—ফাইল চিত্র।
আমার দেখা দুগ্গারা বছরভর বাপের বাড়িতেই থাকে। বড়জোর বাপ-দাদাদের ভিটে ঘেঁষে কোথাও ভাড়া থাকে, বা একচিলতে মাথা গোঁজার ঠাই করে নেয়। পুরুলিয়া শহরের জবা বাগদি ছিল নিঃসন্তান। শ্বশুরবাড়ির গঞ্জনা সইতে না পেরে বাপের বাড়ি চলে আসে। আমাদের সংসারে কাজে বহাল হয়েছিল। কথায় কথায় হেসে গড়িয়ে পড়ত। এত হাসি কোথায় পেত কে জানে। অসম্ভব জলের কষ্ট ছিল পুরুলিয়ায়। টাইম-কলে রাত তিনটে থেকে লাইন পড়ত। কিন্তু জবা ঠাকরুন বালতি নিয়ে গেলে কিছুক্ষণের ভেতরেই জল নিয়ে বীরাঙ্গনার মতো চলে আসত। এক দিন জিজ্ঞাসা করলে হেসে লুটিয়ে পড়ে বলে, ‘মুই বাগদিটো বটে। টেমকলে গিয়া সক্কলকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিব ভয় দিখাই। ব্যস্, ঘড়া-বালতি সক্কলে সরাই লেয়।’ আর তখনই আমি আবিষ্কার করি অন্য ঘরের ভাড়াটেরা বা টুকটাক পরিচিত মানুষগুলো কেন ছাতি ফেটে মরলেও আমাদের ঘরে সরবতটুকুও খায় না। ‘উটি যে জবা বাগদি দুগ্গা মায়ের পবিত্র ছোঁয়া বটে।’
উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জের যে দুগ্গার নাম না করলে পাপ হবে, সে হল সালেমা খাতুন। প্রায় আমারই সমবয়সি, এসেছিল আমার তিন বছরের মেয়ের দেখাশোনা করতে। হয়ে গেল আমারই ফ্রেন্ড-ফিলজফার-গাইড। এ দুগ্গারও জন্ম-ইস্তক নিবাসস্থল সেই বাপের বাড়ি ‘পিরোজপুর’। ‘ধরা বিয়ে’ দিয়েছিল বাড়ি, গাঁয়ের লোকরা। পতিদেবতাটি সালেমার কানের একজোড়া সোনার মাকড়ি আর একটা হৃষ্টপুষ্ট ছাগল নিয়ে সেই যে রিকশা কিনতে গিয়েছে আজও আসেনি। যখন গিয়েছিল তখন সালেমা নয় মাসের গর্ভবতী। গর্ভের সেই সন্তান এখন দুই সন্তানের মা। অফিস কোয়ার্টারের মুসলিম বাড়িগুলোতে কাজ করত সে। ‘জানেন দিদি মেয়েটাকে একটা ঝুড়ি চাপা দিয়ে কাজ করতাম। মাঝে মাঝে ঝুড়ি তুলে দেখতাম, দুধ দিতাম।’ একটা ‘কাজের বাড়ি’ ওকে বদলি হয়ে যাওয়ার সময় সেলাই মেশিন দিয়ে যাবে বলে বছরের পর বছর কম টাকায় কাজ করিয়েছিল। না দিয়ে চলে যায়। আমাদের বদলির সময়ে একটা সেলাই মেশিন দিয়ে এসেছিলাম। সে বছর বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ফোন আসে, ‘দিদি মেশিনটারে বিশ্বকর্মার পুজো করছি। ফুল, ধূপ দিচ্ছি।’ টিভিতে সমুদ্রের দৃশ্য দেখালেই সালেমা ছুটে আসত। ‘দিদি সমুদ্র অনেক বড়? নীল রঙা?’ ওকে আমার কথা দেওয়া আছে, একবার সমুদ্র দেখাতে নিয়ে যাব।
বীরভূমের দুগ্গা মা মিলি ডোম বীরদর্পিণী, বরাভয়া। সাইকেল নিয়ে কাজে আসত। ছোট মেয়েটার সাত মাস বয়সে স্বামী মারা গেলে বাপের বাড়িতে পাকাপাকি চলে আসতে হয়। পোড়-খাওয়া জীবনে কষ্ট ভুলতে মাঝে মাঝে একটু ‘দিশি’ চলে তার। সে দিন আর কাজে না এসে ফোন করত, ‘বুদি, একটু কষ্ট করে নাও আজকে। কাল মেক আপ দেব।’ জাতপাত–ছোঁয়াছুঁয়ি সাংঘাতিক ঘেরাটোপের সেই শহরে মেয়ের জন্মদিনে ওকে এক টেবিলে খেতে বসার আহ্বান করলে কেঁদে ফেলেছিল। ওই প্রথম আমি এই দুগ্গা মায়ের ভেতরকার নরম তলতলে জায়গাটা দেখতে পাই। তারাপীঠের প্রসাদ ‘কারণবারি’ লুকিয়ে মিলির সঙ্গে ভাগ করে খেয়েছিলাম। রান্নাঘরে পা ছড়িয়ে বসে আমরা দুই দুগ্গা একবার হেসে গড়াই, একবার কেঁদে ভাসাই।
আর এক দুগ্গা, হল রাধা, ওরফে জাহানারা। সন্তানসম্ভবা আমাকে দেখাশোনার জন্য সে বহাল হয়েছিল। উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট মহকুমার কাটিয়াহাটে থাকতো। ‘জাহানারা’ নামটার জন্য কোথাও ভাড়া পাচ্ছিলাম না। শেষে সেই উপায় বাতলে দেয়, ‘দিদি আমার একটা হিন্দু নাম দিন’। রাধাষ্টমীর দিন কাজে বহাল হয়েছিল বলে নাম হল ‘রাধা’। মাত্র নয় বছর বয়সে তার বাবা সতিন-সহ এক লোকের সাথে বিয়ে দেয়। শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পর দিনই মাঠ ভেঙে পালিয়ে আসে। তার পর থেকে লোকের বাড়ি কাজ করে বেঁচে থাকা। কিছু দিন কাজ করার পর বাড়ির চাপে কাজ ছেড়ে চলে যায় রাধা। সাত-আট মাস বাদে হঠাৎ এসে বলে, ‘আমি আবার কাজ করব।’ যে কাজ করছে তাকে বিনা কারণে ছাড়ানো সম্ভব নয়, অন্য কাজের ব্যবস্থা করে দেব, এমন আশ্বাসে খুশি না হয়ে চলেও গেল। বছর দুয়েক বাদে ফের দেখা। কোলে বাচ্চা। হেসে বলে, ‘বাড়ি থেকে আব্বা আবার বে দিল। এবারে সতিন মরে গিয়েছে। তবে সতিনের চার ব্যাটা আছে। বড় ব্যাটা আমার থেকে বড়। কেমন ধারা চাউনি। সিদিন বাড়ি থিকে পলাই এসেছিলাম আপনের কাছে।’
কত অসুর নিধন করে বাঁচছে এই দুর্গারা, কত বার নিহত হচ্ছে নিজেরাও। একশো আটটা নামে আর কুলাচ্ছে না। আরও নাম থাক, অনিমা, ফতেমা, রিনা, পিঙ্কি, পুষ্প...।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy