তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন। —ফাইল ছবি
১৯৬৭ সালে ভারতে কুইজের প্রচলন করেন আমার বাবা নিল ও’ব্রায়েন, তাঁকেই যদি জি়জ্ঞাসা করা হত প্রিয় বিষয় কী? তিনি হয়তো জবাব দিতেন, হেভিওয়েট বক্সিং আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। শুনতে বিচিত্র মনে হলেও এটাই সত্যি। আমরা রাতে ঘুমতে যেতাম ওই গল্প শুনেই। হ্যানসেল গ্রেটেল নয়।
গত মাসে, সংসদে আমার বক্তৃতায় কেন বিজেপির ‘নতুন ভারত’-এর সঙ্গে হিটলারের জার্মানির তুলনা টেনেছি, তা আপনারা জানেন। যে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) ওঁরা এনেছেন, এবং তার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত জাতীয় নাগরিকত্ব রেজিস্টার-জাতীয় জনসংখ্যা রেজিস্টারের (এনআরসি-এনপিআর) কথা বলছেন, সেগুলোর সঙ্গে কি নাৎসি জমানার মিল পাওয়া যাচ্ছে না? সাযুজ্যগুলো কিন্তু মারাত্মক।
এক, ১৯৩৩ সালে ইহুদিদের জন্য প্রথম নাৎসি কনসেট্রেশন ক্যাম্প তৈরি হয় জার্মানিতে। আর, ২০১৮-য় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক অসমে অ-ভারতীয়দের জন্য তৈরি করল ডিটেনশন ক্যম্প।
দুই, ১৯৩৫-এর জার্মানিতে নিজেদের আর্য পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে হলে ‘অ্যানসেস্টর পাশ’ দেখাতে হত। আবার ২০১৯-এর ভারতের দিকে তাকান, এ বার নাকি একফালি কাগজ হবে আপনার নাগরিকত্বের প্রমাণ!
তিন, জার্মানরা বলে ‘গ্রওসা’। মানে, বিশাল মিথ্যা। জার্মানদের বিশ্বাস করানো হয়েছিল ইহুদিরা তাদের জাতির পক্ষে বিপজ্জনক। আর আজকের বড় মিথ্যাটা কী? ভারত ২৪x৭ বিপদের সম্মুখীন।
চার, জার্মানিতেও প্রচার চালানোর জন্য মিথ্যা বলানো হত সংবাদপত্রগুলিকে দিয়ে। ওরা বলে লুনপ্যাসা। আজ ভারতেও সেই লুনপ্যাসা। ফেক নিউজের রমরমা। বিজেপির বিভাজনমূলক বিভিন্ন ইস্যুর পক্ষে প্রচার চালানোর জন্য মূল ধারার টেলিভিশন এবং সংবাদপত্রের মালিকদের উপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে।
নরেন্দ্র মোদী-আমিত শাহ অথবা Mo-Sh (কপিরাইট আছে কিন্তু!) সরকার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার ব্যাপারে খুব দক্ষ। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করায় তারা আরও দড়। আমরা আসলে খুব সহজে ভুলে যাই তো! প্রধানমন্ত্রী জনসমক্ষে কি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন? নোটবন্দির ফলে যে ভয়াবহ সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল দেশ, তা ৫০ দিনের মধ্যেই সমাধান হয়ে যাবে। বলেছিলেন, ‘‘তার পর আমাকে সর্বসমক্ষে ফাঁসিকাঠে ঝোলাবেন। আমি শুধু ৫০ দিন চেয়ে নিচ্ছি।’’ এখন ব্যর্থতা এমন পর্বতপ্রমাণ হয়ে উঠল, যে তার পর থেকে গত দু’বছরে একবারও ওই শব্দটাই মুখে আনেননি তিনি।
গত বছর এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘‘চৌকিদার কি পঞ্চবর্ষ কি চৌকিদারি মে কোই বড়া ধামাকা হুয়া কেয়া?’’(এই চৌকিদারের চৌকিদারিতে পাঁচ বছরে কোনও হামলা হয়েছে?) আরেকটা প্রতিশ্রুতিভঙ্গের উদাহরণ। ২০১৪-২০১৮ সালের মধ্যে ৩৮৮টি জঙ্গি হামলা হয়েছে। ২০১৮ সালে কাশ্মীরে জঙ্গি তৎপরতায় ৪৫১ জন মারা গিয়েছেন। এই দশকে সর্বাধিক।
গত মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে ঘোষণা করলেন,সারা দেশে সরকার এনআরসি কার্যকর করবে। আরও অন্তত দু’জন মন্ত্রী সংসদের দুই কক্ষে একই কথা বললেন। সিএএ-এনপিআর-এনআরসি যে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত সেই সংক্রান্ত বহু নথি এখন রয়েছে সকলের সামনে। তিন বছর ধরে সিএএ সংক্রান্ত যৌথ সংসদীয় কমিটির সদস্য এখন রেগে উঠবেন, না মজা পাবেন বুঝে উঠতে পারছেন না, যখন দেখেন মোদী এবং অমিত শাহ ড্যামেজ কন্ট্রোলে নেমে বলছেন, এগুলি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত নয়। এটা সত্যি নয়।
একটা ব্যর্থ পাইলট প্রজেক্টকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করার প্রয়াস দেখে কোনও অনভিজ্ঞ মার্কেটিং ম্যানেজারও হাসবেন। হ্যাঁ, পাইলট প্রজেক্টটি চূড়ান্ত ব্যর্থ। অসমে এনআরসি তালিকায় ৭ শতাংশ রাজ্যবাসীর নাম বাদ পড়েছে। ভেবে দেখুন গোটা দেশের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। প্রায় ১০ কোটি মানুষ দোশহীন হয়ে পড়বেন। এই প্রক্রিয়ায় যে বিপুল মানসম্পদের ক্ষতি হবে সরকার তা কী ভাবে পূরণ করবে ভাবা হয়েছে?
তৃণমূল কংগ্রেস এই বিপর্যয়ের হিসাব করার চেষ্টা করেছে। জেপিসিতে তা জমাও দিয়েছে। সেই অনুমান প্রকৃত সংখ্যার খুব কাছাকাছি। কমিটির নথিপত্রেই যে শুধু আমাদের বিরোধিতার কথা লেখা রয়েছে, তা নয়। তৃণমূলের দুই সাংসদ এর বিরোধিতা করে নোটও দিয়েছিলেন। পরিণতি কথা আমরা আগেই বলেছিলাম।
তারপর, যে এক কোটি মানুষ পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসেছেন তাদের কী হবে? ১৯৭০ এ তো তাঁরা ধর্মীয় কারণে এদেশে আসেননি। এসেছিলেন ভাষাগত কারণে। এ তো নথিভূক্তই রয়েছে। কিংবা ধরুন মতুয়াদের কথা, বাঙালি হিন্দু কয়েক দশক ধরে যারা ভোট দিয়ে আসছেন। শুধু ভোট দেওয়াই নয়, ২০১১ সালে এঁদের একজন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দফতরের মন্ত্রীও হন। আপনি ওঁদের নাগরিকত্ব দিচ্ছেন? সে তো আগে থেকেই রয়েছে।
সব শেষে, নোটবন্দির মতোই সিএএ-এনআরসি-এনপিআর শেষ পর্যন্ত গরিব-বড়লোকের ফারাকটাকেই বড় করে তুলবে। কোনও কোটিপতিকে কি দেখেছেন নোটবন্দির লাইনে? ওই সময় যে ১৩০ জনের মৃত্যু হয়েছিল তাঁদের মধ্যেও ক’জন লাখপতি ছিলেন? এই দায়িত্বজ্ঞানহীন আইনে দরিদ্র এবং প্রান্তিক মানুষরাই আরও একবার সবচেয়ে বেশি সমস্যার মুখোমুখি হবেন। এখন সামাজিক ভাবে যাঁরা বঞ্চিত, তাঁরা ভুগবেন বেশি। কেউ বন্যায়, কেউ দাঙ্গায় নথিপত্র হারিয়েছেন। এমনকি, এর মধ্যেও অনেকে রয়েছেন যাঁরা এই দেশেরই নাগরিক, অথচ কোনওদিনই তাঁদের কোনও নথি ছিল না।
২০০৬ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২৬দিন ধরে অনশন করেছিলেন কৃষকদের জমির অধিকারের জন্য। ২০২০ সালে সাধারণ নাগরিক, ছাত্ররা সিএএ-র বিরুদ্ধে গণআন্দোলন শুরু করেছেন। মমতার মতো জননেত্রী, যিনি প্রথম দিন থেকেই পথে নেমেছেন, খুশি হবেন এই আন্দোলনে অনুঘটকের ভূমিকাটুকু পালন করতে পারলে। এটা নিছক একটা আন্দোলন নয়। প্রকৃত পক্ষেই এটা গণআন্দোলন ভারত নামক একটা ধারণাকে রক্ষা করার জন।
(লেখক রাজ্যসভায় তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদীয় দলের নেতা। মতামত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy