এ দেশে পুণ্যলাভের পথটি যে কম পাপময় নহে, পুণ্যার্থীরাই বারংবার প্রমাণ করেন। সম্প্রতি উত্তর ২৪ পরগনার চাকলা ও কচুয়া ধামের যাত্রাপথে স্তূপীকৃত আবর্জনা কথাটি স্মরণ করাইয়া দিল। সেখানে পথের ধারে অসংখ্য অস্থায়ী খাবারের দোকান, জলসত্র খোলা হইয়াছিল। তাহার চাপে পরিবেশ ত্রাহি ত্রাহি করিতেছে। ব্যবহৃত প্লাস্টিক, থার্মোকলের বাসন জমিয়াছে রাস্তার পার্শ্বে, উচ্ছিষ্ট খাবার পচিয়া ছড়াইয়াছে দুর্গন্ধ। চলিয়াছে যত্রতত্র শৌচকর্ম। পুণ্যার্থীদের যাত্রাপথটির দৈর্ঘ্য স্বল্প নহে। সুতরাং, বাগুইআটি হইতে বসিরহাট— নাভিশ্বাস উঠিতেছে স্থানীয় বাসিন্দাদের।
আশ্চর্য নহে। যে দেশে সর্ব ক্ষেত্রেই ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বকে মানিয়া লওয়া হইয়াছে, সেখানে পুণ্যার্থীরা যদৃচ্ছাচার করিবার সাহস পাইবেন বইকি! তাঁহারা অবাধে পথঘাট নোংরা করিবেন, যাত্রাপথে তারস্বরে ডিজে চালাইয়া অসভ্যতা করিবেন— ইহা এক প্রকার অলিখিত নিয়মে পরিণত। নব্য ভারতে ধর্মের বেসাতি যত বাড়িবে, ততই এই নিয়ম প্রগাঢ় হইবে। গত কয়েক বৎসরে নানাবিধ পূজার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য রকম বাড়িয়াছে। একান্ত ঘরোয়া ব্রত-পার্বণগুলির গায়েও পড়িয়াছে বারোয়ারি রূপটান। পূজা এখন উৎসবে পরিণত। প্রায় প্রতিটি পূজার আনুষঙ্গিক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে তিন-চার দিনব্যাপী উদ্দাম নৃত্য, খানাপিনা, জলসা, মাইকের চিৎকার এবং বিসর্জনের তাণ্ডব। নীরব পুণ্যার্জনের ধারণাটি ক্রমশ অন্তর্হিত, তাহার জায়গা লইয়াছে এক সঙ্কীর্ণ আত্মসর্বস্ব পুণ্যার্জনের প্রচেষ্টা। যেখানে সাধারণ মানুষকে চরম অসুবিধায় ফেলিয়া, পরিবেশের সর্বনাশ করিয়া, সর্বোপরি সহ-পুণ্যার্থীদের জবরদস্তি পিছনে ঠেলিয়া নিজ পুণ্যলাভের, মতান্তরে আমোদ-আহ্লাদের পাকা ব্যবস্থাটুকুই একমাত্র লক্ষ্য। পুণ্যার্থীদের এই উদ্ধত আত্মসর্বস্বতারই প্রকাশ পথঘাট অপরিষ্কার করায়, মন্দিরে প্রবেশমুহূর্তের ঠেলাঠেলিতে।
এই অব্যবস্থা রুখিবার দায়িত্বটি যাঁহাদের লইবার কথা ছিল, সেই পুলিশ, প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধিরাও হাত উল্টাইয়াছেন। প্রসঙ্গ যেখানে ধর্মীয় আবেগ, সেখানে কঠোর হইবার উপায় তাঁহাদের নাই! দুর্ভাগ্য, তাঁহাদের নিরুপায়তার মাসুল দিতে হইতেছে অন্যদের। একে ডেঙ্গির মরসুম। তদুপরি, পুণ্যার্থীদের ‘দান’ খাদ্য-পানীয়ের ব্যবহৃত সামগ্রীতে জমা জল সেই উপদ্রবকে আরও দ্রুত আহ্বান করিতেছে। অস্থায়ী জলসত্রে অবাধে ব্যবহৃত হইতেছে থার্মোকল এবং প্লাস্টিক— পরিবেশের দুই মহাশত্রু। কিন্তু টুঁ শব্দটি চলিবে না। পুণ্যকর্মে বাধা পড়িলে যদি পুণ্যার্থীরা চটিয়া যান! ভোটবাক্সে প্রভাব পড়ে! এই সামগ্রিক অব্যবস্থা এখনই বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। পুণ্যার্থীদের সচেতনতা এ ক্ষেত্রে আবশ্যক, অবশ্যই। সঙ্গে প্রশাসনকেও কড়া হইতে হইবে। ধর্ম যে আইনের ঊর্ধ্বে নহে— সেই কথাটি আগে স্পষ্ট করিতে হইবে। পুরসভাকে উৎসবের মাসে বাড়তি নজরদারি চালাইতে হইবে। প্রয়োজনে জলসত্রগুলিকেই দায়িত্ব দিতে হইবে পরিপার্শ্ব পরিচ্ছন্ন রাখিবার, অন্যথায় তাহাদেরই জরিমানা গনিতে হইবে। এবং আইনভঙ্গকারীকে ধর্মনির্বিশেষে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হইবে। যে দেশের নাগরিকের সহজাত প্রবণতা আইন ভঙ্গ করা, সেখানে কড়া প্রশাসনের বিকল্প আজও নাই। প্রশাসন উদ্যোগী হইলে সচেতনতা আপনি আসিবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy