Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
মার্চ ২০২১
Bengali

নামভূমিকায়

পিছন ফিরে দেখলে এক অসাধারণ ইতিহাস: এক দিকে উদারতা আর মুক্তির সাধনা, অন্য দিকে সঙ্কীর্ণতার আরাধনা। গত একশো বছরে কোথায় এসে দাঁড়াল বাঙালি

শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২১ ০৫:০০
Share: Save:

আজকের দিনটিতে দাঁড়িয়ে, ‘একশো বছরে বাঙালি’র দিকে ফিরে তাকালে দেখব, ঠিক মাঝখানটিতে, পঞ্চাশ বছর আগে, বাঙালি জাতির একাংশ অনেক লড়াইয়ের পর একটি নতুন দেশ পেয়েছে, নাম হয়েছে বাংলাদেশ। অন্য দিকটি অবশ্য ইতিমধ্যে, আরও চব্বিশ বছর আগে থেকেই দেশবিভাগ ও জাতিবিভাগের আঘাত ধারণ করে হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। আর এই দুই নামের মধ্যে ধরা আছে একটি সূত্র— শতবর্ষের বাঙালি ইতিহাসের সূত্র।

কেমন থেকেছে বাঙালি, গত একশো বছরে? অসাধারণ সব চরিত্রকে পেয়েছিল সে, কাজের মধ্যে, জীবনের মধ্যে। উনিশশো বিশ-ত্রিশ সালের কথা যদি ভাবি, রবীন্দ্রনাথ খ্যাতির মধ্যগগন পেরিয়েছেন, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন বাঙালির রাজনীতি মঞ্চে দীপ্যমান, সুভাষচন্দ্র উল্কাবেগে উঠে আসছেন নেতৃত্ব-মঞ্চে, মাস্টারদা সূর্য সেন কাঁপিয়ে দিচ্ছেন ব্রিটিশ রাজকে, দৃষ্টি কাড়ছেন ফজলুল হক। বাঙালি সে-দিন রাজরোষকে ভয় করেনি— স্বাধীনতা, আত্মমর্যাদা আর অধিকারের যুদ্ধে তার নেতৃত্ব থেকেছে অবিচল, অতন্দ্র।

অন্য দিকে সাহিত্যাকাশে রবীন্দ্রনাথের পাশে নজরুল, শরৎচন্দ্র, জীবনানন্দ, তারাশঙ্কর-মানিক-বিভূতিভূষণ— অপূর্ব সব নক্ষত্র, ঝাঁকে ঝাঁকে গ্রহতারা। বিজ্ঞানদুনিয়ায় অগ্রদূতের মতো রয়েছেন জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা প্রমুখ। ভারতবাসী, অনেক সময় বিরক্তিসহকারেই মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে যে, মনন-ক্ষেত্রে বাঙালিই সেরা, দশকের পর দশক।

সেই উৎকর্ষের অভিযাত্রায় বাদ সাধতে বসল একটিই বস্তু— রাজনীতি। পিছন ফিরে দেখলে যন্ত্রণাবিদ্ধ হতে হয়— অন্তরসম্পদে সমৃদ্ধ এই জাতির গভীরে গিয়ে কী ভাবে ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত করেছে রাজনীতির কাঁটা, একের পর এক। প্রথম কাঁটা দেশভাগ। ধর্মসম্প্রদায়কে কেন্দ্র করে আত্মঘাতী রাজনীতি ফালাফালা করে দিল বাংলার সমাজ, বাঙালি যেন মুহূর্তে ভুলে গিয়েছে যুগযুগান্তের পড়শিকে, ভুলে গিয়েছে যে আচারেবিচারে তফাত নিয়েও সুখে-দুঃখে উৎসবে-ব্যসনে দুর্ভিক্ষে-রাষ্ট্রবিপ্লবে পাশাপাশি দিনযাপনে জড়িয়ে থেকেছে বিবিধ সম্প্রদায়।

আবার, রাজনীতিই হয়েছে বাঙালির আশাভরসার উৎস। এক রাজনীতির তাড়নায় যদি এক বিরাট সংখ্যার বাঙালিকে সব হারিয়ে পথে বসতে হয়, তবে অন্য রাজনীতির প্রেরণায় সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাষাসংস্কৃতির কাছে নিজেদের ‘সঁপে দেব না’ বলে তারা রুখে ওঠে। বাংলা ভাষার আন্দোলন এক শতকের বাঙালির সবচেয়ে বড় অর্জন, শেষ পর্যন্ত গোটা পৃথিবীকে

যা মাতৃভাষাপ্রেমের দাম বুঝিয়েছে। রাজনীতিই বাঙালিকে বুঝিয়েছে, আগ্রাসী ক্ষমতাকে পাল্টা মার দিয়ে কী ভাবে মাটিছাড়া করতে হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মতোই অনামা অজানা মুক্তিযোদ্ধারা গত শতকের বাঙালির গৌরব।

কিন্তু রাজনীতি তো শাঁখের করাত। এক দিকের বাঙালি যখন মুক্তির সাধনায় ব্যস্ত, অন্য দিকের বাঙালি পিছনে হাঁটছে। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি ক্রমে তার উৎকর্ষের জমি ছেড়ে দিয়ে অনাবাদকে আলিঙ্গন করে নিয়েছে। রাজনীতির চক্রবৃত্তে হারিয়ে ফেলেছে তার উজ্জ্বল ছাত্রদের, তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে, তার সামাজিক মননের সম্ভারকে। হারিয়েছে তার অর্থনীতির ঐতিহাসিক জোরটাকেও। দেশভাগ যদি রাজনীতির প্রাথমিক মার হয়, তবে পরের মারগুলি এসেছে নানা দিক থেকে। এক

দিকে পশ্চিমবঙ্গ তার জীবনের শুরু থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্য এবং বঞ্চনার শিকার, অন্য দিকে বামপন্থী দলগুলি নিজেদের জনপ্রিয়তার পাল্লা ভারী করার তাগিদে রাজ্যের অর্থনীতির গোড়ায় দিয়েছে কোপ।

একুশ শতক দেখল, এবং দেখছে, এই বিধ্বংসী রাজনীতির চূড়ান্ত অবনমন, অপপ্রয়োগ, তার নামে অনাচার ও অত্যাচারের সহস্রলীলা। আজ বাঙালির সমাজ কেবল অশান্তি ও সংঘর্ষের পীঠভূমি নয়, তার মননশীলতার মন্ত্রটি যেন পুরোই চাপা পড়েছে রাজনীতিপঙ্কের তলায়। দেশভাগের সাত দশক পর আবার ঘুরে এসেছে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, প্রতিবেশীকে শত্রু ভাবার নীচতা। আর তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে সঙ্কীর্ণ ক্ষমতালোভ, অর্থগৃধ্নুতা, নিজের ভাষা-সংস্কৃতির সম্মান জলাঞ্জলি দিয়ে ক্ষমতার পদলেহন।

অতঃপর? এই চোরাবালিতে ডুবে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়াই বাঙালি তার নিয়তি বলে মেনে নেবে? না কি, ঘুরে দাঁড়িয়ে সে বলবে, ‘আর নহে আর নয়’? মনে করিয়ে দেবে যে, আপন ভাষা ও সংস্কৃতির মর্যাদা সম্পর্কে প্রত্যয় আজ অত্যন্ত জরুরি। রাজনীতির ভুবনে এই ব্যাধির ঔষধ মিলবে না। দায়িত্ব সমাজের। সুস্থ চিন্তা এবং উদারমনস্ক সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের যে সম্পদ আজও বাঙালি সমাজের ভান্ডারে আছে, তার মূল্য কম নয়। সঙ্কীর্ণতা, সাম্প্রদায়িকতা, চিন্তাবৈকল্য দূর করতে পারলে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি আজও আলোর পথযাত্রী হয়ে গোটা দেশকে পথ দেখাতে পারে। নিজের উজ্জ্বল উত্তরাধিকার বিনষ্ট না করে সেই নবজাগরণের অভিমুখে এগোনোই আজ তার দায়িত্ব।

অন্য বিষয়গুলি:

Bangladesh Bengali Bengalis
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy