Advertisement
E-Paper

জন্মনিয়ন্ত্রণের যাবতীয় দায় সেই মেয়েদেরই!

আমাদের দেশে ক’জন পুরুষ বিশ্বাস করেন, তাঁর স্ত্রীর শরীর সংক্রান্ত বিষয়ে যে কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাঁর এক্তিয়ারে নেই!

জিনাত রেহেনা ইসলাম

শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৯ ০৩:১০
Share
Save

রুবিনার চার মেয়ে। স্বামী মুম্বইয়ে সোনার দোকানে কাজ করেন। রুবিনা বলছেন, ‘‘বাড়িতে অভাব। তার উপরে চার সন্তান। খুব টানাটানি করে চলছে, জানেন!’’ স্বামী ভ্যাসেক্টমি করাননি কেন? রুবিনা অবাক, ‘‘এ আবার কেমন কথা! পুরুষ মানুষ। খেটে খায়। ও সব করালে যদি শরীরের ক্ষমতা কমে যায়!’’ এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্মী আবার স্ত্রীর প্রশংসা করে বলছেন, ‘‘আমার ওয়াইফ খুব প্রোগ্রেসিভ, বুঝলেন! নিজেই টিউবেক্টমি করিয়ে নিয়েছে।’’ আপনি কেন ভ্যাসেক্টমি করাননি? জবাব এল, ‘‘আরে, আমাদের তো বাইরে বাইরে ঘুরতে হয়।’’

অদ্ভুত একপেশে প্রশ্রয়ের আদলে এই সমাজ এবং সম্পর্ক নির্মাণ। নারী-পুরুষের অর্ধেক আকাশের সীমানা বরাবর অধিকার ভাগাভাগি। তবুও প্রাপ্য সুবিধা ও যাপনের ইতিবৃত্তে তুমুল ফারাক। বাড়ির ছেলের ঝুলিতে পৌরুষের গৌরব। আর গর্ভধারণের ঐশ্বরিক ক্ষমতা মেয়েদের। সেই সন্তানের জন্ম দেয়। আবার জন্মনিয়ন্ত্রণেরও দায় ও দায়িত্ব তার উপরেই বর্তায়।

সম্প্রতি অসমের ‘টু চাইল্ড পলিসি’ এই ‘দ্বন্দ্ব’কে আরও উস্কে দিচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে দেশ-রাজ্য, স্বাস্থ্য দফতর কর্তৃক প্রচারিত ও নির্দেশিত পিল, আইইউডি, বন্ধ্যাকরণের যাবতীয় উপায়ের প্রয়োগ মহিলাদের শরীরকেন্দ্রিক। প্রায় সব উন্নয়নশীল দেশে পরিবার পরিকল্পনার তালিকায় জনপ্রিয় মেয়েদের বন্ধ্যাকরণ। অথচ বিরাট সংখ্যক পুরুষ থাকে এই পদ্ধতি প্রয়োগের

সম্পূর্ণ বাইরে।

স্বাধীনতার কয়েক বছর পরেই ভারত বিশ্বকে চমকে দেয় পরিবার পরিকল্পনা প্রথম চালু করে। কিন্তু অনুসারী বিশ্বের অন্য দেশের মতোই ভারতীয় পরিবার পরিকল্পনার ‘ফেমিনাইজেশন’ হয়ে যায়। বন্ধ্যাকরণে মেয়েদের অগ্রাধিকার না চাইতেই দিয়ে দেওয়া হয়। দেশে কনডোমকে এত বিজ্ঞাপিত করেও জনপ্রিয় করে তোলা গেল না। শেষ প্রকাশিত তথ্যানুসারে মাত্র ৫.৬ শতাংশ পুরুষ কনডোম ব্যবহার করে। অন্য দিকে, পুরুষের বন্ধ্যাকরণের স্থায়ী পদ্ধতি ভ্যাসেক্টমির জনপ্রিয়তা বাড়াতে চালু করা হয়েছিল ভ্যাসেক্টমি সপ্তাহ। সেখানেও মাত্র ০.৩ শতাংশ পুরুষ এর আওতায় এসেছে।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক প্রকাশিত স্থায়ী বন্ধ্যাকরণে পুরুষ ও মহিলার অনুপাত ১:৫২। রাজ্যে জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য জরিপে শেষ প্রকাশিত তথ্যে ভ্যাসেক্টমি করানো হয় চার হাজার দুশো একষট্টি জন পুরুষের। আর টিউবেক্টমি করানো হয় এক লক্ষ পঁচাশি হাজার সাতশো তেত্রিশ জন মহিলার। মেয়েদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বন্ধ্যাকরণ করা হলেও কেন পুরুষদের কাছে এটা জরুরি করে তোলা হল না সেই সর্ষের মধ্যে ভূত খুঁজতে বাধ্য করবে আগামীর ‘টু চাইল্ড পলিসি’।

তামাম দেশের নানা পরিসংখ্যান জানান দিচ্ছে, প্রায় ৯০ শতাংশ শিক্ষিত মহিলা পরিবার পরিকল্পনার বিষয়ে স্বামীর সঙ্গে আলোচনা করেন। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন মাত্র ১৮ থেকে ২০ শতাংশ মহিলা। এখনও প্রত্যন্ত গ্রামের যে মেয়েরা স্বামীর ভালবাসা বলতে সহবাস বোঝেন, তাঁদের কাছে ‘টু চাইল্ড পলিসি’ মারাত্মক। প্রজনন সচেতনতা বলতে এখনও মেয়েদের ফার্টিলিটির সময় নির্ধারণের মানদণ্ড ঋতুচক্রের ক্যালেন্ডার হিসেব। বাকিটা মেয়েদের উপরেই ছেড়ে দেওয়া হয়। অস্থায়ী জরুরি অবস্থায় থাকে পিল। যার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া সয়ে ঘর-দোর সামাল দিতে হয় সেই মেয়েদেরই। ফলে এটা স্পষ্ট যে, ‘টু চাইল্ড পলিসি’ অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনিয়ন্ত্রিত গর্ভপাত বাড়াবে। মেয়েদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরিসর খর্ব করবে। বাড়বে

শরীরের ধকল।

এই পলিসি গ্রহণের দ্বাদশতম রাজ্য হতে চলেছে অসম। ‘হাম দো, হামারা দো’ দেওয়াল লিখন আগেই রুটি-রুজি প্রায় বন্ধ করেছে হিজড়েদের। বিবাহিত দম্পতির মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। ছত্তীসগঢ় আইন প্রয়োগের চার বছরের মধ্যেই পিছু হটেছে। আসন্ন ২০২০ পরিবার পরিকল্পনার পূর্ব শর্তানুসারে ভারতে বিপুল সংখ্যায় মেয়েদের আধুনিক পদ্ধতিতে জন্মনিয়ন্ত্রণের আওতায় আনা হবে। মেয়েদের সুবিধা ও প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে মতামতেরও নাকি মূল্য দেওয়া হবে! তবে তো স্ববিরোধিতা অনিবার্য। এক দিকে এই পলিসির জন্য মেয়েরা সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পাবেন না। উপরন্তু স্বামীর নির্বাচনে লড়াই ও সরকারি চাকরি টেকাতে ফল ভুগতে হবে স্ত্রীকে। নইলে জবরদস্তি গর্ভপাতের শিকার হতে হবে। সরকারি চাকরিতে মেয়েদের সংখ্যা কমতে থাকবে। লিঙ্গ নির্ধারণের বাজারও চাঙ্গা হয়ে উঠবে। কন্যাসন্তানের সংখ্যা কমতে থাকবে। অন্য দিকে গর্ভপাত পরিবার পরিকল্পনার একটি বিষয় হিসাবে বিবেচিত হবে। এবং ‘টু চাইল্ড পলিসি’ মেয়েদের উপরেই এই অভিশাপ এনে দেবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে শুরু করে গ্রামের রুবিনাও মেনে নিয়েছেন, জন্মনিয়ন্ত্রের পদ্ধতি ও প্রয়োগ সবটাই মহিলার ঘাড়েই বর্তায়। সন্তান আসলে বৈবাহিক সুরক্ষা কবচ। অনেক ক্ষেত্রেই এক জন মহিলা সন্তান জন্মানোর পরে স্বামীর কাছে জানতে পারেন ডাক্তারের পরামর্শে তাঁর বন্ধ্যাকরণ সম্পন্ন হয়েছে। আমাদের দেশে ক’জন পুরুষ বিশ্বাস করেন, তাঁর স্ত্রীর শরীর বা শরীর সংক্রান্ত বিষয়ে যে কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাঁর এক্তিয়ারে নেই! তাই গর্ভপাত ও গর্ভধারণ সাধারণত নিয়ন্ত্রণ করে পুরুষেরা। মেয়েদের ভূমিকা প্রায় নিষ্ক্রিয়। পলিসির জালে তা আরও প্রসারিত হবে।

বংশরক্ষার ধারক মেয়েই জানে না ছাদ-বারান্দা-রান্নাঘরের বাইরে তার নিজের আলাদা অস্তিত্ব আছে। শরীরের নিরাপত্তা ও নিরাপদ যৌন জীবনের ভাষা আছে। মেয়েদের শিক্ষার হারের সঙ্গে জুড়ে আছে মহিলার গর্ভধারণের বিষয়। জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য জরিপ জানান দিচ্ছে, আমাদের রাজ্যে স্নাতক মেয়েদের ক্ষেত্রে ফার্টিলিটি রেট ৩৫.২ শতাংশ। শিক্ষার আঙিনায় যাদের পা পড়েনি সেই মেয়েদের ক্ষেত্রে ফার্টিলিটি রেট ৫১.১ শতাংশ! অর্থাৎ শিক্ষিত মেয়েরা পরিবারের পুরুষদের বোঝানোর দায়টা সামান্য হলেও নিতে পারে। এটাই প্রত্যাশিত। তাই ‘টু চাইল্ড পলিসি’ সফল হওয়ার প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে মেয়েদের শিক্ষা ও প্রজনন সচেতনতা বৃদ্ধি এবং পুরুষদের বন্ধ্যাকরণের আওতায় নিয়ে আসা।

কঙ্গো, নাইজেরিয়ায় মেয়েরা পিল কম ব্যবহার করে। কানাডায় পুরুষদের ভ্যাসেক্টমির হার বেশি। লিবিয়া, সুদানের মতো দেশের মেয়েরা নিজেদের অধিকারের জন্য রাস্তায় নামতে শেখেনি। তাই মিডিয়া ও স্বাস্থ্য দফতরের আরও দায়িত্ব নেওয়া উচিত। আমেরিকার মতো দেশেও স্বাস্থ্য বিমা পরিকল্পনার মধ্যে গর্ভনিরোধক পরিষেবা স্পষ্ট থাকা দরকার। বন্ধ্যাকরণে পুরুষ নিজের বদলে স্ত্রীকে কেন নিরাপদ মনে করেছে সেই মনোভাবও যাচাই করা দরকার।

‘টু চাইল্ড পলিসি’ গ্রহণের আগে জন্মনিয়ন্ত্রণে মহিলা-পুরুষের সমান দায়িত্ব-কর্তব্য নিয়ে কার্যকর সিদ্ধান্ত প্রয়োজন এবং তা অমান্যের ক্ষেত্রে সরকারি বিধিবিদ্ধ সতর্কীকরণও থাকা জরুরি। নিয়মের প্রতি আনুগত্য তখনই জন্মায় যখন তা সমান ভাবে সকলের আস্থা অর্জন করে। সরকারের সঙ্গে ‘জন’-এর বিশ্বাসের কথাই গণতন্ত্র বলে। তাই ‘টু চাইল্ড পলিসি’কে আগে জনগণের ইচ্ছায় রূপান্তরিত করতে হবে। তার পরেই আইন বলবৎ প্রসঙ্গ।

লেখিকা: শিক্ষিকা, রঘুনাথগঞ্জ হাইস্কুল

Birth Control Child Birth Woman Empowerment

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।