প্রতীকী ছবি।
উত্তরপ্রদেশের রাজধানীর চেয়ে মাত্র ৬০ কিলোমিটার দুরের রায়বরেলির একটি হাসপাতালে এখনও মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন উন্নাওয়ের মেয়েটি। ও দিকে নরেন্দ্র মোদীকে রাখি পাঠাচ্ছেন তিন তালাক বিল পাশ হওয়ার পরে সুবিধাভোগী মুসলিম মেয়েরা।
এই মুহূর্তে মেয়েটি দিল্লির এইমস-এ চিকিৎসাধীন। তাঁর দোষ ছিল, তাঁর প্রতি হওয়া অবিচারের অত্যাচারের বিচার চেয়ে ক্ষমতাসীন দলের বিধায়কের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন। ধর্ষিত হওয়ার পর, দীর্ঘ দিন চুপ করে থাকার পর মেয়েটি অভিযোগ জানানোর সাহস সঞ্চয় করেন। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের বাড়ির সামনে নিজেকে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন এবং জানতে চান কেন বিধায়ক কুলদীপ সিংহ সেঙ্গারকে গ্রেফতার করা হবে না? তার পরেই নৃশংস ঘটনাটি সাধারণ মানুষের সামনে আসে। কিন্তু তার পর? ২৮ জুলাই, মেয়েটি তাঁর আইনজীবী, দুই আত্মীয়াসমেত গাড়ি করে যাচ্ছিলেন। সে সময়ে গাড়ি দুর্ঘটনা। এই দুর্ঘটনার পর দেশ জুড়ে আবারও প্রতিবাদের আওয়াজ ওঠে। বিজেপির তরফ থেকে জানানো হয় কুলদীপ সিংহ সেঙ্গারকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে।
যদিও এই মুহূর্তে এই বাহুবলি বিধায়ক জেলে আছেন, তবুও কী ভাবে যেন ওই ধর্ষিতা মেয়েটির বাবার উপর এই বিধায়কের ভাই আক্রমণ করেন এবং পুলিশ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার বদলে মেয়েটির বাবাকে তাঁদের হেফাজতে নিয়ে যায়। তার পর দিন মেয়েটির বাবা মারা যান। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এই বিষয়ে তদন্তের ভার সিবিআইকে দিলেও তদন্ত কোনও ভাবেই এগোচ্ছিল না। কিন্তু ওই গাড়ি ‘দুর্ঘটনা’র পর দেশের সর্বোচ্চ আদালত নির্দেশ দেয় আগামী ৪৫ দিনের মধ্যে এই তদন্ত শেষ করতে হবে।
কিন্তু তত দিন কি মেয়েটি বাঁচবেন? ওই মেয়েটি তাঁর উপর হওয়া অত্যাচার এবং অন্যায়ের বিচার পাবেন, এ কথা বিশ্বাস করতে মন চায় না। কারণ, ঘটনাচক্রে সেই ‘দুর্ঘটনা’র দিনেই আরও একটা ছবি এসেছিল, যে ছবিতে দেখা গিয়েছিল ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীকে বাহবা দিচ্ছেন যে তিনি নাকি দুষ্কৃতীদের ঠান্ডা করার জন্য এবং উত্তরপ্রদেশকে ভয়ভীতি মুক্ত করার জন্য যথেষ্ট কঠিন পদক্ষেপ করেছেন। এই ছবিটাই যদি মুখ্য হয় তা হলে আমাদের আশার কি কোনও ভিত্তি আছে? কী ভাবে আশা করব উন্নাওয়ের ধর্ষিতা এবং তাঁর অবশিষ্ট পরিবার সুবিচার পাবেন? কী ভাবে ভাবা হবে এই সরকার দেশের মেয়েদের জন্য ভাবছে?
উন্নাওয়ের ঘটনার সঙ্গে ‘বেটি বঁচাও, বেটি পড়াও’-এর কী সম্পর্ক? বা উন্নাওয়ের ঘটনার সঙ্গে তিন তালাকের কী সম্পর্ক?
গত বারের সরকারের সময়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেছিলেন যে তাঁরা মহিলাদের সুরক্ষার জন্য কাজ করতে চান এবং মহিলাদের সংখ্যা যাতে বাড়ে, তাই তিনি একটি প্রকল্প ঘোষণা করেন ‘বেটি বঁচাও বেটি পড়াও’। কিন্তু গত লোকসভা চলাকালীন জানা যায় যে এই প্রকল্পে সরকার যতটা খরচ করেছে কাজ করার উদ্দেশ্যে, তার প্রায় ৬০ শতাংশ খরচ হয়েছে নরেন্দ্র মোদীর মুখচ্ছবি-সহ বিভিন্ন মাধ্যমে বিজ্ঞাপনে। দেখা গিয়েছে, প্রায় ৩৬৪ কোটি টাকা শুধু এই বাবদ খরচ হয়েছে। এর পাশাপাশি কিছু দিন আগে আরও একটি চাঞ্চল্যকর খবর বেরিয়েছিল। তা হল— উত্তরাখণ্ডে গত ৩ মাসে ১৩২ গ্রামে ২১৬ জন শিশু জন্মগ্রহণ করেছে, যার মধ্যে একটিও কন্যাসন্তান নেই। ওই অঞ্চলের জেলাশাসক যদিও বলেছেন তিনি এই বিষয়ে খোঁজখবর করছেন। কিন্তু তা-ও এর কিছুটা অংশও যদি সত্যি হয়, তা হলে কি এটা বলার সময় হয়নি যে নরেন্দ্র মোদীর ওই স্বপ্নের প্রকল্প শুধুমাত্র তাঁর প্রচার ছাড়া আর কিছু নয়? তখন কি এটা বলা অনৈতিক হবে যে, কুলদীপ সিংহ সেঙ্গার কিংবা উন্নাও কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর পিছনে সঙ্ঘ পরিবারের মহিলাদের প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি, তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটছে?
এর পাশাপাশি আরও একটা বিষয়ের দিকে নজর দেওয়া জরুরি। ২৮ জুলাই এই ‘দুর্ঘটনা’ ঘটার ঠিক ২ দিন পর যা ভারতের সংসদে ঘটেছে। তিন তালাক আইন পাশ হয়েছে। এই বিল পাশ করানোর সময়ে মন্ত্রী রবি শঙ্কর প্রসাদ সংসদে জ্বালাময়ী বক্তব্য রেখে জানিয়েছেন যে, এত দিনে মুসলিম মহিলাদের ত্রাতা হিসেবে উঠে এসেছেন এক জন নেতা, তিনিই পারেন ওই মহিলাদের মুক্তি দিতে। এত দিন মুসলিম মহিলারা যথেষ্ট খারাপ ছিলেন, এর পর থেকে তাঁরা পরিত্রাণ পাবেন। তাৎক্ষণিক তিন তালাক নিষিদ্ধ এবং যে স্বামী এমন তালাকের দ্বারস্থ হবেন তার তিন বছর জেল হবে। মুসলিম পুরুষের জন্য এই ফৌজদারি আইন। কিন্তু যে কথাটা উনি সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছেন তা হল— ২০১১ সালের আদমসুমারি অনুযায়ী, এই দেশে স্বামী-পরিত্যক্তা (আইনগত ভাবে নয়) মহিলার সংখ্যা হল ২৩ লক্ষ ৭০ হাজার। তাঁরা কিন্তু আইনি ভাবে বিচ্ছিন্না নন। তাঁদের মধ্যে ১৯ লক্ষ হলেন হিন্দু এবং ২.৮ লক্ষ হলেন মুসলিম। ফলে দেখা যাচ্ছে, সব ধর্মের পুরুষেরা এমন অন্যায় সুযোগ নিয়ে থাকেন। যদি একে ফৌজদারি অপরাধ বলা হয়, তবে কেন সব ধর্মের মানুষের ক্ষেত্রে বলা হবে না? অনেকে বলতে পারেন, অন্য ধর্মে ‘তালাক তালাক তালাক’ বললেই তো বিচ্ছেদ হয় না, তা হলে তাদের কেন এই ফৌজদারি অপরাধের অন্তর্ভুক্ত করা হবে! এখানে মনে রাখা দরকার, ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যেও অগস্ট ২০১৭ থেকে তাৎক্ষণিক তিন তালাক আর নেই। কারণ সুপ্রিম কোর্ট তাকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। তা হলে কেন শুধু মুসলিম পুরুষের ক্ষেত্রে এই আইন? নানা ধর্মের বিপুল সংখ্যক নারী স্বামীর কাছে আইনি ভাবে বিচ্ছিন্না না হয়েও যাঁরা পরিত্যক্তা, তাঁরা কেন সুবিচার পাবেন না? কেন ওই স্বামীরা অপরাধী বলে গণ্য হবে না?
এই প্রসঙ্গের সঙ্গে উন্নাওয়ের ঘটনার কী সম্পর্ক— অনেকে জিগ্যেস করতে পারেন। তাঁদের জন্য কিছু কথা লেখার প্রয়োজন। সঙ্ঘ পরিবার, যার দ্বারা পরিচালিত আমাদের অধুনা সরকার। সেই প্রশাসন মহিলাদের সম্পর্কে কী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে? যে মনুস্মৃতিকে এই সঙ্ঘ পরিবার ভারতের সংবিধানের বিকল্প হিসেবে মান্যতা দেয় সেই মনুস্মৃতিতে কী বলা আছে? সেখানে প্রতি ছত্রে ছত্রে বলা আছে মহিলাদের প্রথম জীবনে আগলে রাখবে তাঁদের বাবা, পরবর্তী জীবনে স্বামী এবং শেষ জীবনে সন্তানেরা। যদি কোনও মহিলাকে তাঁর স্বামী মারধর করে তা হলে সেই মহিলার কী করা উচিত? তাঁর ভাবা উচিত যে আগের জন্মের পাপের প্রায়শ্চিত্য হচ্ছে। এই মানসিকতার প্রচার করার জন্যই মনুস্মৃতি দিয়ে ভারতীয় সংবিধানকে পাল্টাতে চাওয়া হয়। এই মানসিকতা নিয়েই ‘বেটি বঁচাও, বেটি পড়াও’এর প্রচার করা হয় আর এই মানসিকতা নিয়েই বেআইনি ভাবে কন্যাভ্রূণ হত্যাকে সমর্থন করা হয়। এই মানসিকতার কারণেই মনে করা হয় তিন তালাকের ফলে মুসলিম মহিলাদের পরিত্রাতা হয়ে উঠবে এই সরকার। কিন্তু যদি সত্যিই মহিলাদের উন্নয়নের কথা ভাবা হত, তা হলে সব ধর্মের জন্যই এই বিচ্ছেদ বিরোধী আইন পাশ করানো হত। যদি সত্যিই এই সরকার মহিলাদের কথা ভাবতেন তা হলে কি উন্নাওয়ের ঘটনা ঘটার এক বছর পরেও বাহুবলি বিধায়ককে দলে রেখে দেওয়া হত? কিংবা উন্নাওয়ের ঘটনার পরবর্তীতে যখন সেই অঞ্চলের সাংসদ সাক্ষী মহারাজ জেলে গিয়ে অভিযুক্ত বিধায়কের সঙ্গে দেখা করেন, তখন কি দলের তরফে তাঁর উপরে কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়? আসলে কখনও কোনও ভাবে শাসকদল দেখাতে চায় যে তাদের সাংসদ, বিধায়কেরা আলাদা। অর্থনৈতিক দুর্নীতিই কি একমাত্র দুর্নীতি? অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়াও কি এক ধরনের দুর্নীতি নয়?
চোখের সামনে যখন উন্নাও, কাঠুয়ার মতো ধর্ষণকারীর সমর্থনে মিছিল বেরোয়, তখন কি এটা বলা অত্যুক্তি যে প্রশাসনের এই ‘বেটি বঁচাও’ বা তিন তালাক অর্ডিন্যান্স পাশ আসলে ভাঁওতা ছাড়া কিছুই নয়।
এই মুহূর্তে তো আবার চারদিকে জাতীয়তাবাদী আস্ফালন চলছে— ‘‘আমরাই কাশ্মীরের জনগণের পরিত্রাতা’’। এই আওয়াজ আকাশে বাতাসে। এর মধ্যে কি উন্নাওয়ের মেয়েটি সুবিচার পাবেন? না কি উচ্চকিত আওয়াজের মধ্যে ঢাকা পড়বে ওই মেয়েটির কান্না? কাশ্মীরে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল হয়ে যাওয়ার পরে যে ভাবে কাশ্মীরি মহিলাদের নিয়ে চর্চা হচ্ছে, সমাজে যেভাবে ইসলামোফোবিয়ার চাষ হচ্ছে, সেখানে এই আশঙ্কা কি খুব অমূলক?
লেখক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুকার
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy