হাতে-কলমে: চলছে প্রশিক্ষণ। নিজস্ব চিত্র
সেদিন অষ্টম পিরিয়ডে ক্লাস সেভেনের আলপনার (কর্মশিক্ষা) ক্লাসে চণ্ডীপুরের সাহিন শেখ বলে, ‘‘ও ম্যাডাম, আমি যে কোনও দিন আলপনা দেওয়া দেখিনি! আমাদের বাড়িতে তো এ সব দেয় না।’’
এটা শুনেই অন্য পড়ুয়ারা লেগে পড়ল সাহিনকে আলপনা দেওয়া দেখানোর ব্যবস্থায়। ক্লাসরুমের বেঞ্চগুলোর পিছনে খানিকটা পরিসর আছে। ওখানেই কর্মশিক্ষার সরল ফ্রেমের তাঁত, কোলাজ, কাপড়ের টুকরো বসিয়ে অ্যাপ্লিক, কাগজের তৈরি নানা উপকরণ ইত্যাদি যাবতীয় হাতে-কলমের কাজ করাই। তো সেখানে চক দিয়ে দাগ কেটে আর্টিস্ট পিছু জমির বিলি-বণ্টন হল। সাহিন আঁকতে না বসলেও সমানে বন্ধুদের বাটিতে খড়ির গোলাটা ঘন হয়ে গেলে বোতল থেকে জল ঢেলেছে, ওদের আঁকায় ভুল হয়ে গেলে ভিজে ন্যাতা দিয়ে সে-সব মুছেছে আর চোখ ভরে, মন ভরে বন্ধুদের আলপনা আঁকতে দেখেছে। তার আর্টিস্ট বন্ধুরাও ততটাই বুঁদ ছিল ছোট্ট কাপড়টা খড়িগোলায় ভিজিয়ে আঙুলের টানে কালচে মেঝেতে ওদের মনের রূপকথাগুলো ফুটিয়ে তুলতে। ওদের হাতের আঙুলেই যে একটা করে তুলি ছিল, সেটা অ্যাদ্দিনে আবিষ্কারের ফূর্তিটা বাড়তি।
গরমের ছুটির বেশ ক’দিন আগে কথা হচ্ছিল এ বছরের ক্লাস টেনের ৭১ জন ছেলেমেয়ের সঙ্গে। ওদের কর্মশিক্ষার ক্লাসে হঠাৎই এই নতুন প্রজেক্টটা করার কথা মাথায় এসে থেকে কেবলই ঘুরঘুর করছিল। ভেবে দেখলাম, এতে কর্মশিক্ষা বিষয়টির সব উদ্দেশ্যই সাধিত হচ্ছে। ক্লাসের সবাই সব কাজে সমান আগ্রহী ও দড় হবে, এমন ভাবাটা বোকামি। ফলে প্রথম রাউন্ডে বিশেষ উৎসাহীদের চিহ্নিত করা হল। দরখাস্ত দেওয়া হল হেডমাস্টার মশাইকে। অবিলম্বে মঞ্জুরও হল। কাঁচামাল কিনতে সবার কাছে দশ টাকা করে চাঁদা তোলা হল। উদ্দেশ্য—‘let’s bake a cake Project’। অতঃপর নির্দিষ্ট দিনে প্রচুর বিপত্তি ঘটা সত্ত্বেও সেই কেক-প্রকল্প সমাধা হল। ছুটির পর ছেলেমেয়েরা কেক প্রস্তুতির প্রণালী, গড়পরতা একটা খরচপাতির হিসেব এবং সেদিন সারাদিন (প্রথম থেকে অষ্টম পিরিয়ড) ধরে কাজটি করার যাবতীয় অভিজ্ঞতা লিখে যথা নিয়মে প্রজেক্ট-রিপোর্ট জমা দিয়েছে।
এক দিক থেকে দেখলে এই কর্মশিক্ষা বা ওয়ার্ক এডুকেশন বিষয়টি আদ্যন্ত জীবনযাপনের শিক্ষা। জীবনশৈলী শিক্ষা বললেও ভুল হয় না। বলা প্রয়োজন, ২০০৮ সালে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ সময়োপযোগী এই জীবনশৈলী শিক্ষা বিষয়টিকে মাধ্যমিক ও নিম্নবুনিয়াদি স্কুলগুলিতে প্রণয়ন করলেও শিক্ষক ও অভিভাবকদের অজ্ঞানতাজনিত অনাগ্রহে ও কুণ্ঠায় ধীরে ধীরে তা স্কুলের রুটিন থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়েছে বহুদিন। এই কর্মশিক্ষা এখন মাধ্যমিক পরীক্ষায় ঐচ্ছিক। তবে আশার কথা, পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্য বিষয়গুলির সঙ্গে এই বিষয়টি এখনও রুটিনে বহাল আছে। আর তাই বড়া স্কুলের পড়ুয়াদের পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত আল্পনা, গান, ছড়া লেখা, গল্প লিখে অলঙ্করণ, নাটক, মাটির কাজ, বাঁধনি, সেলাই ও উলবোনা, বয়স অনুযায়ী নানা হাতের কাজ থেকে রান্নাবান্না পর্যন্ত করে হাতে-কলমে শিক্ষাদানের অবকাশ আছে। এতে পড়ুয়াদের সাহিত্য-বোধের পাশাপাশি এক রকম নান্দনিক দৃষ্টি তৈরি হয় ওদেরই অজান্তে। কর্মশিক্ষার সঙ্গে অন্য বিষয়গুলির ‘কো-রিলেশন’ স্থাপন করা যায় সহজেই। এতদ্সত্ত্বেও বিষয়টির মর্যাদা বাংলা-ইংরেজি-ইতিহাস-ভূগোল বা অঙ্ক- জীবনবিজ্ঞান-ভৌতবিজ্ঞানের মতো নয় স্বাভাবিক ভাবেই। কেননা মাধ্যমিক পরীক্ষায় তো এটা উঠেই গিয়েছে!
অথচ পাঠ্যপুস্তকের বাঁধাধরা শিক্ষার বাইরে প্রকৃতি ও দৈনন্দিন কাজ হাতেকলমে শেখার মধ্যেও যে কতটা আনন্দ আছে, তা সেই কবেই লিখে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর—‘...শিক্ষাকে জীবনের অঙ্গ হতে হবে, জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন এক নির্বস্তুক কিছুতে পরিণত হওয়া তার উচিত নয়। তাই শিশুদের আমার কাছে এনে তাদের সর্বাঙ্গীণ সম্পূর্ণ জীবনযাপনের সুযোগ দিলেম। তাদের ইচ্ছেমতো সবকিছু করারই স্বাধীনতা ছিল। ...চেষ্টা করেছি তাদের মনে সবকিছু সম্বন্ধেই ঔৎসুক্য জাগাতে—প্রকৃতির সৌন্দর্যে, আশেপাশের গ্রামে, অভিনয়ের মাধ্যমে, সাহিত্যে, সঙ্গীতে। প্রকৃতির রাজ্যের সবকিছু দিয়ে, শুধু ক্লাসের পড়া দিয়ে নয়, পর্যবেক্ষণ ও সক্রিয় সহযোগিতার মাধ্যমে।’ (আমার আদর্শ/ ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৩০)
কিন্তু মুশ্কিল হল, যে কারণে ১৯৬০ সালে কোঠারি কমিশন এই কর্মশিক্ষা বিষয়টির উপরে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ৫+৩+২ এই হিসেবে মাধ্যমিক স্কুলের পঠন-পাঠনটিকে সাজিয়েছিল, যাতে রাষ্ট্রের পরিচালিত সব মাধ্যমিক স্কুলে জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ ও বিত্ত নির্বিশেষে প্রতিটি পড়ুয়াকে বৃত্তিমূলক শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসাটা সুনিশ্চিত হয়, সেই কারণগুলি অর্থাৎ শিক্ষা বনাম অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার চিরাচরিত দ্বন্দ্বটি আজও সমাজে বিদ্যমান। শিক্ষা একটি শিশুর মধ্যে লুকিয়ে থাকা সমস্ত সামর্থ্যের উন্মেষ ঘটাবে, এটাই শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হলে কর্মশিক্ষা বিষয়টি এই লক্ষ্য সাধিত করার অন্যতম হাতিয়ার। কারণ এই বিষয়টির সিলেবাসে অপরিসীম সম্ভাবনা রয়েছে।
কোথায় যেন এ রকম একটা লেখা পড়েছিলাম— ‘life itself has got no meaning but it is a chance to make one’s life meaningful’। কর্মশিক্ষা বিষয়টি ঠিক এই জন্যই এতখানি তাৎপর্যপূর্ণ।
বেশ ক’বছর আগে বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ে আমাদের বড়া স্কুল যুব সংসদ বা ইযুথ পার্লামেন্ট প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করার জন্য মনোনীত হয়েছিল। উক্ত দিনে জবরদস্ত সেশন চলছিল নানা স্কুলের পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়াদের নিয়ে যুব সংসদ প্রতিযোগিতার। অংশগ্রহণকারী ছ’টি স্কুল। তাদের প্রত্যেকের জন্য ৪৫ মিনিটের বরাদ্দ সময়ে যেন এক দিনের এক-একটা আস্ত বিধানসভা বা লোকসভা অধিবেশন। প্রতিযোগীরা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে সমস্ত বিধি-নিয়ম অনুসরণ করে নিবেদন করল। মায় সরকার পক্ষ আর বিরোধী পক্ষের তুলকালাম কাজিয়াও দেখাল। সমস্ত স্কুলের পড়ুয়া ও ভারপ্রাপ্ত শিক্ষকদের কুর্নিশ। কী অক্লান্ত পরিশ্রম,মেধা ও আবেগের রসায়নে যে এই কঠিন, প্রায় দুরূহ কাজটা এই শিক্ষকেরা করেন, বিশেষত আমাদের মতো প্রান্তিক ছেলে-মেয়ে সমৃদ্ধ স্কুলে!
তবে এ কাজটার একটা সুবিধে আছে। এই প্রোগ্রামটি যেহেতু বহুকাল ধরে সরকারের বিশেষ আনুকুল্য-প্রাপ্ত, মানে এর জন্য স্কুলগুলিতে একটা বড় অঙ্কের টাকা ধার্য হয়, চারদিকে একটা শোরগোল পড়ে, তাই এর কৌলিন্যও বাড়ে বইকি। আর এই যে রাষ্ট্র, তার শিক্ষা-দফতরকে সরাসরি যুক্ত করছে তার উপভোক্তা অর্থাৎ পড়ুয়াদের মধ্যে এই সামাজিক-রাজনৈতিক-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোটিকে সকাল সকাল চারিয়ে দিতে। কারণ ১৮ বছরে এই পড়ুয়াই হবে এক স্বাধীন ভোটার। এই বিরাট কর্মযজ্ঞটি যেহেতু রাষ্ট্রের (হাতেকলমে করল না হয় মধ্যশিক্ষা পর্ষদ) সমর্থনে পুষ্ট, তাই স্কুলে এ কাজের একটা বিশেষ মান্যতা পাওয়া যায়। ক্লাসের ভার কমানোর কথা তখন আর ইনিয়ে বিনিয়ে নয়, রীতিমতো অধিকারের পর্যায়ে বলবৎ হয়। যে কোনও কর্মশিক্ষার শিক্ষক তাঁর অভিজ্ঞতার নিরিখে এটা নিশ্চিত সহমত হবেন যে, এই গুরুত্ব যদি ছবি আঁকা, নাচ-গান-বাজনা, পড়ুয়াদের স্ব স্ব এলাকার হস্ত-শিল্প, নাটক-নির্মাণ, সাহিত্য-সভা, প্রকৃতি-পাঠ, বিবিধ সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের পরিসরে মেলে ধরার সুযোগ পেতে পারত বা এ রকম আরও নানা শিশু মনের নান্দনিক বিকাশের মাধ্যমগুলির উপরেও বর্তাত, তা হলে সামগ্রিক ভাবে রাজ্যের পড়ুয়াদের ছবিটা হয়তো অন্য রকম হতো।
আসলে গোলমালটা আরও গভীরে। শিক্ষণ-শিখন— এই ‘টু-ওয়ে’ প্রক্রিয়ায় শিশুর মনে সেটাই প্রোথিত হয়, যা বিপরীতে থাকা শিক্ষকের মনের চেতন বা অবচেতনে আছে। শিক্ষা যেহেতু কর্মসংস্থানের সঙ্গে প্রায় সমার্থক, তাই সহজ সমীকরণটির হাতছানি হল, পরীক্ষায় প্রথম হওয়া মানে আদতে জীবিকানির্বাহের ভিড়ে যোগ্যতম প্রমাণিত হয়ে এক নিশ্চিন্ত জীবন ও জীবিকার হকদার হয়ে ওঠা। তাই তো বারবার সেই ফার্স্ট হওয়ার লড়াই যে কোনও ময়দানে! সেই লড়াইয়ে কর্মশিক্ষার স্থান কই?
(লেখক বড়া শ্রী গৌরাঙ্গ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা, মতামত নিজস্ব)
এই বিভাগে লেখা পাঠান নীচের ইমেল-এ
mail.birbhum@abp.in। অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন। অন্য কোনও পত্রিকা, পোর্টালে পাঠানো লেখা অনু্গ্রহ করে পাঠাবেন না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy