Advertisement
E-Paper

আপনি আচরি ধর্ম...

প্রশ্নটা কেবল শাসক দলের নেতার নারী-বিরোধী আচরণ নিয়ে নয়। হিন্দুসমাজে, বিশেষ করে গো-বলয়ে নারীস্বাধীনতার স্বরূপ খতিয়ে দেখাও জরুরি।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

পার্থ সারথি

শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:১০
Share
Save

বড় অদ্ভুত সময়ে আমরা বাস করছি। যে কেন্দ্রীয় সরকার নারী-অধিকারবিরোধী তিন তালাককে শাস্তিযোগ্য অপরাধ সাব্যস্ত করে আইন এনেছে, সেই সরকারেরই চালক অর্থাৎ প্রধান শাসক দলের বিভিন্ন নেতার বিরুদ্ধে ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের অভিযোগ উঠছে। বিচার দূর অস্ত্, শাসক-নেতাদের বিরুদ্ধে আঙুল তোলার দুঃসাহস দেখানোয় নির্যাতিতাদের পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর ‘অপরাধ’-এ আক্রান্ত হচ্ছেন পরিজনরা, মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন আইনজীবীরা।

এ দেশে যাঁদের হাতে সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা আছে, তাঁরা অনেকেই যে কোনও মূল্যে ঈপ্সিত নারীর ওপর দখল কায়েম করতে চান, তাঁকে ভোগ করতে চান। মধ্যযুগীয় এই সামন্ত-সংস্কৃতির উত্তরাধিকার আজও ভারতের, বিশেষত উত্তর ভারতের অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রবল। নিচু জাত ও দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা এঁদের লালসার শিকার হন প্রতি দিন। এই পরিপ্রেক্ষিতে একটি পরিসংখ্যান তাৎপর্যপূর্ণ। অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্ম (এডিআর) ভারতের সকল বিধায়ক ও সাংসদের নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রদত্ত তথ্য বিচার করে দেখেছে, মোট ৪৮৪৫ জন জনপ্রতিনিধির মধ্যে ১৫৮০ জনই (৩৩ শতাংশ) কোনও না কোনও হিংসাত্মক ঘটনায় অভিযুক্ত। এঁদের মধ্যে নারী-নিগ্রহে অভিযুক্ত ৪৮ জন, যাঁদের মধ্যে বিজেপির নেতার সংখ্যা ১২। বিগত নির্বাচনগুলোতে স্বীকৃত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থী পদ পেয়েছিলেন এমন ৩২৭ জনের বিরুদ্ধে নারীনিগ্রহের অভিযোগ ছিল। তাঁদের মধ্যে বিজেপির প্রার্থীর সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি, ৪৭।

কিন্তু প্রশ্নটা কেবল শাসক দলের নেতার নারী-বিরোধী আচরণ নিয়ে নয়। হিন্দুসমাজে, বিশেষ করে গো-বলয়ে নারীস্বাধীনতার স্বরূপ খতিয়ে দেখাও জরুরি। জরুরি অন্য ধর্মের অনুসারীদের দিকে আঙুল তোলার সঙ্গে নিজের সমাজে নারীর অবস্থান বিচার করা। প্রথমত মনে রাখতে হবে, মনুর বিধানে নারীকে শুধুমাত্র বাল্যে পিতা, যৌবনে স্বামী আর বার্ধক্যে সন্তানের অধীনে রাখার কথাই বলা হয়নি, অসৎ লম্পট নির্গুণ স্বামীকেও দেবতারূপে পূজার কথা বলা হয়েছে। বিষ্ণু-স্মৃতির বচন অনুযায়ী, ‘স্বামী ভিন্ন স্ত্রীগণের যজ্ঞ নাই, উপবাস নাই, ব্রত নাই; স্বামীসেবা দ্বারাই স্বর্গপুরে ধন্য হয় নারী।’

বস্তুত, হিন্দুসমাজে নারী এক দিকে পরিবারের বোঝা, অন্য দিকে ভোগ্যবস্তু। আজও পরিবারে পুত্রসন্তান এলে যে আনন্দের পরিবেশ ফুটে ওঠে, কন্যাসন্তানের ক্ষেত্রে সচরাচর তা হয় না। সে অবাঞ্ছিত, হিন্দুভারত থেকে মেয়েরা হারিয়ে যায় নিঃশব্দে, এমনকি জন্মগ্রহণের আগেই। সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ভারতে এমন ‘হারিয়ে যাওয়া কন্যা’র সংখ্যা ৬ কোটি ৩০ লক্ষ। সর্বভারতীয় স্তরে প্রতি ১০০০ জন পুত্রসন্তান পিছু কন্যাসন্তান জন্মানোর হার ছিল ৯৪০, জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা (২০১৫-১৬) অনুযায়ী তা কমে হয়েছে ৯১৯। এব‌ং উত্তর ভারতে এই হার সবচেয়ে কম, প্রতি হাজার পুত্রসন্তান পিছু মাত্র ৮৮৫। এই তথ্যই বলে দেয়, হিন্দুভারতে নারীর অবস্থান কোথায়।

পছন্দমতো সঙ্গী নির্বাচন ব্যক্তিস্বাধীনতার ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এই অধিকার যে সমাজ স্বীকার করে না, তারা কী ভাবে নারীর ক্ষমতায়ন করে? যোগী আদিত্যনাথ শাসিত উত্তরপ্রদেশে অ্যান্টি-রোমিয়ো স্কোয়াড তৈরি হয়েছে, খোলা রাস্তায়, পার্কে বা নদীতীরে প্রেমিক যুগলকে হেনস্থার লাইসেন্স তুলে দেওয়া হয়েছে পুলিশ ও গেরুয়া বাহিনীর হাতে। পাশাপাশি ‘অনার কিলিং’ও লক্ষণীয় ভাবে বেড়েছে। ২০১৪ সালে এমন ঘটনায় মৃত্যুর পরিমাণ ছিল ২৮, পরবর্তী তিন বছরে তা বেড়ে হয় ৩৫৬। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এর শিকার মেয়েরা। ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে যত অনার কিলিং-এর ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে উত্তরপ্রদেশ (১৪৮), দ্বিতীয় মধ্যপ্রদেশ (৩৯), তৃতীয় গুজরাত (৩০)। স্পষ্টত হিন্দি বলয়ের রাজ্যগুলোতেই এমন ঘটনার মাত্রা সর্বাধিক।

তিন তালাক বাতিল করার আইন পাশ করিয়ে বিজেপি সরকার অনেক গর্ব করেছে। অমিত শাহ বলেছেন, মোদীজি নারী-মুক্তির কান্ডারি, সমাজ-সংস্কারক, রামমোহন রায়, গাঁধীজি বা অম্বেডকরের পাশেই যাঁর স্থান পাওয়া উচিত। প্রশ্ন হল: সমাজসংস্কারের কাজটা নিজের সমাজেও শুরু করা দরকার নয় কি? দেশ জুড়ে, বিশেষত হিন্দুসমাজে, আরও বিশেষত বিজেপি শাসিত হিন্দি বলয়ে নারী-বিপন্নতার এই আবহে শুধুমাত্র মুসলিম নারীর প্রতি অবিচার নিয়ে হিন্দুত্ববাদী শাসকদের চোখের জল ফেলাটা কতটা যুক্তিযুক্ত? প্রশ্ন থেকেই যায়।

BJP Swami Chinmayanand Kuldeep Singh Sengar

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}