Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪
Women's Hockey Team

সমস্যা বহু, তবুও লড়ছে মেয়েদের হকির দুই দল

দুই জেলার দু’টি দল। লড়াইও ভিন্ন। লকডাউন সমস্যা বাড়িয়েছে। তবুও অদম্য পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরের হকি দল দু’টি। দল দু’টির সমস্যার খোঁজ নিলেন সৌমেশ্বর মণ্ডল ও গোপাল পাত্র দুই জেলার দু’টি দল। লড়াইও ভিন্ন। লকডাউন সমস্যা বাড়িয়েছে। তবুও অদম্য পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরের হকি দল দু’টি।

ছবি ক্যাপশন: লড়াকু:  দুড়িয়ার দুই হকি খেলোয়াড় সুদেষ্ণা বেরা ও কবিতা সিংহ  নিজস্ব চিত্র

ছবি ক্যাপশন: লড়াকু:  দুড়িয়ার দুই হকি খেলোয়াড় সুদেষ্ণা বেরা ও কবিতা সিংহ  নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০২০ ০০:৫৭
Share: Save:

শুুরুতে দু’দলেরই সমস্যা ছিল। শুরু করার সমস্যা। পূর্ব মেদিনীপুরে তো রীতিমতো প্রথা ভাঙার সামাজিক লড়াই। পশ্চিমে শুরু হয়েও ধরে রাখার সমস্যা। প্রাথমিক সমস্যা কাটিয়ে ওঠা গিয়েছে। কিন্তু দেখা দিয়েছে নতুন সমস্যা।

পূর্ব মেদিনীপুরের পটাশপুর ১ ব্লকের গোপালপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে ডাঙরতুলসী প্রত্যন্ত গ্রাম। গ্রামের কিছু মেয়ে সাহস দেখিয়ে হাতে হকি স্টিক তুলে নিয়েছিল। সেটাই পূর্ব মেদিনীপুরের প্রথম হকি দল। এখন মহিলা হকি দলে ৫২ জন সদস্য। অর্থের কারণে ভাল প্রশিক্ষক দিয়ে অনুশীলন করানোর ক্ষমতা নেই ডাঙরতুলসি বাসন্তী ক্লাবের। এই ক্লাবের হয়েই খেলে মেয়েরা। স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া মেয়েরাই এই দলের সঙ্গে যুক্ত থাকার ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার কারণে হকি প্রশিক্ষণ বন্ধ রাখা হয়েছিল। এপ্রিলের শুরুতে কয়েকদিন প্রশিক্ষণ চলছিল। খরচ বাঁচাতে পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে এক প্রশিক্ষক এনে ডাঙরতুলসি স্কুল মাঠে অনুশীলন শুরু হয়।

কিন্তু অনুশীলন চলাকালীন করোনা বিপর্যয়। এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে লকডাউনের পর সম্পূর্ণ ভাবে হকি প্রশিক্ষণ বন্ধ হয়ে যায়। ডাঙরতুলসীর আশেপাশে সাতবাহিনী, শ্রীখোদা, চকঘনু, খাড়ান, চকরাজা, টাকাবেড়িয়া-সহ একাধিক গ্রামের মেয়েরা এই দলের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। লকডাউন পরিস্থিতিতে বাড়ির মেয়েদের মাঠে পাঠাননি অভিভাবকেরা। ঘরবন্দি মহিলা হকি দল। বাড়িতে কসরত করছে তারা। দলের অধিনায়ক অনিন্দিতা দাশ বলেন, ‘‘করোনার কারণে আমাদের অনুশীলন বন্ধ রয়েছে। করোনা পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার পরে অক্টোবরে নতুন করে অনুশীলনের প্রস্তুতি নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।’’

পশ্চিমের লড়াইটা একটু আলাদা। গ্রামে হকির প্রসারের জন্য ২০০৮ সালে বেঙ্গল উইমেন হকি অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক সুরভি মিত্র বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। সবং ব্লকের দশগ্রামের বাসিন্দা মাধবী রানা কলকাতায় চাকরি করতেন। তাঁর সঙ্গেই নারায়ণগড়ের দুড়িয়া গ্রামে আসেন সুরভি। প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষগুলো হকি নিয়ে খুব একটা উৎসাহ দেখাননি। তবে সুরভির দিয়ে যাওয়া হকিস্টিক ও বল নিয়ে কয়েকজনের উদ্যোগে কয়েকদিন মেয়েরা মাঠে নামে। পরে হাল ধরেন গ্রামের বাসিন্দা অমিতাভ পাল। ২০০৯ সাল থেকে মেয়েদের নিয়ে অনুশীলন শুরু করেন। রবীন্দ্র সরোবরে একটি টুর্নামেন্টে যোগও দেয়। কোয়ার্টার ফাইনালে হাওড়ার একটি দলের কাছে হেরে যায়।

২০১২ সালে দুড়িয়া মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্রের মেয়েরা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা দলে খেলে। ২০১৩ সালে রাজ্য হকি লিগে দুড়িয়ার মেয়েরা ভাল খেলে। এই বছরই কবিতা সিংহ ও শিউলি সিংহ রাজ্য দলে সুযোগ পেয়ে অসমে জাতীয় হকি প্রতিযোগিতায় যোগ দেয়। ২০১৪ সালে দুড়িয়ার দীপশিখা শাসমল, সুদেষ্ণা বেরা, রীমা চক্রবর্তী ও মামণি পড়িয়া অসমে জাতীয় হকি টুর্নামেন্টে যোগ দেয়। ২০১৭ সালে সুদেষ্ণা ও অনুরিমা জানা অনূর্ধ্ব ১৭ রাজ্য বিদ্যালয় হকি দলে সুযোগ পায়। হরিয়ানার রোহতকে জাতীয় বিদ্যালয় হকি প্রতিযোগিতায় খেলে। রাজ্য দলের অধিনায়ক ছিল সুদেষ্ণা। ২০১৯ সালে রাজ্য বিদ্যালয় হকি প্রতিযোগিতায় পশ্চিম মেদিনীপুরের ছেলে ও মেয়েদের দল ট্রফি পায়। ২০১৯ সালে রাজ্য বিদ্যালয় মহিলা হকি দলে সুযোগ পায় যমুনা মান্ডি, যুথিকা ভুঁইয়া ও বর্ষা বাস্কে। হরিয়ানায় জাতীয় বিদ্যালয় হকি প্রতিযোগিতা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই প্রতিযোগিতা এখনও হয়নি। ২০১৯ সালে রাজ্য ওপেন মহিলা দলে সুযোগ পেয়ে কেরলে জাতীয় মহিলা হকি প্রতিযোগিতায় যোগ দেয় রীমা চক্রবর্তী। ২০২০ সালের মার্চ মাসে রাজ্য ওপেন দল নির্বাচনে দুড়িয়া থেকে ১৩ জন মেয়ে যোগ দিয়েছিল। চারজন রাজ্য দলে সুযোগ পেয়েছে।

২০১৯ সালে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা থেকে হকি দল পাঠানো নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। রাজ্য হকি সংস্থার উদ্যোগে পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা হকি দল রেজিষ্ট্রেশন করে। ছেলে ও মেয়েদের দল রাজ্য প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়ে সেমিফাইনালে হারে। চলতি বছর হকি খেলার অনুমতি পায় পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা। ২০০৯ সাল থেকে দুড়িয়ার পাশাপাশি গ্রাম থেকে অনেকেই ওপেন ও বিদ্যালয় জাতীয়স্তরের প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়েছে। হকি খেলার শংসাপত্র থাকায় মানসী মান্না, রীনা দাস ও সুদেষ্ণা জানার পুলিশের চাকরি পেতে সুবিধে হয়েছে। এছাড়াও রাজ্য হকি খেলার শংসাপত্র থাকায় সুষমা জানা কলকাতায় একটি কলেজে বিপিএড পড়ার সুযোগ পেয়েছেন।

১০ বছর ধরে পশ্চিম মেদিনীপুরের নারায়ণগড়ের একটি গ্রামের মেয়েরা হকি খেলে রাজ্য ও জাতীয় প্রতিযোগিতায় যোগ দিচ্ছে। সম্প্রতি ছেলেরাও সুযোগ পাচ্ছে। এই ছেলে মেয়েরাই গ্রামের মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্রে পড়ে। তারাই পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা হকি দলের সদস্য। ১০ বছর কেটে গেলেও খেলার প্রসার ঘটেনি। প্রশিক্ষক অমিতাভ পাল জানান, হকি প্রসারের জন্য অনেকবার জেলা কর্তাদের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে। কিন্তু তাঁরা আগ্রহ দেখাননি। অমিতাভ বলেন, ‘‘আমাদের রাজ্যে বর্ধমান, নদিয়া ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা ছাড়া যে কোনও জেলার তুলনায় পশ্চিম মেদিনীপুর এগিয়ে। এই তিন জেলায় বিভিন্ন ব্লকে হকি খেলা হয়। পশ্চিম মেদিনীপুরে দু’তিন জায়গায় খেলা হলে জেলা দল রাজ্য সেরা হতে পারত।’’

দুড়িয়ার মেয়েদের দলেও অনেকে সমস্যা। স্কুলের পড়া শেষ হলে তারা অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হচ্ছে। ফলে গ্রাম ছাড়া হচ্ছে। অনেকের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। একটি মেয়ের শ্বাসকষ্ট রয়েছে। সে আর খেলতে পারবে না। ২০১৯ সালে নেহরু কাপে জুনিয়র বিভাগে রানার্স হয় দুড়িয়ার মেয়েরা। এর জন্য গত বছর কন্যাশ্রী দিবসের দিন বেলদা বিডিও অফিসে দুড়িয়ার মেয়েদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়। জুনিয়র দলের অধিনায়ক জাতীয় হকি খেলোয়াড় অরুণিমা জানার হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। প্রশিক্ষক অমিতাভের মোটর সাইকেল ফেরার পথে দুর্ঘটনায় ঘটে। অমিতাভের মাথা ফাটে। অরুণিমার ডান পা ভেঙে যায়। অস্ত্রোপচার করতে হয় অরুণিমার পায়ে। খরচ হয় প্রায় চার লক্ষ টাকা। কৃষক পরিবারের কাছে এই অর্থ অনেকটাই। বিভিন্ন আধিকারিক, স্থানীয় বিধায়কের কাছে আবেদন করেও কোনও আর্থিক সাহায্য পায়নি অরুণিমার পরিবার। অরুণিমার বাবা মিন্টু বলেন, ‘‘৪০ ডেসিমেল জমি বিক্রি করে চিকিৎসার খরচ মিটিয়েছি। একজন জাতীয় খেলোয়াড়ের এই দুর্দশা দেখে গ্রামের মেয়েরা হতাশ।’’

এখন করোনাভাইরাসের জন্য দু’মাস অনুশীলন বন্ধ রয়েছে। প্রশিক্ষক অমিতাভ পাল জানান, মেয়ে ও ছেলেদের ফিজিক্যাল ফিটনেস ধরে রাখার জন্য সকাল বিকেল শরীরচর্চা করতে বলা হয়েছে। দুড়িয়ার সুদেষ্ণা বেরার লক্ষ্য জাতীয় দলে খেলার। ফিটনেস ধরে রাখতে প্রতিদিন সকাল ও বিকেলে শরীরচর্চার পর বাড়ির সামনে, বাড়ির দেওয়ালে বল নিয়ে অনুশীলন করছেন, ড্রিবলিং করছেন। ২০১৩ সালে দুড়িয়া গ্রাম থেকে কবিতা ও শিউলি সিংহ প্রথম জাতীয়স্তরের খেলায় যোগ দিয়েছিলেন। এখনও হকি খেলা চালিয়ে যাচ্ছেন কবিতা। বর্তমানে তিনি হকির রেফারির প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। লকডাউনে সকাল ও বিকেলে বাড়ির সামনের মাঠে অনুশীলন করছেন।

লকডাউন পূর্ব ও পশ্চিমের দুই দলের সাফল্যে ছায়া ফেলবে না তো? প্রশ্ন অনেকের।

অন্য বিষয়গুলি:

Women's Hockey Team Midnapore
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy