানো যেত না। বাস্তব এই যে, এই বোর্ডগুলি রাজনৈতিক প্রভাবে চলে। জনাকয়েক বিরোধী মনোভাবাপন্ন, বা নিরপেক্ষ সদস্যের আপত্তি গ্রাহ্যই করা হয় না। তহবিলের টাকা কোথায় সরানো হচ্ছে, কী ভাবে খরচ হচ্ছে, তার উত্তর মিলছে না। এই কি আইনের শাসন?
নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণ বোর্ডের সদস্য দেবাঞ্জন চক্রবর্তী সংবাদমাধ্যমে অভিযোগ করেছেন, তিন দফায় রাজ্য নির্মাণকর্মী কল্যাণ তহবিলের অর্ধেকেরও বেশি টাকা অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বোর্ডের সভার কার্যবিবরণীতে সে তথ্য পাওয়া যাবে। এই অভিযোগ গুরুতর, কেবল বিরোধীর সমালোচনা বলে একে তাচ্ছিল্য করা চলে না। কেন অন্য রাজ্যের নির্মাণ শ্রমিক তাঁদের তহবিল থেকে টাকা পেলেও, পশ্চিমবঙ্গে তাঁদের অধিকার, বা অন্তত অগ্রাধিকার, স্বীকৃত হল না? কেন পরিবহণ বা বিড়ি কর্মীদের নির্দিষ্ট কল্যাণ তহবিল থাকা সত্ত্বেও এই দুঃসময়ে তা থেকে সহায়তা পেলেন না তাঁরা? কেন সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা হচ্ছে? নতুন নতুন প্রকল্পের ঘোষণা এই প্রশ্নগুলোকে চাপা দিতে পারবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy