প্রণব মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণে এক নিকট জনকে হারালাম। তাঁর সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, রাজনীতির জগতের বাইরে।
প্রণববাবুর মূল লক্ষ্য ছিল দেশ সেবা, সেই জন্যই রাজনীতিতে আসা। আমাদের আদি বাড়ি কান্দি ওঁর বীরভূমের বাড়ির কাছেই। সেই থেকেই সম্পর্ক। আমার অগ্রজ প্রয়াত অতীশের সঙ্গে ওঁর যোগাযোগ বহু দিনের, রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে। আমার সঙ্গে অন্তরঙ্গ পরিচিতি বৃন্দাবনের লালাবাবুর মন্দিরে এক উৎসব উপলক্ষে। লালাবাবু আমাদের পরিবারের মহাপুরুষ, পরম বৈষ্ণব। পরের জীবনে বৃন্দাবন তথা গোবর্ধনে বৈষ্ণব ভিক্ষুর জীবনযাপন করতেন।
যত দূর মনে পড়ে, প্রণববাবু তখন মন্ত্রকহীন মন্ত্রী। আমার দুই অগ্রজ, অতীশ ও অধীশ হিন্দিতে বক্তৃতা দিল। আমি বাংলায় বললাম। পাশেই প্রণববাবু, মুচকি হাসলেন। প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তৃতা দিতে উঠলেন, ভাষাটা চলতি বাংলা। রাজনীতির ধার দিয়ে গেলেন না, বৈষ্ণব পদাবলির মাহাত্ম্য এবং মন্দিরের অপূর্ব স্থাপত্য নিয়ে সুগভীর ও সাবলীল বক্তৃতা দিলেন। বৃন্দাবনবাসী বাঙালি ‘সাধু সাধু’ বলে ‘জয় কৃষ্ণচন্দ্র জয় কৃষ্ণচন্দ্র’ ধ্বনিতে নাট্যমন্দির মুখর করলেন। মন্দিরে বাসস্থান নেহাতই মামুলি, সেখানে রাখা একমাত্র আস্ত চেয়ারটায় ওঁকে বসানো হল, পরম শান্তিতে পাইপে তামাক সেবন করতে লাগলেন। দু’জন অবাঙালি কলাকৌশলে রাজনীতির প্রসঙ্গ তুলতে চাইছিলেন, প্রণববাবু দূরে তাকিয়ে তামাক সেবন করতেই থাকলেন, মুখে কথা নেই। পরে হিন্দিতে বললেন, “দেখুন এটা পবিত্র লালাবাবুর মন্দির, এখানে কৃষ্ণচন্দ্রের পূজা হয়, কেন রাজনীতি আলোচনা করবেন বলুন তো!”
সেই থেকেই ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ। আদি অকৃত্রিম বাঙালি মানুষটি তৃপ্তি করে খেলেন বৈষ্ণব বাড়ির নিরামিষ খাবার, বৃন্দাবনের বিখ্যাত ছোট্ট ভাঁড়ের সন্দেশ চাঁচি, সাদা মিষ্টি দই। সঙ্গে ভাত, লুচি, উত্তর ভারতের ডাল, বাঙালির সাধের রসা। আমার ভাড়া করা গাড়ি নিয়ে ওঁর কনভয়ের পিছু পিছু দিল্লি রওনা হলাম। ওঁর বাড়ি পর্যন্ত গেলাম। উনি বললেন, “আপনার এত দূরে আসার তো দরকার ছিল না!” মৃদু হেসে বিদায় নিলাম।
তার পর বহু বার ওঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে। কলকাতায়, দিল্লিতে। আর এক বার কল্পক্কামে অ্যাটমিক এনার্জির এক গবেষণাগারে। উনি তখন প্রতিরক্ষামন্ত্রী, একটি বিশেষ জলবাহন পরিদর্শন করতে কল্পক্কামে এসেছিলেন। কলকাতায় আমাদের ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টার (ভিইসিসি)-এর কথা শুনে বললেন, “আমি এক বার যাবখন।” সে সুযোগ অবশ্য আর হল না।
কলকাতায় এক বার এলেন ‘রবীন্দ্রনাথ টেগোর সেন্টার’-এ। তখন নিউক্লিয়ার সাপ্লাই গ্রুপ নিয়ে খুব আলোচনা চলছে। তার আগেই এক বার এই ব্যাপারে দিল্লিতে আমার তলব পড়েছিল। আমি তখন জুনিয়র। কিন্তু প্রণববাবু বললেন, “আমার ধারণা, আপনি কারও হয়ে মত দেবেন না। আপনার নিজস্ব মত দেবেন, সেই জন্যেই আপনাকে ডেকেছি।” জানালাম, এনএসজি-তে যোগ দেওয়া যথেষ্ট প্রয়োজন, না হলে আমাদের নিউক্লিয়ার প্রোগ্রাম বন্ধ হয়ে যাবে, কিংবা শ্লথ গতিতে চলবে। রবীন্দ্রনাথ টেগোর সেন্টারে প্রণববাবু সেই কথা বলে দিলেন। আগে আমার একটা ছোট ভাষণ ছিল, ইংরেজিতে। প্রণববাবু বাংলায় বললেন। গুছিয়ে, সরল করে। আমার কথাও বললেন। আসলে, বয়স বা সিনিয়রটি নয়, তাঁর কাছে সত্যই সব।
রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে প্রণববাবুর সঙ্গে আরও ঘন ঘন দেখা হত। দিল্লি গেলেই ওঁর সঙ্গে দেখা করতে রাষ্ট্রপতি ভবনে যেতাম। কত রকম আলোচনা। এক দিন আমি জিজ্ঞেস করে বসলাম, রাষ্ট্রপতি হওয়ার জন্য আপনাকে কী করতে হয়েছিল! উৎসাহের সঙ্গে বুঝিয়ে দিলেন। হয়তো খবর এল যে, আর এক অতিথি এসে গিয়েছেন, তাঁকে অপেক্ষা করাতে বললেন। তাঁর সঙ্গে আমার এমনই অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
মনে আছে, বিশ্বভারতী নিয়ে অনেক আলোচনা হত। উনি একমত ছিলেন— বিশ্বভারতীকে আজকের যুগের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ঢেলে সাজতে হবে। যদিও হেসে বলতেন, “কে কী শুনবে?” এক বার বিশ্বভারতীতেও দেখা হয়েছিল, উনি কোনও কাজে এসেছিলেন। মধ্যাহ্নভোজনে রাষ্ট্রপতির খুব কাছেই আমার বসার জায়গা। প্রণববাবু হঠাৎ বললেন, “আপনাদের বৃন্দাবন মন্দিরে ওটা রসা ছিল না চচ্চড়ি ছিল?” আমি তো অবাক! বললাম: রসা। উনি জানতে চাইলেন, “তা হলে এটা কী?” আমি বললাম, না রসা, না চচ্চড়ি! বললেন, “ঠিক বলেছেন।”
শেষ বার দেখা হয়েছিল বোস ইনস্টিটিউটের শতবর্ষ উপলক্ষে। শেষ অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি বক্তৃতা দিতে উঠেছেন, আমরাও উঠেছি, বসার সঙ্গে সঙ্গে আমার কাছে এলেন। আমি উঠতে যাচ্ছি, উনি বসতে বললেন। রাষ্ট্রপতি দাঁড়িয়ে, আর আমি বসে! খুব অস্বস্তি হচ্ছিল।
এমন প্রাণোচ্ছল এক ব্যক্তি চলে গেলেন, অনেক কাজ বাকি রেখেই। এমন মানুষ কি আর কখনও পাবে বাংলা, ভারত?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy