গত জুলাই মাসে এনআরসির প্রকাশিত খসড়া তালিকায় বাদ পড়েছিলেন ৪১ লক্ষ মানুষ। চূড়ান্ত তালিকা থেকেও বেশ কয়েক লক্ষ মানুষের নাম বাদ যাবে সেই আশঙ্কা ছিলই। অবশেষে অসমের জাতীয় নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ পড়লেন ১৯ লক্ষের বেশি মানুষ, যা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার প্রায় ছয় শতাংশ বা সারা ভারতের জনসংখ্যার ০.১৪ শতাংশ।
কেউ নিজে হঠাৎ ‘বিদেশি’ হয়ে গিয়েছেন, কারও স্ত্রী, কারও মা, কারও সন্তান এখন ‘বিদেশি’। এনআরসি তালিকা প্রকাশের পর এমনই বিচিত্র অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে অসমে। হাজার হাজার বৈধ ভারতীয় নাগরিক, সিআরপিএফ এবং অন্য জওয়ান এমনকী, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আলি আহমেদের পরিবারের সদস্যদের নামও বাদ গিয়েছে। মোহাম্মদ সানাউল্লাহ এক টানা চার বছর জম্মু-কাশ্মীরের উপদ্রুত এলাকায় সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত ছিলেন। ২০১৪ সালে রাষ্ট্রপতির প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে শংসাপত্র পান। সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন সাম্মানিক ক্যাপ্টেন হিসাবে। মহিরুদ্দিন আহমেদ ১৯ বছর সেনায় ছিলেন হাবিলদার হিসেবে। অবসর নেন ২০০৫ সালে। দু’জনেই অসমের বাসিন্দা, বাঙালি এবং দু’জনের নাম ওঠেনি এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকায। দু’জনেরই স্ত্রী নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন, বাদ পড়েছেন সন্তানেরা। তেমনই এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকায় ঠাঁই হয়নি অসমের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের বিধায়ক অনন্তকুমার মালোর। এমন হাজারো অসঙ্গতিতে পূর্ণ অসমের সদ্য প্রকাশিত এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা। প্রশ্ন হচ্ছে কেন এনআরসি? অসমে এনআরসি চালুর মূল ভিত্তি ছিল অসমীয়া জাতীয়তাবাদ বা অস্মিতা। এনআরসি সংক্রান্ত সমস্যার শুরু সাতের দশকে। তখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলছে। ১৯৭১ সালে সেই রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের সময়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ পালিয়ে ভারতে চলে আসে। এদের একাংশ অসমে আশ্রয় নেয়। পরে ভোটার তালিকায় তাদের নাম ওঠে। ‘অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন’ বা আসু ১৯৭৯ সাল থেকে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। ১৯৮৩ সালে এই আন্দোলন হিংসাত্মক রূপ নেয় এবং মৃত্যু হয় অসংখ্য মানুষের। ১৯৮৫ সালে রাজীব গাঁধী নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তি করে আসু, যার মধ্য দিয়ে ‘বিদেশি’ চিহ্নিত করে বিতরণের প্রক্রিয়ায় সিলমোহর পরে। চুক্তিতে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের পর অসমে আসা বিদেশিদের চিহ্নিত করতে হবে এবং উপযুক্ত পদক্ষেপ নিয়ে বিতাড়িত করতে হবে। পরবর্তী কালে ২০০৯ সালে অসমের ভোটার তালিকায় ৩১ লক্ষ বিদেশির নাম রয়েছে এই অভিযোগ তুলে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে ‘অসম পাবলিক ওয়ার্ক’ বা এপিডব্লিউ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। সুপ্রিম কোর্ট নতুন করে পঞ্জিকরণ করার নির্দেশ দেয়।
এনআরসি চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর দেখা যাচ্ছে কেউ খুশি নয়। যে সংগঠন সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানিয়েছিল এবং যার জেরে এনআরসি হল, সেই এপিডব্লিউ খুশি নয়, খুশি নয় আসুও। এই দুই সংগঠনের খুশি না হওয়ার কারণ তারা মনে করে আরও বেশি লোকের নাম বাদ পড়া উচিত ছিল। রাজ্যের মোট জনসংখ্যার প্রায় ছয় শতাংশ মানুষ এই মুহূর্তে জাতীয় নাগরিক পঞ্জির বাইরে। এর মধ্যে প্রায় আড়াই লক্ষ পরিবারকে এমনিতেই এনআরসি থেকে বাদ রাখা হয়েছে বিদেশি ন্যায়াধিকরণে চালু মামলায় তারা ফেঁসে আছে বলে। এছাড়া তিন লক্ষ চুয়াত্তর হাজার মানুষ খসড়া এনআরসি থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য পুনরায় আবেদন করেননি। আর বাদ যাওয়া মানুষদের মধ্যে নিশ্চিত করে বলা যায় যে, বেশ বড়সড় সংখ্যায় বৈধ ভারতীয় নাগরিক রয়েছেন, যাঁদের নাম আগামী দিনে তালিকাভুক্ত হবে। ফলে, সব মিলিয়ে ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের পর এসেছেন এমন লোকজনের সংখ্যা হয়তো তিন বা চার শতাংশে দাঁড়াতে পারে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও তার ইতিহাস মাথায় রাখলে এই সংখ্যাটি খুব বড় নয়। তাদের এত দিনের আন্দোলন মাঠে মারা গেল।
অন্য দিকে, খুশি নয় কংগ্রেস। কংগ্রেস নেতাদের যুক্তি শেষ পর্যন্ত যে নাগরিক পঞ্জি হয়েছে, তা মেনে নেওয়া যায় না। বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবার খুশি নয়, কারণ অনেক হিন্দু নাম নাগরিক পঞ্জি থেকে বাদ পড়েছে। তাদের এখন ট্রাইব্যুনালে চক্কর কাটতে হবে। আসলে অসমে ভূমিপুত্র বনাম বাঙালি অশান্তির যে পরিবেশ দীর্ঘ দিন ধরে ছিল, সেই অশান্তির অভিমুখ ছিল বাঙালির দিকে। রাজ্য বিজেপি ও কেন্দ্রীয় বিজেপি সেই অভিমুখের পরিবর্তন করে বাঙালি থেকে বাঙালি মুসলিমের দিকে ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছে। তাদের বক্তব্য হল— সীমানা পেরনো মুসলিমরা অনুপ্রবেশকারী। কেননা বাংলাদেশ প্রতিবেশী মুসলিম দেশ আর সীমানা পেরনো হিন্দুরা শরণার্থী। ফলে, অসমীয়া জাতীয়তাবাদীরা এনআরসি চেয়েছিলেন বাংলাভাষী বিদেশি ঠেকানোর জন্য। কিন্তু বিজেপি এনআরসি চেয়েছে মুসলিম অনুপ্রবেশকারী বিতরণের জন্য। গত লোকসভা ভোটে অসমে বিজেপির ইলেকশন ক্যাম্পেনে সিংহভাগ জুড়ে ছিল এই মুসলিম বিতরণ। কিন্তু কোথায় লক্ষ লক্ষ মুসলমান বিদেশি! উনিশ লাখের সংখ্যাগরিষ্ঠরাই যে হিন্দু বাঙালি। তাই অস্বস্তিতে বিজেপি নেতৃত্ব। ক্ষোভ এড়াতে আরও বেশি সংখ্যক নতুন ট্রাইবুনাল খোলার ব্যবস্থা করছে কেন্দ্র, যাতে দ্রুত অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, এর পর কী? কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের পক্ষ থেকে আপাতত বার্তা দিয়ে বলা হয়েছে যাঁদের নাম তালিকা থেকে বাদ পড়েছে, তাঁদের আইনি সাহায্য দেবে অসম সরকার। যাঁদের নাম তালিকায় নেই তাঁদের কোনও ভাবে আটক করা হবে না। নাম বাদ যাওয়া ব্যক্তিরা অন্য নাগরিকের মতো শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে সমস্ত সুবিধা পাবেন। এনআরসিতে নাম না থাকলে কেউ দেশহারা হবেন না বলে জানিয়েছে বিদেশমন্ত্রক।
আপাতত যাঁদের নাম নাগরিক পঞ্জিতে ওঠেনি এর পর তাঁদের কাজ ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের কাছে গিয়ে আবেদন করা। কিন্তু সেই আবেদনের পরেও যদি নাম নথিভুক্ত না হয় তা হলে তাঁদের কি চুক্তি অনুযায়ী বিদেশে বিতাড়িত করা হবে? সে আশঙ্কা আপাতত নেই। কারণ বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সূত্রে বুঝিয়ে দিয়েছে যে ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশ থেকে কোনও মানুষ ভারতে আসেননি বা আনঅথরাইজড মাইগ্রেশন হয়নি। অন্য দিকে, সরকারি ভাবে ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে বোঝানো হয়েছে যে, এনআরসি ভারতের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার এবং ভারতের এই মুহূর্তে কোনও পরিকল্পনা নেই যে এনআরসি-ছুট মানুষদের বাংলাদেশে পাঠানোর। ফলে, এনআরসি-ব্রাত্য মানুষদের গন্তব্য হবে ডিটেনশন ক্যাম্প বা বন্দি-শিবির।
এখন অসমে ডিটেনশন সেন্টার আছে ৬টি। সম্প্রতি গুয়াহাটি থেকে ২২ কিমি দূরে মাটিয়ায় তৈরি হচ্ছে দেশের বৃহত্তম বন্দিশিবির। এ ছাড়াও বরপেটা, ডিমা, হাসাও, নলবাড়ি, লখিমপুর প্রভৃতি স্থানে আরও বন্দিশিবির তৈরির উদ্যোগ চলছে। সব মিলে খরচ হাজার কোটি টাকা। এই সব শিবিরে এক পরিবারের হলেও নারী-পুরুষকে আলাদা থাকতে হবে। ফলে, স্বামীর থেকে স্ত্রী বিচ্ছিন্ন হবেন। বিচ্ছিন্ন হবেন সন্তানেরা, বৃদ্ধ পিতামাতা। যদিও স্কুল, হাসপাতালের মতো পরিষেবা থাকবে সেখানে।
পরিষেবা যতই থাক, গৃহহীনতা, পরিবার হীনতা, সর্বোপরি স্বাধীনতা হীনতার যন্ত্রণা কি দূর করা যাবে বন্দি শিবির থেকে?
লেখক শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy